“গালি যেন নিজ গায়ে না পড়ে”

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফাওজিয়া ফারহাত অনীকা | 2023-08-30 12:22:11

ছুটির দিনে বাস ফাঁকা থাকার কথা। কিন্তু বাস গিজগিজ করছে মানুষের ভিড়ে। ছয় নম্বর বাস বলেই হয়তো এই দশা। বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাস কিছুদূর এগোলেই কন্ডাক্টর ভাড়া তুলতে আসলেন। চলন্ত বাসে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ব্যাগ থেকে টাকা বের করা বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়। তাই উনাকে মৃদু হেসে জানালাম একটু পরে ভাড়া দিচ্ছি। উনিও ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে সামনে চলে গেলেন।

কিছুক্ষণ পর পুনরায় ভাড়া তুলতে আসলে ভাড়া দিয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছি, এমন সময় পেছন থেকে একজন ভদ্রমহিলার চিৎকার শুনে পেছনে ফিরে তাকালাম। ঠিক আমার পেছনের সিটে বসা পরিপাটি ও মার্জিত পোশাকের একজন মহিলা, কন্ডাক্টরের দিকে আঙ্গুল তুলে চিৎকার করছেন। তাকে দেখে যথেষ্ট শিক্ষিত মনে হলেও আচার-আচরণে বিস্মিত হতে হয়।

কন্ডাক্টরের দোষ- কেন তার কাছে দ্বিতীয়বার ভাড়া চাওয়া হলো! এতো বড় সাহস কন্ডাক্টরের! একবার ভাড়া নিয়েও আবার ভাড়া চায়, চেহারা মনে রাখতে পারে না!

তার উপরে অনর্গল চিৎকার করা হলেও, কন্ডাক্টর খুব ভদ্রভাবে ভদ্রমহিলাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন- ভাড়া তোলার সময় সবার কাছেই এভাবে ভাড়া চান। এতো যাত্রীর মাঝে তার খেয়াল থাকে না। বলে দিলেই হয় যে ভাড়া হয়ে গেছে।

এবার ভদ্রমহিলা দ্বিগুণ উৎসাহে গালাগালি শুরু করলেন। বেয়াদপ, অসভ্য, মুখে মুখে তর্ক! এর মাঝে কন্ডাক্টর চুপ করে সামনে চলে গেলেন। একটা কথাও বললেন না।

দুই.

দিন কয়েক আগে অফিস শেষে সহকর্মীদের সঙ্গে পানিপুরি খাচ্ছিলাম। বিক্রেতা আমাদের পরিচিত। দেখা হলেই কুশলাদি বিনিময় হয়। আমাদের জন্য পানিপুরি তৈরি করার মাঝেই একটি মোটরসাইকেল এসে থামলো তার পাশে। আরোহী দুইজন- একজন ভদ্রলোক ও তার মেয়ে। মেয়ের আবদারে বিক্রেতার কাছে ভেলপুরি অর্ডার করলেন। উনি দ্রুত হাতে ভেলপুরি তৈরি করে দেওয়ার সময় ভদ্রলোক জানতে চাইলেন কতগুলো ভেলপুরি দিয়েছেন। সংখ্যাটা বলতেই ভদ্রলোক দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, ‘শালা চোখের মাথা খাইছোস। বারোটা দিতে বললাম। কান কই রাইখা আসোস’।

বিক্রেতা চুপচাপ আবারো ভেলপুরি তৈরিতে মনোযোগ দিলেন। বাবার পেছনে বসে মেয়ে বাবার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। বাবার এমন আচরণে দারুণ বিস্মিত হয়েছে, সেটা তার মুখ দেখেই বলে দেওয়া যায়।

উপরের দুইটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী যেমন আমি হয়েছি, তেমনভাবে আপনি নিজেও হয়তো হয়েছেন কোন না কোন সময়। এখানে কারোর পক্ষ নেওয়া কিংবা কারোর বিপক্ষে বলা নয়, আচরণগত সমস্যা তুলে ধরাটাই হলো মূখ্য বিষয়।

পরিবেশ, পরিস্থিতি ও মানসিক অবস্থা যে সবসময় অনুকূলে থাকবে এমনটা আশা করা যায় না। ঠিক তেমনিভাবেই সম্পূর্ণ অকারণে অন্যের উপর অসংযত আচরণকেও গ্রহণ করা যায় না। উন্মুক্ত স্থানে আপনার আচরণ যদি দুর্গন্ধ ছড়ায়, তবে বুঝতে হবে পচন ধরছে খুব গভীরে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবি, প্রবন্ধকার ও দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরিও খুব চমৎকার একটি কথা বলেছিলেন। ‘তোমার কাজ ও আচরণের প্রভাবে যেন চারপাশের পরিবেশ সুমিষ্ট ঘ্রাণে ভরে ওঠে’। খেয়াল করে দেখুন, কথাটির ঠিক বিপরীত কাজগুলোই আমরা প্রতিনিয়ত করছি। আবার এই আমরাই চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ ফেলে বলছি ‘রসাতলে গেলো, সব রসাতলে গেলো’!

একবার ভাবুন তো, বাবার আচরণ দেখে ছোট মেয়েটির মনে কি প্রভাব পড়েছিল! ছোটবেলা থেকে বাবার এমন আচরণ দেখে সে কি শিখবে, কি শিখে বড় হবে! যেখানে খুব সামান্য এক লাইনের একটি কথাতেই ঝামেলা চুকে যায়, সেখানে গালাগালি করার মতো বালখিল্যপূর্ণ আচরণের প্রদর্শন কেন?

এখানেও আরেকজন লেখকের যুক্তিযুক্ত উক্তি বলা যায়। মার্কিন যুক্তরাজ্যের লেখক হেক্টর হিউ মানরো বলেছেন, ‘আপনি যদি শুধু নতুন নতুন উপায়ে খারাপ ব্যবহার করা শেখেন, তবে অহেতুকই আপনার বয়স বাড়ছে’।

বয়স বৃদ্ধি মানে শুধুই বয়সের সংখ্যা উপরের দিকে ওঠা নয়, নিজেকে আরও পরিণত করা, আচরণকে সংযত ও সুশৃঙ্খল করে তোলা। একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ কুৎসিত মুখভঙ্গি করে কাউকে গালাগালি করছে এই দৃশ্যটা কখনোই সুখকর নয়। উদ্ধত আচরণের মানুষটি নিজেও হয়তো জানেন না, তার এই আচরণ ও গালাগালিগুলো উল্টো তার নিজের গায়েই এসে পড়ছে। নিজেকে নিজেই অপমানিত করছেন তিনি। জানলে নিশ্চয় তিনি এমনটা করতেন না!

ফাওজিয়া ফারহাত অনীকা: স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, লাইফস্টাইল

এ সম্পর্কিত আরও খবর