গণহত্যায় ইসরায়েলের সঙ্গে উচ্চারিত হোক পাকিস্তানেরও নাম

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2024-06-13 16:11:44

গণহত্যা নিকৃষ্টতম। দেশে-দেশে তারা ধিকৃত, ঘৃণিত হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু তেমনভাবে হয় না। কারণ গণহত্যাকে বিশ্বজন নিকৃষ্টতম বললেও এর সংজ্ঞায় ফেলে না সবগুলোকে। এই যেমন ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের আগ্রাসনকে গণহত্যা বলতে রাজি নয় পশ্চিমাবিশ্বের বেশিরভাগই। এর প্রতিবাদে আওয়াজ ওঠলেও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া যেভাবে হওয়ার কথা, সেভাবে হয়নি, হচ্ছে না। ফলে বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া ছাড়া মোটাদাগে এটা নিয়ে অনেকটাই প্রতিক্রিয়াহীন সবাই। ফলে ইসরায়েলি আগ্রাসন চলছেই।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ‘যুদ্ধ’ বলা হচ্ছে এটাকে। কিন্তু যুদ্ধ বলতে দ্বিপাক্ষিক যে বিষয় থাকার কথা সেটা এখানে নেই। ফিলিস্তিনের বিচ্ছিন্ন সংগঠন হামাসের আক্রমণের পর ফিলিস্তিন কেবল একপাক্ষিক আগ্রাসন চালিয়েছে, যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষ; নারী-শিশু। নারী-শিশুরাও সাধারণ মানুষের কাতারে পড়েন, কিন্তু তাদের নিয়ে আলাদা কথা বলতে হয়, আলাদাভাবে কথা বলা হয়, পৃথক আইন-নীতি-রীতি রয়েছে বিশ্বজুড়ে। সংগঠনও রয়েছে। এতকিছু পরেও তবু আগ্রাসন বন্ধ হয়নি। বন্ধ করা যায়নি। বন্ধের যে দাবি, তার মাঝে আওয়াজ আছে, তবে আছে আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন।

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলার আট মাস চলছে। গত বছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে চলমান এই আগ্রাসনে অন্তত ৩৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। দাপ্তরিক এ তথ্যের বাইরের বাস্তবতা সাধারণত এরচেয়েও কঠিন। প্রাণ হারানো মানুষদের সংখ্যা দিয়ে বিবেচনার বাইরেও থাকে অগণন মানুষের আহত হওয়ার খবর, থাকে বিপুল সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি, যা অনেকটাই অপূরণীয়। এছাড়া ইসরায়েলি এই আগ্রাসন যখন বছরের পর বছর ধরে যখন নির্বিঘ্নে চলছে, তখন সহসা এটা বন্ধ হবে বলেও মনে করাও কঠিন।

‘মৃত্যুকূপ’ গাজা অনেকটাই। অবরুদ্ধ গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের কথা বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে জানাচ্ছে, গাজায় চলমান সংঘাতে এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার ৬৯৪ শিশু নিহত হয়েছে। ১৭ হাজারেরও বেশি শিশু তাদের বা-মাকে হারিয়েছে। পর্যাপ্ত খাদ্য এবং অপুষ্টিতে ভুগছে পাঁচ বছরের কম বয়সী আরও ৮ হাজারের বেশি শিশু। ওখানে বিপর্যয়কর ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষাবস্থা চলছে বলে জানাচ্ছে সংস্থাটি। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের এবারের এই আগ্রাসনে অন্তত ৩৭ হাজার মানুষ নিহত ও আহত হয়েছেন অন্তত আরও ৮৫ হাজার ফিলিস্তিনি নাগরিক। অন্যদিকে হামাসের হামলায় ইসরায়েলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৩৯ জনে।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুকে বলা হচ্ছে ‘যুদ্ধ’, কিন্তু এটা যুদ্ধের সংজ্ঞায় পড়ে কিনা, এনিয়ে জোর আলোচনা নেই। যুদ্ধ আখ্যায় ইসরায়েলকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা বিদ্যমান বলেই কিনা এভাবে সংজ্ঞায়িত বিষয়টা। অথচ যুদ্ধ বলতে দুই পক্ষের একের বিরুদ্ধে অন্যের লড়াইকে বুঝানো হয়ে থাকলেও ফিলিস্তিনে হচ্ছে একপাক্ষিক আগ্রাসন, এবং এখানে ফিলিস্তিনিদের জয়ের সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। এখানে ইসরায়েলিরা একপাক্ষিক আগ্রাসন চালাচ্ছে, এবং ফিলিস্তিনিরা প্রাণে বাঁচতে লড়ছে কেবল। তাই এটাকে যুদ্ধ বলা না গেলেও বিশ্বমোড়লদের চালাকি এবং ইসরায়েলের প্রতি প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য অনুরাগ কাজ করছে। ইসরায়েল ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালাচ্ছে। তবু এখানে এসে পালটে যায় গণহত্যার সংজ্ঞা।

বাংলাদেশ ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সবসময় সরব কণ্ঠ। স্বাধীন ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সমর্থন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় থেকেই। এই সময়ে বাংলাদেশের ক্ষমতায় যারাই আসুক না কেন এই সমর্থনের অন্যথা হয়নি। নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের প্রতি বাংলাদেশের এই সমর্থন অনেকটাই আত্মিক। এখানে আছে মানবাধিকারের প্রশ্ন, আছে ধর্মীয় সংবেদনশীলতা।

এবার ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যথাসম্ভব ভূমিকা রাখছে। প্রতিবাদ জানিয়েছে, জাতিসংঘেও সামর্থ্য অনুযায়ী ভূমিকা রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিশ্বের বেশিরভাগই ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের এই ভূমিকা সাহসী এবং উল্লেখের মতো। বিগত নির্বাচনের সময়ে দেশি-বিদেশি বিবিধ চাপ সত্ত্বেও ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সরকার। নিজেদের অবস্থানকে অনিশ্চয়তা রেখেও আওয়ামী লীগ সরকারের এই ভূমিকাকে স্মরণ করতেই হবে। অথচ সরকারই ছিল তখন বহুবিধ চাপে। ওই সময়ে আমরা দেখেছি, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কিছু বললে কেবল ‘আমেরিকা রুষ্ট হয়ে যাবে এই ভয়ে’ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা রাজনৈতিক দলগুলো, এমনকি বিএনপিও কিছু বলেনি। অথচ ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবি ও অধিকারের প্রশ্নে আমরা ঐতিহাসিকভাবেই একাত্ম।

ইসরায়েল ফিলিস্তিনে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। বিশ্ববিবেক প্রভাব রাখার মতো অবস্থানে না গিয়ে অনেকটা নম্য থাকলেও বাংলাদেশ চুপ নয়। সামর্থ্যের যতটুকু তার সব করেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে, জনতার আছে এখানে সমর্থন। রাষ্ট্রীয় ভূমিকার বাইরে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া ক্ষোভ সবটাই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। এখানে প্রভাবক অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংবেদনশীলতা। অথচ মানবিক আহবানে ধর্মের বিরোধ নেই, রাজনৈতিক যোগ নেই; সম্পর্কটা কেবল আত্মিক।

যেভাবেই হোক মানুষ ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুখর, মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রতি কঠোর—এখানে এভাবে কি বিশ্লেষণ সম্ভব, এখানেই কি সন্তুষ্ট থাকা উচিত? উত্তর হোক আমাদের— ‘না’! কারণ যতক্ষণ না মানবতাবিরোধী অপরাধকে মানবতার বিরুদ্ধে আগ্রাসন না ভাবা হচ্ছে, ততক্ষণ ধর্মে-ধর্মে, জাতিতে-জাতিতে, শ্রেণি-বর্ণসহ বিবিধ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি হবে; ক্রমেই সংকুচিত হবে সাম্যের পথ। কিছু অবিবেচনাবোধ এখানে মূর্ত যদিও, তবে এটাকে বিভক্তিমূলক সংবেদনশীলতার প্রশ্নকে উহ্য রেখে সামনে আনা উচিত মানবিক দিক।

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসনকে তাই ধর্মীয় দিক দিয়ে বিবেচনা করা যাবে না। এভাবে বিবেচনার পথগুলোকে উন্মুক্ত না করে এখানে মানবিক দিকটিকে সামনে আনতে হবে। গণহত্যাকারীকে গণহত্যাকারীই বলতে হবে। কেবল ফিলিস্তিনেই নয়, বিশ্বের যেখানে যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা হয় সেখানেও প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে। একই সঙ্গে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাথায় রাখতে হবে আমরাও ছিলাম গণহত্যার শিকার। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল।

ইসরায়েল যদি ফিলিস্তিনে গণহত্যা অব্যাহত রেখে ধিকৃত হয়, একইভাবে আমাদের ওপর গণহত্যা চালানো পাকিস্তানিরাও ধিকৃত। ইসরায়েলের গণহত্যায় যেন আড়ালে না পড়ে পাকিস্তানিদের গণহত্যা!

এ সম্পর্কিত আরও খবর