জাতিসংঘের ব্ল্যাকলিস্ট: ইসরায়েলের অমোচনীয় কালিমা

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2024-06-13 10:50:43

জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থায় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ ব্যাপার নয়। নানা পরাশক্তি, লবি, ইন্টারেস্ট, প্রেশার গ্রুপ সামাল দিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সত্যিই কঠিন কাজ। এহেন জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে প্রণীত কালো তালিকায় খুব বেশি দেশের নাম নেই। মহা হম্বিতম্বি আর পশ্চিমা মুরুব্বিদের নেকনজর থাকার পরেও জাতিসংঘের ‘কালো’ তালিকায় ইসরায়েল নাম লেখা হয়েছে। যে অমোচনীয় কালিমা ইসরায়েল নামক গণহত্যার দোষে দুষ্ট দেশটির ললাট থেকে কোনো দিনই মুছে ফেলা সম্ভব হবে না।

জাতিসংঘের কালো তালিকা বা ‘ব্ল্যাকলিস্ট’-এর তালিকায় ইসরায়েলের নাম যুক্ত হয়েছে মূলত শিশুদের হত্যা ও তাদের উপরে ‘অকল্পনীয়’ অত্যাচার চালানোর অভিযোগে। ইসরায়েলকে কালো-তালিকাভূক্ত করার বিষয়ে প্রদত্ত জাতিসংঘের রিপোর্ট এমনটিই বলা হয়েছে।

ইসরায়েলি গণহত্যা ও বর্বরোচিত হামলার পটভূমিতে আতঙ্কিত বিশ্ববিবেক ভীত ও ত্রস্ত হয়ে বার বার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। এমনকি, আল-বালার আল-আকসা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে বাধ্য হয়েছেন এক চিকিৎসক: 'এটা হাসপাতাল না কসাইখানা?’ সাংবাদিকদের তিনি দেখাচ্ছিলেন, চারিদিকে পড়ে থাকা রক্তাক্ত মৃতদেহ। যাদের অধিকাংশই শিশু। এরই মধ্যে 'হয়ত কোথাও হয়তো কেউ বেঁচে' এই নিষ্ফল আশায় খোঁজ চালাচ্ছেন প্রিয়জনেরা।

হামাসের সঙ্গে লিপ্ত সংঘাতে ইসরায়েলের তরফে হাসপাতালে সশস্ত্র হামলা চালানোর কোনো যুক্তিই ছিল না। বৃদ্ধ, শিশু ও রোগী ছাড়া সক্ষম মানুষও সেখানে ছিল। হামাস যোদ্ধা থাকার বিষয় ছিল অকল্পনীয়। তবু রেহাই পায়নি হাসপাতাল, অসুস্থ মানুষ, অগণিত শিশু। আসলে ইসরায়েলের আক্রমণগুলোকে বলা যায় গণহত্যার ছুতানাতায় গণহত্যা।

অসংখ্য ইসরায়েলি হামলার আরেক ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত নুসেরাত ও দের আল-বালার শিবিরে ‘অভিযান’। সেখানে হামলা চালিয়ে হামাসের হাতে থাকা চার ইসরায়েলি বন্দিকে যখন মুক্ত করতে সফল ইসরায়েল, সংবাদমাধ্যম সূত্রে তখন খবর প্রকাশিত হয়- ঐ দুই জায়গায় ইসরায়েলি হানায় নিহত অন্তত ২১০। গুরুতর আহত ৪শ’র ও বেশি। চারজনকে উদ্ধার করতে ২১০ মানুষ হত্যা ও চার শতাধিক লোককে জখম করা আসলে গণহত্যার নামান্তর। যে কারণে, প্রতিদিন তো বটেই ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে মৃতদেহ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গাজ়ায় নিহত হয়েছেন অন্তত সাড়ে ৩৮ হাজার মানুষ। নানা মহলের যদিও আশঙ্কা, হতাহতের সংখ্যা এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।

এরই মাঝে, জাতিসংঘের ‘ব্ল্যাকলিস্ট’-এর তালিকায় উঠল ইসরায়েলের নাম। মূলত শিশুদের হত্যা ও তাদের উপরে ‘অকল্পনীয়’ অত্যাচার চালানোর অভিযোগে ইসরায়েলকে কালো-তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারও ইসরায়েলের নৃশংসতার বিষয়গুলো উন্মোচিত করেছে।

জাতিসংঘের প্রতিনিধি, গিলাদ এরদান জানিয়েছেন, যে দেশ, সেনা বা গোষ্ঠী শিশুদের হত্যা, গুরুতর জখম, যৌন নির্যাতন, অপহরণ করে বা তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা- হাসপাতাল, স্কুল কিংবা কোনো মানবিক সহায়তা থেকে তাদের বঞ্চিত করে, তাদেরকেই এই কালো-তালিকাভুক্ত করা হয়। সশস্ত্র সংঘর্ষ-পীড়িত শিশুদের নিয়ে জাতিসংঘের তদন্তকারী ভার্জিনিয়া গাম্বার একটি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, গত আট মাসে গাজায় যে সাড়ে ৩৭ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্তত ১৩ হাজার শিশু রয়েছে। তিনি এ-ও বলেন, আগামী সপ্তাহে আরও একটি রিপোর্ট দেওয়া হবে নিরাপত্তা পরিষদে। তাতে, ঠিক কোন কোন ‘অপরাধ’ গাজায় শিশুদের প্রতি ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) করেছে, তা সবিস্তারে প্রকাশ পাবে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলি জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছে। স্বাগত জানিয়েছেন প্যালেস্টাইনের কর্তৃপক্ষও। তীব্র কটাক্ষ করেছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ইসরায়েলি সরকার। সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নৈতিকতার নিরিখে ইসরায়েল সেনা বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ’।

যদিও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর দাবি কেউই বিশ্বাস করছে না এবং প্রকৃত সত্যের নিরিখে তা নিতান্ত হাস্যকর বলে মনে করছেন। তথাপি ইসরায়েল এমন মিথ্যাচার করেই চলেছে এবং গাজায় গণহত্যা চালিয়েই যাচ্ছে। বিশ্বের কতিপয় শক্তিশালী রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় থাকার কারণে ইসরাইলকে গণহত্যার নেশা থেকে দমনও করা সম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায়, জাতিসংঘের ‘কালো’ তালিকায় ইসরায়েল নাম লেখা হওয়ার বিষয়টি দেশটির জন্য বিরাট বড় নৈতিক পরাজয়। তাদের অপরাধের পুরো শাস্তি না হলেও প্রতীকরূপে কাজ করবে কালো তালিকাভুক্তকরণের এই কলঙ্ক। যে কালিমা অমোচনীয়। যত বাহাদুরি ও বাগাড়ম্বরই করুক, ইসরায়েলের তার ললাটলিখন থেকে শিশুহত্যার কালিমা কখনোই মুছে ফেলতে পারবে না।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর