১৪ দল রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছে!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-26 00:54:45

রাজনীতিতে জোট কোনো নতুন বিষয় নয়। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ৭ বছরের মাথায় হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গড়া যুক্তফ্রন্ট কাঁপিয়ে দিয়েছিল মুসলিম লীগের মসনদ। এই বাংলাদেশেও এরশাদের বিরুদ্ধে নানান জোট হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মূল দুই দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি বিভিন্ন সময়ে নিজেদের মত জোট করেছে।

জোট কখনো হয় ভোটের, কখনো আদর্শের। ১৯৯৯ সালে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট মিলে গঠন করেছিল চারদলীয় জোট। চারদলীয় জোট আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট। জাতীয় পতাকা ওড়ে যুদ্ধাপরাধী নিজামী আর মুজাহিদের গাড়িতে।বিরোধী শক্তির ঐক্য শঙ্কিত করে আওয়ামী লীগকে। তারাও নিজেদের পক্ষের দলগুলোকে নিয়ে ঐক্য গড়ার উদ্যোগ নেয়।

২০০৪ সালের ২৫ নভেম্বর আওয়ামী লীগের সমমনা স্বাধীনতার পক্ষের অসাম্প্রদায়িক শক্তির ১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়। এটা আওয়ামী লীগের আদর্শিক জোট। তবে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া আওয়ামী লীগ ভোটের জন্য নিজেদের শক্তিবলয় বাড়িয়ে জাতীয় পার্টিকেও কাছে টানে। তবে ১৪ দলের আদর্শিক অবস্থানে দাগ লাগায়নি আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টিকে নিয়ে গঠন করে মহাজোট। সেই মহাজোটে পরে আরো অনেকে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু ১৪ দলীয় জোট আছে আগের মতই। গঠনের পর ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ টানা তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪ দল ও মহাজোটকে সাথে নিয়ে অংশ নেয় এবং বিশাল জয় পায়।

২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ের পর গঠিত সরকারে প্রথমে ১৪ দলের প্রতিনিধি ছিলেন সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া। পরে মন্ত্রিসভায় যুক্ত হন রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে ইনু-মেননের মন্ত্রিত্ব বহাল থাকলেও বাদ পড়েন দিলীপ বড়ুয়া। এবারের নির্বাচনে বিশাল জয়ের পর মন্ত্রিসভায়ও ছিল বিশাল চমক। আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা সব নেতারা বাদ পড়েছেন। সাথে বাদ পড়েছেন ১৪ দল ও মহাজোটের সবাইও। শেখ হাসিনার চারবারের সরকারে এবারই প্রথম নির্ভেজাল আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা। কাকে মন্ত্রী করবেন, কাকে রাখবেন, কাকে বাদ দেবেন সেটা একান্তই প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত। ক্ষমতায় আসলেই মন্ত্রিত্ব দিতে হবে, এমন শর্তে নিশ্চয়ই জোট-মহাজোট করেনি আওয়ামী লীগ। কিন্তু তারপরও ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ সালের সরকারে জোট শরিকদের পাশে রেখেই দেশ চালিয়েছে আওয়ামী লীগ।

এবারের মন্ত্রিসভায় জোট-মহাজোটের কেউ নেই। তার মানে কি আওয়ামী লীগের কাছে জোট-মহাজোটের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে? এই প্রশ্নেই তোলপাড় রাজনীতি। প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু উত্তর এখনও কারোই জানা নেই।। মন্ত্রিসভা গঠনের পরপর রাশেদ খান মেনন বলেছিলেন, কেন ১৪ দলের কেউ মন্ত্রিসভায় নেই, সেটা তারা জানতে চাইবেন। চেয়েছেন কিনা, চাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন কিনা, পেলেও কী উত্তর পেয়েছেন; জানি না। কারণ পরে আর এ নিয়ে কোনো কথা বলেননি তিনি।

এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে ২৫৭ আসন পেয়েছে। এরপর তাদের ৫ আসন পাওয়া ১৪ দলের শরিকদের গোনায় না ধরলেও চলে। কারণ ১৪ দলের শরিকরাও জানেন, আওয়ামী লীগের সাথে মিলে নৌকা মার্কায় নির্বাচন না করলে এই ৫ আসনও তারা পেতেন না। আওয়ামী লীগ দূরে ঠেলে দিলেও ১৪ দলের শরিকরা বলছেন, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ১৪ দলীয় জোটের প্রয়োজনীয়তা এখনও ফুরিয়ে যায়নি। কিন্তু এই প্রয়োজনীয়তার কথা আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে তো?

আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা নির্বাচনের পর দলের এক যৌথসভায় ১৪ দলের শরিকদের নিজের পায়ে দাড়াতে বলেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ১৪ দলকে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে বলেছেন। কিন্তু সেখানেও তো জায়গা খালি নেই। দশম সংসদের মত একাদশ সংসদও বিরোধী দল শূন্য হয়ে গেছে। মূল বিরোধী জোট ঐক্যফ্রন্ট পেয়েছে মাত্র ৮টি আসন। তাই ২২ আসন পাওয়া জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে বিরোধী দলীয় নেতা, উপনেতা, চিফ হুইপ ঠিক হয়ে গেছে। বিরোধী দল হিসেবে ৫ আসন পাওয়া ১৪ দলের শরিকদের কতটুকু ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকবে? আর আওয়ামী লীগ বললেই তারা সরকারি দল, বললেই বিরোধী দল; এমন পোষা অবস্থানটা ১৪ দলের শরিকদের জন্য সম্মানজনক নয়। আর ১৪ দলের শরিকদের এখন দুঃখ বলারও জায়গা নেই। ১৪ দলর সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম নিজেই তো এবার বাদ পড়াদের তালিকায়। তাই ১৪ দলের অবস্থা এখন না ঘরকা, না ঘাটকা।

১৪ দলের সাথে আওয়ামী লীগের টারাপোড়েনটা পুরোনো। আওয়ামী লীগ ছাড়া যে তারা শূন্য, সেটা বুঝতেই চান না ১৪ দলের নেতারা। বরং তাদের ভাবচক্কর দেখে মনে হতে পারে, তারা আওয়ামী লীগকে উদ্ধার করছে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে কুষ্টিয়ায় এক জনসভায় জাসদ সভাপতি ও তখনকার তথ্যমন্ত্রী আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, 'আপনি আশি পয়সা। আর এরশাদ, দিলীপ বড়ুয়া, মেনন আর ইনু মিললে এক টাকা হয়। আমরা যদি না থাকি, তাহলে আশি পয়সা নিয়ে রাস্তায় ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরবেন। এক হাজার বছরেও ক্ষমতার মুখ দেখবেন না।’

কিন্তু ইনুর এই হুমকি বুমেরাং হয়েছে। হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়নি। ইনুর হুমকির একবছরের মধ্যেই ২৫৭ আসন নিয়ে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। বরং ইনু-মেনন-দিলীপ বড়ুয়াদের এখন রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘোরার দশা।

তবে আওয়ামী লীগ যতই আত্মবিশ্বাসী হোক, আমিও মনে করি ১৪ দলের প্রয়োজনীয়তা এখনও ফুরিয়ে যায়নি। ক্ষমতা থাকা না থাকাটা মূখ্য নয়; মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্যবদ্ধ থাকাটা জরুরি। আমি বলছি না, ঐক্যের স্বার্থে ১৪ দলের কাউকে মন্ত্রিসভায় নিতেই হবে। তবে অন্তত ডেকে তাদের বঞ্চনার, দুঃখের কথা যেন আওয়ামী লীগের কেউ শোনে। নির্বাচনের পর গণভবনে অনেকেই আমন্ত্রণ পেয়েছেন। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১৪ দলের একটা বৈঠক হলে কী এমন ক্ষতি। এতদিনের পুরোনো ও বিশ্বস্ত শরিকদের একটুকু সম্মান দেয়া যেতেই পারে।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর