বিদায় প্রজ্ঞা ও প্রগতির বরপুত্র

, যুক্তিতর্ক

আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম | 2024-06-15 06:52:51

৭০ বছরের এক বর্ণাঢ্য জীবন অতিবাহিত করে আজ ভোরে (১৪ জুন, ২০২৪) ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইহলোক ত্যাগ করে অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন বিশিষ্ট নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুর রশীদ। এই বহুল পরিচয়ের বাইরে ব্যক্তি মানুষ হিসাবে তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে মনে হয়েছে তিনি প্রজ্ঞা ও প্রগতির এক বরপুত্র। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন শেষে অধিকাংশ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের আর সেভাবে প্রকাশ্যে সমাজিক পরিমণ্ডলে দেখা যায় না। সেই বিচারে জেনারেল আবদুর রশীদ ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এক ব্যক্তিত্ব। আমরা জানি পেশাগত জীবনে প্রশিক্ষণ ও কমাণ্ড পরিচালনাসহ সকল ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বড় হয়ে যে দিকটি ধরা দিয়েছে তা হচ্ছে পেশাগত জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতা সমাজ এবং রাষ্ট্রের কল্যাণে সার্থকভাবে সদ্ব্যবহার করতে পেরেছেন আবদুর রশীদ।   

সমরজ্ঞান ও সমাজ-রাষ্ট্র তথা বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিকে একজন আবদুর রশীদ এতটাই গভীরভাবে অনুসরণ করতেন যে বাংলাদেশের জাতীয় গণমাধ্যমসমূহ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তাঁর বিশ্লেষণ শোনার জন্য উদগ্রিব থাকতো। মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের প্রশ্নে আপোষহীন সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তার বিশ্লেষণে যে অসাধারণ বাগ্মিতা প্রকাশ পেত তা সমকালীন বিশ্লেষকদের মাঝে বিরল। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর তুলনামুলক অধ্যয়ন এতটাই বিস্তৃত ও গভীর  ছিল যা তাকে বহু বক্তার মাঝে ভিন্ন পরিচয়ে দাড় করিয়ে দিত। সাত দশকের যাপিত জীবনে আবদুর রশীদ কেবল নিজেই সমুজ্জ্বল করেননি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবকেও বৃদ্ধি করেছেন।

পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে তাঁর পরিচয় বহু পূর্বেই পেয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবের মানুষটিকে জানার সুযোগ হয়েছে মাত্র ১ বছর ধরে। এই সময়কালে মাত্র ৩ বার জেনারেল আবদুর রশীদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ ঘটেছে। দু’বার তাঁর মিরপুর ডিওএইচএস এর বাসায় আর একবার আমার আমন্ত্রণে তিনি এসেছিলেন মৈত্রী দিবসের আলোচনায় বক্তা হয়ে। এছাড়াও অন্ততঃ ১০-১৫ বার তাঁর সঙ্গে ফোনালাম হয়েছে। এই সময়ে জেনারেল আবদুর রশীদের প্রতি যে গভীর সন্মোহন সৃষ্টি হয়েছে তাঁর নিঃসন্দেহে জীবনস্মৃতির এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।

‘মিয়ানমার বিষয়ে বাংলাদেশের দ্বিমুখী কূটনীতি গ্রহণ করা উচিত’

বিশেষ করে তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে আবদুর রশীদের  ব্যক্তিমানস সম্পর্কে যে মূল্যায়ন সৃষ্টি হয়েছে তা সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। যে দু’বার তাঁর বাসায় গিয়েছি-সেখানে পেশাগত আলোচনা ছাপিয়ে তা ক্রমেই দীর্ঘ আলাপচারিতায় পর্যবসিত হয়েছে। আধঘণ্টার নির্ধারিত সাক্ষাত সাড়ে ৩ ঘণ্টায় গড়িয়েছে। সেখানে আলোচনার মূল সুর ছিল মূখ্যত আদর্শিক সংহতির অনুরণন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতিশীলতা, বাংলাদেশ নিয়ে বহির্বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি-বার বার তাঁর আলোচনার কেন্দ্রে আবর্তিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন জেনারেল আবদুর রশীদ। পেন্টাগনের লব্ধ সেই অভিজ্ঞতা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাকর্তাদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি। সেকারণে আমরা দেখব, জেনারেল রশীদের আলোচনায় পরিমিতিবোধের কি চমৎকার পরিচয়!

সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি বর্বরতা, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ, রোহিঙ্গা সংকট, চীনের কৌশলগত অবস্থান, মিয়ানমারে ভারতের কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্ট কিংবা বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উত্থান নিয়ে তাঁর নির্মোহ মূল্যায়ন ছিল অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও তথ্যবহুল।  সংবাদকর্মীদের সঙ্গে প্রজ্ঞাবান এই মানুষটির ব্যক্তিগত আচরণে যে বিনয় ও আন্তরিকতা প্রকাশ পেত তা আমাদের আপ্লুত করতো। আজ যখন তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে বসেছি তখন বহু কথা স্মৃতিতে ভিড় করছে। সামরিক কর্মকর্তা হয়েও বাংলা ভাষার প্রমিত ব্যবহারে তাঁর অসাধারণত্ব সব সময়ই  মুগ্ধ করেছে। দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে গিয়ে সম্প্রতি তাঁকে শ্বাসকষ্টে ভুগতেও দেখেছি, চিকিৎসকেরও বারণ ছিল কিন্তু তবু তিনি বাকহীন হয়ে থাকতে পারতেন না। কথা বলা ও লেখাকে নিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর আমৃত্যু কর্তব্য হিসেবে মনে করতেন।  

বিদেশনির্ভরতা ও বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতি

আমাদের রাজনীতিবিদদের বিদেশমূখিতা নিয়ে সরব ছিলেন জেনারেল আবদুর রশীদ। তিনি মনে করতেন আমাদের রাজনীতিবিদদের দেশপ্রেম না থাকায় তাঁরা বিদেশিদের মুখাপেক্ষী হন কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক চক্রান্তে তাঁরা ঠিক ততোটাই পিছিয়ে। বার্তা২৪.কম-কে সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যা আছে, তাই আমাদের একটি দ্বিমুখি কূটনীতি গ্রহণ করা উচিত। একদিকে আরাকান আর্মির সঙ্গে প্রকাশ্যে বা গোপনে হোক সংযোগ তৈরি করা উচিত। আর স্বভাবতই মিয়ানমারের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে তো আমাদের কুটনীতি আছেই।’-রোহিঙ্গা সংকট যাদের কারণে তাদের কাছেই বাংলাদেশ সমাধান খুঁজছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন আবদুর রশীদ।  

সমকালীন ভূ-রাজনীতির বিস্তৃত প্রসঙ্গে আবদুর রশীদের যে গভীর বিশ্লেষণ তা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করতে দেখেছি আমরা। সমর-কুটনীতিতেও তিনি সাম্প্রতিক দশকে অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন। বর্তমানে বিশ্বে যুদ্ধ-বিগ্রহের এই সময়ে তাঁর চলে যাওয়া রাষ্ট্রের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

আদর্শিক নৈকট্যের কারণে পেশাগত প্রয়োজনের বাইরেও জেনারেল আবদুর রশীদের অপত্য স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি। সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা ‍নিয়ে ফিরে আসার পর শেষবার যখন কথা হল তখনও বেশ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে আমাকে বলেছিলেন, তিনি আশা করছেন অচিরেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন। কথা দিয়েছিলেন আমার সাংগঠনিক অফিসে আসবেন, মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণও গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সেই ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে গেল।

পরিশেষে এটুকুই বলবার যে, একজন আবদুর রশীদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা রাষ্ট্রের সম্পদ ছিলেন। তাঁর প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম এবং প্রগতির প্রতি অন্তহীন নিষ্ঠা সত্যিই অতুলনীয়। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন ও আদর্শের জন্য বহুদিন তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তাঁর পারলৌকিক জীবন শান্তির হোক, এই কামনা আমাদের।

এ সম্পর্কিত আরও খবর