ডাক্তার ইন ডাক্তার আউট

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোকাম্মেল হোসেন | 2023-08-26 03:16:21

মারাফতের ডান পায়ের হাঁটুর নিচে ছোট্ট একটা গেটিস দেখা দিল। কয়েক মাস আগে ছোটখাটো একটা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল মারাফত; এ তারই ফল। পিয়ারপুর রেল স্টেশনে ট্রেন থেকে নামার পর ভ্যানে চড়ে বাড়িতে যাচ্ছিল সে। হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে আসা এক মোটরসাইকেল আরোহী মোড় ঘোরার সময় মারাফতের ডান পায়ের দিকে নেকনজর নিক্ষেপ করল।

বাড়ি পৌঁছে বরফ ঘষাঘষি শেষে একটা প্যারাসিটামল পেটে চালান করে মারাফত ভেবেছিল, মোটরসাইকেল আরোহীর নেকনজরের সেলামি পরিশোধ হল। কিন্তু তা যে হয়নি, এর প্রমাণ এই গেটিস। গেটিস দেখে মারাফতের স্ত্রী বিলকিস বানু ভয় পেয়ে গেল। বলল-
: শিগগির ডাক্তারের কাছে যাও।
বিলকিস বানুর কথা আমলে না নিয়ে মারাফত বলল-
: ধুরউ! ভয়ের কিছু নাই।
: ভয়ের কিছু নাই মানে? তুমি কি মরবার চাও?
: এই ধরনের রোগে কেউ মরে না। তবে ল্যাংড়া হওয়ার একটা চান্স আছে।
: ল্যাংড়া হইলে খুব ভালা হয়, না?
: আমি তো কোনো অসুবিধা দেখতেছি না; অনেক ল্যাংড়া ফকিরের ঢাকা শহরে একাধিক বাড়ি আছে।
: তুমিও কি ভিক্ষা করবা নাকি?
: মন্দ কী? বিনা পুঁজি-বিনা পরিশ্রমে, হাতে একটা থালা আর মুখে হায় আল্লাহ তুই সোবাহান আওয়াজ তুলে রাস্তায় দাঁড়াইয়া পড়লেই কেল্লাফতে; জিন্দেগি টেনশন মুক্ত দক্ষিণের খোলা জানালা।

মারাফতের কথা শেষ হতেই বিলকিস বানু ঝড়ের বেগে রান্নাঘরে প্রবেশ করল। সেখানে প্লাস্টিকের একটা থালায় মাছ কাটার জন্য ছাই রাখা ছিল। ছাইগুলো মেঝের উপর ঢেলে থালাটা এনে মারাফতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-
: এই নেও থালা। যাও, বিসমিল্লাহ বইলা শুরু কইরা দেও। আইজ শুত্রবার; ভিক্ষা শুরু করার জন্য অতি উত্তম দিন।
: রাগ করতেছ কেন! আমি তো চুরি-ডাকাতি করার কথা বলি নাই, ভিক্ষা করার কথা বলছি। ভিক্ষা হইল আমাদের জাতীয় পেশা। দেখ না, বিদেশিরা ভিক্ষা দিলে আমাদের নেতৃবৃন্দ খুশিতে ডগমগ হইয়া সংবাদ সম্মেলন করেন আর ভিক্ষা না দিলে বেজার হইয়া বলেন, বেটারা পাঁজি হইয়া গেছে; আগের মতো সাহায্য দেয় না।


: আজাইরা প্যাচাল বাদ দিয়া ডাক্তারের কাছে যাও। আজই যাবা।
: আইজ শুত্রবার; হাসপাতালের বর্হিবিভাগ বন্ধ।
: ঠিক আছে, আগামীকাইল যাবা।
: অবশ্যই যাব। তোমার ফরমান জারি হওয়ার পর টাল্টিবাল্টি করার প্রশ্নই ওঠে না।

মারাফতের বাসার কাছেই সরকারি হাসপাতাল। হাসপাতালে পৌঁছে টিকিট কাউন্টার তালাস করছে মারাফত; এসময় এক লোক জিজ্ঞেস করল-
: ছার! রোগী আছে নাকি?
মারাফত হাসিমুখে উত্তর দিল-
: আমিই রোগী।
লোকটা সন্দেহের চোখে মারাফতের পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করতে থাকে। লোকটার হাবভাব দেখে মারাফত মুচকি হেসে বলল-
: হাঁটুভাঙ্গা ‘দ’ হইয়া না আইলে কি এই হাসপাতালে কাউরে রোগী হিসেবে কাউন্ট করা হয় না?
: না, তা না।
মারাফত লোকটার পরিচয় জানার জন্য জিজ্ঞেস করল-
: আপনে কী করেন?
: আমি একজন সাহায্যকারী।
: বুঝলাম না!
: সাহায্যকারী মানে হইল-এই হাসপাতালে যেসব রোগী আসে, সেবামূলক মনোভাব লইয়া আমি তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াইয়া দেই। যেমন ধরেন-এইখানের চাইতে বাইরের ক্লিনিকে আরও উন্নত, আরও আধুনিক চিকিৎসার বন্দোবস্ত আছে- এইটা রোগীর সঙ্গে আসা লোকজনদের বলি। এরপর যারা রাজি হয়, তাদের ক্লিনিকে পুনর্বাসন করি।
: ক্লিনিকে কি এই হাসপাতালের চাইতেও বড় ডাক্তাররা রোগী দেখেন?
: একই ডাকতর। সকালবেলা এই হাসপাতালে বইসা যারা চা-পান খায়, বিকালবেলা তারাই ক্লিনিকে যাইয়া কল্কি সাজায়।
: একই ডাক্তার হইলে হাসপাতালের চাইতে ক্লিনিকে উন্নত চিকিৎসা হয় কী প্রকারে?
: এইখানের পরিবেশ-পরিস্থিতি তো নিজের চক্ষেই দেখতেছেন। এই পরিবেশে কি মনোযোগ সহকারে চিকিৎসা করা যায়? সলিড চিকিৎসা সেবা দিতে হইলে নিরিবিলি পরিবেশ দরকার।

হাসপাতালে যে মন দিয়ে চিকিৎসা করা যায় না তার প্রমাণ একটু পরেই পাওয়া গেল। টিকিট কেটে দায়িত্ব পালনরত ডাক্তার মহোদয়ের কক্ষে প্রবেশ করল মারাফত। মারাফতের দিকে একবার তাকিয়ে ডাক্তার সাহেব চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে দু’হাত মাথার ওপর তুলে আড়মোড়া ভাঙ্গলেন; হাই তুললেন। এরপর মুখে কোনো কথা না বলে পানিতে মাছের মতো ঢুশ মারার ভঙ্গিতে মাথা তুলে চোখের ইশারায় প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলেন। চেহারায় খুবই কাতর এবং দুঃখী একটা ভাব ফুটিয়ে তুলে মারাফত বলল-
: স্যার, পায়ে সমস্যা...
ডাক্তার সাহেব প্রেসক্রিপশন লিখে মারাফতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাতের ইশারায় পরবর্তীজনকে নিকটবর্তী হওয়ার নির্দেশ দিলেন। প্রেসক্রিপশন নিয়ে মারাফত দরজার সামনে টুলের ওপর নবাবী স্টাইলে বসে থাকা পিয়নের শরণাপন্ন হয়ে বলল-
: দেখেন তো ভাই, কী লেখছে; কিছুই বুঝতেছি না!
: আপনেরে আট নম্বর রুমে যাইতে বলছে।
আট নম্বর রুমে যাওয়ার পর সেখানে দায়িত্ব পালনরত একজনের হাতে প্রেসক্রিপশন দিতেই মারাফতের উদ্দেশে তিনি বললেন-
: শুইয়া পড়েন; আপনের পায়ে প্লাস্টার করতে হবে।
চোখ কপালে তুলে মারাফত বলল-
: এইসবের মানে কী! আমার ঠ্যাং ভাঙ্গেও নাই, মচকায়ও নাই; প্লাস্টার করন লাগব কিজন্য?
: ডাক্তার লেখছে।
: প্রেসক্রিপশনটা দেন তো; জিজ্ঞাসা কইরা আসি ভুলে লেইখা ফেলল কিনা!
পুনরায় ডাক্তার মহোদয়ের রুমে ঢোকার জন্য দরজার সামনে দাঁড়াতেই পিয়ন বলল-
: স্যার নাই; বাইরে গেছেন।
কাতর স্বরে মারফত বলল-
: আমারে শুয়াইয়া দিয়া আপনের স্যার বাইরে চইলা গেলেন; এইটা কী রকম কারবার হইল! উনি কখন ফিরবেন?
: ফিরতে দেরি হবে।
: কত দেরি?
পিয়ন কোনো কথা বলছে না দেখে মারাফত পুনরায় বলল-
: বললেন না; কতক্ষণ ওয়েট করন লাগব?

পিয়ন কাচুমাচু করছিল। এসময় করিডোর দিয়ে ফ্লাস্ক হাতে একজন চা বিক্রেতা যাচ্ছিল। মারাফত তাকে ডেকে এনে দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিল। চা শেষ হওয়ার পর পানের অর্ডার দিয়ে মারাফত পিয়নের কাছে জানতে চাইল-


: ভাই, পানে আপনে কোন জর্দা খান?
পছন্দের জর্দা দিয়ে বানানো পান মুখে তোলার পর পিয়ন নিজে থেকেই মারাফতের উদ্দেশে বলল-
: বাইরের একটা ক্লিনিক থেকে জরুরি ‘কল’ আসছে। স্যার সেখানে গেছেন।
: খ্যাপ মারতে আউটিং হইছেন?
: হু।
: এইরকম প্রায়ই যান নাকি?
: আবার জিগায়! শুধু ক্লিনিক নয়, রুটিন অনুযায়ী আশপাশের হাট-বাজারেও স্যার রোগী দেখতে যান।
: তাইলে হাসপাতালে আসেন কখন?
: ফাঁকেফুকে আসেন।
: কয়েকদিন আগে দুর্নীতি দমন কমিশন যেসব হাসপাতালে অভিযান পরিচালনা করছিল, তার মধ্যে কি এই হাসপাতালও ছিল।
: ছিল।
: দুর্নীতি দমন কমিশনের টিম আপনের স্যারকে হাসপাতালে ‘ইন’ পাইছে; নাকি ‘আউট’ পাইছে?
: স্যার ওইদিন আগেভাগেই হাসপাতালে উপস্থিত হইছিলেন।
: খবর পাইয়া গেছিলেন নাকি?
: হু।
: কে খবর দিল! জিনে?
জিনের কথা শুনে পিয়ন হেসে ফেলল। বলল-
: না, না; জিন-ফিন না। দুর্নীতি দমন কমিশনে স্যারের এক আত্মীয় আছেন। তিনিই অভিযানের তথ্যটা সরবরাহ করছিলেন। স্যারের সুবিধা হইল- শুধু দুর্নীতি দমন কমিশন না; সবখানেই ওনার লাইন-ঘাট পাকা। পলিটিক্স করেন তো, এইজন্য।
মারাফত হেসে বলল-
: মনে হইতেছে, আপনের স্যারের উন্নয়ন এই দেশে কেউ ঠেকাইতে পারবে না; রকেটের গতিতে উন্নয়ন হবে।
পিয়ন বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল-
: উন্নয়নের জন্যই তো এত কষ্ট কইরা ডাক্তারি শিখছেন...

মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

এ সম্পর্কিত আরও খবর