সামাজিক পুঁজি ও রাষ্ট্রের সুখ-অসুখ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

শুভ কিবরিয়া | 2023-09-01 04:10:37

একসময় ‘সামাজিক পুঁজি’ কথাটা বেশ শোনা যেতো। আজকাল আর তেমন আলোচিত হয় না। ‘সামাজিক পুঁজি’ নির্ভর করে মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাস আর আস্থার ওপর। রাষ্ট্রের সুখও সামাজিক পুঁজির বাড়া-কমার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সামাজিক পুঁজির ঘাটতি যত বড় হবে রাষ্ট্রের অসুখও তত বাড়বে।

আজকাল ‘উন্নয়ন’ নিয়ে চারপাশে এতো আলোচনা বেড়েছে যে ‘উন্নয়ন’ দিয়েই সব আলোচনা গিলে খাবার ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। উন্নয়ন নিজেও যে সামাজিক পুঁজির ওপর নির্র্ভরশীল সেই কথাটা কর্তাব্যক্তিরা খুব একটা তুলতে চান না। কেননা, সামাজিক পুঁজি না বাড়লে একার বিত্ত দিয়ে সবার সুখ হরণের রাষ্ট্রীয় নীতি চালু হয়। তখন রাষ্ট্র নিজেই সুখ হন্তারক হয়ে ওঠে। আবার টেকসই উন্নয়ন বলতে আমরা যা বুঝি সেটাও নির্ভর করে উন্নয়ন দিয়ে সামাজিক পুঁজির চেহারাটা কতটা মোটা হচ্ছে তার ওপর।

কার জন্য ‘উন্নয়ন’, উন্নয়নের সুফল কার ঘরে যাচ্ছে, উন্নয়ন চেষ্টার ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমছে কি না-এই প্রশ্নগুলোর গোঁজামিল উত্তর অব্যাহত থাকলে সামাজিক পুঁজি কখনই বাড়বে না। সামাজিক পুঁজি না বাড়লে রাষ্ট্রের অসুখও কমবে না। সামাজিক পুঁজির ঘাটতি থাকলে উন্নয়নের চাপে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রণ যারা করেন তাদের কতিপয়ের স্বাস্থ্য হয়তো মোটা-তাজা দেখাবে কিন্তু গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার শীর্ণ চেহারা কোনোদিনই শ্রী ফিরে পাবে না।

এখন সামাজিক পুঁজি নিয়ে যে সংকট তা কি কেবল হাল আমলেরই প্রশ্ন? নাকি, বাংলাদেশের অতীত রাজনৈতিক ইতিহাসেও এরকম প্রশ্ন দেখা গিয়েছিল। এসব নিয়ে একাডেমিক কিংবা গবেষণাগত আলোচনা যে খুব একটা হয়েছে তা বলা যাবে না। তবে সাবেক আমলা ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আকবর আলী খান এ নিয়ে কিছু লেখালেখি করেছেন। সামাজিক পুঁজি সম্পর্কে অধ্যাপক আকবর আলী খান তাঁর ‘আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি’ বইয়ে লিখেছেন, ‘‘মানুষ একে অপরকে যত বিশ্বাস করবে সামাজিক পুঁজি তত বাড়বে। গুণগত ঐতিহাসিক তথ্য ও সমকালিন পরিমাণগত উপাত্ত এ ধারণাকে সমর্থন করে। সামাজিক পুঁজির অপ্রতুলতার ফলেই বাংলাদেশ অঞ্চলে বৃহৎ সাম্রাজ্য খুব অল্প ক্ষেত্রেই টেকসই হয়েছে। অধিকাংশ সময়েই খণ্ডরাজ্য ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক নিয়তি। নাথ, রাত, খড়গ, চন্দ্র, বর্মণ, পট্টিকেরা ও ভদ্র বংশের মতো ছোটো রাজ্যগুলিই বারবার বাংলাদেশের মাটিতে বুনোফুলের মতো ফুটেছে ও ঝরে পড়েছে। বাংলায় বারবার মাৎস্যন্যায়ের মতো রাজনৈতিক অস্থিশিীলতা দেখা দিয়েছে। মোগল ঐতিহাসিক আবুল ফজল বাংলাকে‘ বুলঘখানা’ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘর বলে আখ্যায়িত করেছেন। এসবের পেছনে রয়েছে সামাজিক পুঁজির ঘাটতি।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনো বাংলাদেশের মানুষের পারস্পরিক আস্থা কম। ১৯৯৯-২০০১ সময়কালে পরিচালিত একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের মাত্র ২৩.৫ শতাংশ মানুষ একে অপরকে বিশ্বাস করে। অর্থাৎ ৭৬.৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে এ ধরণের আস্থা নেই। বিশ্বের ৮০ টি দেশের গড় হারের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ কম।’’

০২.
রাষ্ট্রের সুখ ও অসুখ নিয়ে আলোচনাটা এসে গেলো এই কারণে যে, সম্প্রতি জাতিসংঘের ছোয়া পাওয়া গবেষণা সংস্থা সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট সলিউশন নেটওয়ার্ক ২০১৮ সালের ‘বিশ্ব সুখি প্রতিবেদন’ প্রকাশ করেছে। সেখানে ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫। ভারত ১৩০, মিয়ানমার ১৩৩, শ্রীলঙ্কা ১১৬ নম্বরে রয়েছে। এ অঞ্চলে প্রতিবেশী ভুটান ৯৭ নম্বরে ও পাকিস্তান ৭৫ নম্বরে রয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশগুলোর এক নম্বরে রয়েছে ফিনল্যান্ড। এই প্রতিবেদন অনুসারে, সবচেয়ে সুখী প্রথম পাঁচটি দেশ হচ্ছে যথাক্রমে-ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ড।

এই প্রতিবেদনে সুখ পরিমাপের মানদণ্ড হিসাবে ধরা হয়েছে ছয়টি বিষয়কে- উপার্জন, সুস্থ্য আয়ুষ্কাল, সামাজিক নির্ভরশীলতা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, অপরের ওপর আস্থা ও উদারতা। উপার্জন বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন সুখী হবার ছয় উপায়ের কেবল একটি। বাকি গুলির প্রায় প্রতিটিই সামাজিক পুঁজির সাথে সম্পর্কিত। রাষ্ট্র জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা কতটা সুরক্ষিত করতে পারছে তার ওপরও নির্ভর করছে রাষ্ট্রের সুখের বিষয়টি।

বাংলাদেশের এই ‘সুখী’ হবার প্রবণতার ট্রাক রেকর্ডই বা কী? তথ্য বলছে বাংলাদেশের মানুষের সুখাবস্থা দিন দিনই কমছে। ২০১৩ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৮ নম্বরে। ২০১৫ সালে তা দাঁড়ায় ১০৯ নম্বরে। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে তা দাঁড়ায় ১১০ নম্বরে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫ নম্বর। বোঝা যায় ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের মানুষ অসুখী হয়ে পড়ছে। তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য খারাপের দিকেই চলেছে। তার অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য ভালো হবার কথা দাবি করা হলেও তাঁর সামাজিক সহনশীলতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যক্তিস্বাধীনতার সুযোগ দিনকে দিন কমছে। তার সামাজিক পুঁজির চেহার ক্রমশ মলিন হয়েই উঠছে।

০৩.
এই তথ্য কিছুটা হতাশার জন্ম দেয় বৈকি? কিন্তু আকবর আলি খান ইতিহাসের পাঠ নিয়ে আশাবাদী ভবিষ্যতের দিকে চোখ রাখতে আমাদের প্রলুব্ধ করছেন। আকবর আলী খানের গবেষণা বলছে, ‘‘পারষ্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ রাজনীতি ও অর্থনীতিতে একটি শুভচক্রের জন্ম দেয়। আস্থার সুফল আরও আস্থার সৃষ্টি করে। প্রশ্ন হলো, দীর্ঘদিন ধরে সযত্নে লালিত অবিশ্বাস ও অনাস্থা কি সহজে অতিক্রম করা সম্ভব হবে? হয়তো সবটুকু করা যাবে না। তবু আশার আলো যে একেবারে নেই তা বলা যাবে না।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন যে মানুষ বারবার ভুল করতে করতে ঠেকে শেখে। এরকম ঠেকে শেখার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসেও ঘটেছে। পাল রাজবংশের উদ্ভবের আগে প্রায় ৫০ বছর ধরে রাজনৈতিক নৈরাজ্য বিরাজ করে। প্রাচীন ভারতে নৈরাজ্যকে মাৎস্যন্যায় বা মাছের মতো অবস্থা বলে বর্ণনা করা হতো। মাছের ভূবনে বড় মাছ যেমন ছোট মাছ গ্রাস করে, তেমনি অরাজক পরিস্থিতিতে দুর্বল জনগোষ্ঠী বড় লোকদের শিকার হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রজারা বা প্রকৃতিপুঞ্জ গোপালকে রাজা নির্বাচন করে। খালিমপুর তার শাসনে তাই লেখা হয়েছে:‘তারপরে ছিলেন গোপাল। তিনি সমস্ত রাজাদের মাথার মণির মতো ছিলেন। মাৎস্যন্যায় অর্থাৎ অরাজকতা দূর করার জন্য প্রজারা তাকে রাজা নির্বাচন করেছিলেন।’

বাংলার ইতিহাসে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঐক্য অনেকদিন টিকেছে। আবার অনেক সময় ঐক্য অতি অল্প সময়ে উবে গেছে। তবে পালরা প্রায় ৪০০ বছর রাজত্ব করেছে। এই রাজনৈতিক ঐক্যই সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। তার কারণ, পালরা ছিল পরমতসহিষ্ণু ও উদার। তাই বৌদ্ধ হয়েও পালদের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সমর্থন শতাব্দীর পর শতাব্দী অটুট রাখা সম্ভব হয়েছে। পালদের ইতিহাস প্রমাণ করে যে শুধু নির্বাচনই যথেষ্ট নয়; উদারনৈতিক মূল্যবোধ ছাড়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা টেকসই হয় না।’’

এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় এই ২০১৯ সালে দাঁড়িয়ে, আমরা আমাদের অতীত থেকে কিছু কি শিখছি? ভবিষ্যতেও কি অতীতের ভুলগুলো ঘটাতে থাকবো? দার্শনিক জর্জ সান্তায়ানা বলেছিলেন, ‘ইতিহাস থেকে যারা শেখে না তারা একই ভুল বারবার করতে থাকে।’

০৪.
মানুষের লোভ বাড়ছে। বিবেক কমছে। মনুষ্যত্বকে মানুষ অবজ্ঞা করছে। সামাজিক পুঁজি সেই বিবেচনাতেও মার খাচ্ছে। গুটিকতক মানুষ ক্ষুদ্র ব্যক্তি বা দলগতস্বার্থ বিবেচনায় ক্ষমতান্ধ হয়ে গণতন্ত্রকে মূল্যবোধহীন করে কর্তৃত্ববাদকেও আশীর্বাদ ভাবছে। রাজনীতি ও অর্থনীতিও সেই মানদণ্ডে এগুতে চাইছে দুনিয়াব্যাপীই। তাতে মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়ছে, পারস্পরিক অনাস্থা বাড়ছে। সামাজিক সম্পর্কগুলোও অবিশ্বাস আর কেনাবেচার মাপকাঠিতে বিবেচ্য হয়ে পড়ছে। তাতে সামাজিক পুঁজি ঘনীভূত হবার সকল সম্ভাবনা দূরীভূত হচ্ছে। এই বিপদ রবীন্দ্রনাথকেও ভাবিয়ে তুলেছিল। বহু বছর আগে তিনি লিখেছিলেন, ‘এখন মানুষ আপনার সকল জিনিসেরই মূল্যের পরিমাণ টাকা দিয়ে বিচার করতে লজ্জা করে না। এতে করে মানুষের প্রকৃতির বদল হয়ে আসছে-জীবনের লক্ষ্য এবং গৌরব, অন্তর থেকে বাইরের দিকে, আনন্দ থেকে প্রয়োজনের দিকে অত্যন্ত ঝুঁকে পড়ছে। মানুষ ক্রমাগত নিজেকে বিক্রি করতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করছে না। ক্রমশই সমাজের এমন একটা বদল হয়ে আসছে যে, টাকাই মানুষের যোগ্যতা রুপে প্রকাশ পাচ্ছে। অথচ, এটা কেবল দায়ে পড়ে ঘটছে, প্রকৃতপক্ষে এটা সত্য নয়। তাই, এক সময়ে যে-মানুষ মনুষ্যত্বের খাতিরে টাকাকে অবজ্ঞা করতে জানত এখন সে টাকার খাতিরে মনুষ্যত্বকে অবজ্ঞা করছে। রাজ্যতন্ত্রে, সমাজতন্ত্রে, ঘরে বাইরে, সর্বত্রই তার পরিচয় কুৎসিত হয়ে উঠছে। কিন্তু, বিভৎসতাকে দেখতে পাচ্ছি নে, কেননা, লোভে দুই চোখ আচ্ছন্ন।’

০৫.
আমরা রাষ্ট্রের সুখ ও অসুখ নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম। বলতে চেয়েছিলাম সামাজিক পুঁজির ঘাটতি হলে রাষ্ট্রের সুখ কমে যায় বেড়ে যায় অসুখ। রাষ্ট্রের অসুখ বাড়ুক তা আমাদের কাম্য নয়। আমরা সুখি হতে চাই। সকলে মিলেই সুখি হতে চাই।
নাসিরুদ্দীন হোজ্জার একটা পুরনো গল্প দিয়েই লেখাটা শেষ করতে চাই।

একদিন বাদশাহ হোজ্জাকে জিজ্ঞেস করলেন,-‘হোজ্জা, যদি তোমার সামনে দুটো জিনিস রাখা হয়-একটি হল স্বর্ণমুদ্রা আর একটি হলো ন্যায়। তাহলে তুমি কোনটা বেছে নেবে?’
-‘আমি স্বর্ণমুদ্রা বেছে নেব।’ হোজ্জা উত্তর দিল।

বাদশাহ বললেন,-‘ কেন হোজ্জা? আমি হলে স্বর্ণমুদ্রা না নিয়ে ন্যায় বেছে নিতাম। স্বর্ণমুদ্রাতে এমন কি আছে? ন্যায় খুঁজে পাওয়া সহজসাধ্য নয় জান?’
হোজ্জা বলল,-‘জানি জাঁহাপনা। যার যেটা অভাব সে সেটাই চায়। আপনার যেটা অভাব সেটাই আপনি বেছে নিতে চাইছেন।’

শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর