বিষাক্ত পানি ও ভেজাল মানুষের ভেজাল খাবার

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান | 2023-08-31 22:20:26

অনুমোদন নিয়ে প্লাস্টিক বোতল ও জারের মাধ্যমে পানের অনুপযোগী, মানহীন ও বিষাক্ত পানি সরবরাহ করায় সরকারের ব্যর্থতা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে গত ২১ জানুয়ারি ২০১৯ রুল জারি করেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। অনুমোদিত পাঁচটি কোম্পানির বিরুদ্ধে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই)। ভেজাল মানুষের ভেজাল খাবার ও বিষাক্ত পানি নির্বিচারে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সবচেয়ে কষ্টকর, হতাশাজনক ও বেদনার বিষয় হলো প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জন্য বিক্রেতাগণ নির্ভেজাল খাবার বিপননে যতটা সচেতন, সমাজের অন্য শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য ঠিক তার উল্টো।

একটা সুস্থ-মস্তিষ্কের মানুষ কি অবলীলায় অন্য মানুষের খাবারের সাথে ঠাণ্ডা মাথায় বিষ মেশায়। মাদক ব্যবসায়ী ও খাবারে ভেজাল কিংবা পানিতে বিষ মোশানো মানুষের সাথে কোনো পার্থক্য আছে কি?

দুই.
ছোটবেলায় বিলের ধানের কালো রঙের চালের দুধমাখা ভাত কিংবা সকালবেলায় টাটকা মাছের ঝোল আর গরম ভাত খাওয়ার সেই স্বাদ আজ খুব মনে পড়ে। পেয়াজ-মরিচ, ঘানি ভাঙানো সরিষার তেল কিংবা খেঁজুরের নলেন গুড়ের সাথে পান্থা ভাত খাওয়ার সেই অপুর্ব স্বাদ যেন দিবা স্বপ্নে পরিণত হয়েছে আজ। চিড়ার সাথে খেঁজুরের নলেন গুড় আর কানাইবাঁসি কলা যারা খেয়েছে শুধু তারাই মনে করতে পারবে কি অসাধারণ স্বাদ ছিল সেসব খাবারের। সারাদিন পেয়ারা গাছে ঝুলে ঝুলে কাঁচা, আধা পাকা পেয়ারায় যে অপূর্ব স্বাদ ছিল, আজ তা আর নেই। কাঠবিড়ালি কিংবা বাদুড়ের খেয়ে রেখে যাওয়া ফলগুলো খাব কি খাব না তা কতবারই না ভাবতাম। আর আজ! কত বিষই না খেয়ে ফেলি নিজের অজান্তে। সারাদিন পরিশ্রম করে বাসায় ফেরার সময় মা-বাবা কত ভালবাসা আর স্নেহ-মমতায় মাখা কিছু খাবার কিনে এনে সন্তানদের মুখে তুলে দেন। কিন্তু তারা জানেনও না যে এই খাবারে কোনো বিষ লুকিয়ে আছে। খাবারগুলোতে যারা বিষ মিশিয়েছে তারাও মানুষ! তারা বিশ্বাস করে যে এই খাবার আমজনতা খাবে, তাদের সন্তান তো আর খাবে না। অথচ তারা জানে না ঘুরে-ফিরে এই খাবার তাদের সন্তানও খায়। মানুষের মুখে মানুষই বিষ তুলে দিচ্ছে। ভাবতেও কি বিস্ময় বোধ হয়!

তিন.
শহরের পাশাপাশি আজ গ্রামের অবস্থা আরও বেশি ভয়াবহ। সবচেয়ে বেশি বিষ মেশানো হয় শিশুর জন্য তৈরি খাবারে। কত রঙ-বেরঙের নকল এবং বিষাক্ত খাবারে ভরপুর গ্রামের বাজার, পাড়ার দোকানগুলো। গ্রামের মানুষ কেমিক্যাল কিংবা কোম্পানির আসল-নকল ‘ব্রান্ড’ সম্পর্কে ততটা অবগত নন। বোতল ভর্তি রঙের পানি, তাও আবার যে রঙ কাপড়ে মিশানো হয়। যেটা যত বেশি বাহারি রঙের সেটির বাজার কাটতি তত বেশি। শিশুরা পছন্দও করে বেশি। কে দেখবে এগুলো? গ্রামের দোকানিগণও অতশত বোঝেন না। তারা আবার লাভের ব্যাপারটা আগে দেখেন। নকল কোম্পানির পণ্য সামগ্রী বিক্রিতে মুনাফা বেশি। অধিকাংশ খাদ্য বা ভোগ্য পণ্যই গ্রামের বাজারগুলোতে নকল। শহরে হয়তোবা ভ্রাম্যমান আদালত আছে, শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ আছে। কিন্তু গ্রামের বাজারগুলোতে কি হবে? কে দেখবে বিষাক্ত বাহারি খাবারের ছড়াছড়ির বিষয়টি? বড় বড় ব্রান্ডের কোম্পানির নকল পণ্য অলি-গলিতে তৈরি হয়। বাহারি সিল আর অবিকল মোড়কজাত করে ছড়িয়ে পড়ছে হাট-বাজার থেকে ঘরে। সকালবেলা শিশু ঘুম থেকে জেগে বিষাক্ত খাবার দিয়ে দিন শুরু করছে।

চার.
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে ভয়ঙ্কর সব তথ্য উঠে এসেছে। তারপরও থামেনি বিষ দিয়ে নিরবে মানুষ মারার নির্বিচার এই হত্যাযজ্ঞ। ভেজাল মানুষের তৈরি বিষাক্ত খাবার খেয়ে আমরা নিজেদেরকে ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। নতুন প্রজন্মকে মেধাহীন পঙ্গু জীবনের মতো এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। ফল, সুস্বাদু মাছ, মজাদার খাবার ফরমালিন, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, লেড, ইকোলাই, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, পোড়া মবিল, রং, সোডিয়াম কার্বাইড, ইথাইলিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, হাইড্রোজ, ডিডিটি, প্রভৃতি ভয়ঙ্কর বিষ দিয়ে মেশানো। সরিষার তেলে কেমিক্যাল, মুরগির খাবারে ট্যানারির বর্জ্য, সোডিয়াম কার্বাইড যা মূলত ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে। কাঁচা আম, কাঁঠাল, লিচু, কলায় বেশি ব্যবহার হয় কার্বাইড নামক রাসায়নিক পদার্থ। সিরিঞ্জ দিয়ে তরমুজের ভেতরে প্রবেশ করানো হয় তরল পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট। ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয় কলা, মাছে ফরমালিন, অপরিপক্ক আনারস, টমেটোতে হরমোন, পচনরোধে বিষাক্ত ফরমালিন, তাজা দেখাতে মাছে রেড অক্সাইড, ফলমূল ও শাকসব্জিতে কার্বাইড। সাধারণত কাঁচা কলাকে ইথাইলিন গ্যাস দ্বারা পাকানো হয়। কাঁচা মৌসুমী ফল, যেমন- আম, কলা, পেঁপে, নাশপাতি, কুল ও আপেলে মোশানো হয় ক্যালসিয়াম কার্বাইড। মাছে ও দুধে ফরমালিন, ফলমূলে কার্বাইডসহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল, সবজিতে রাসায়নিক কীটনাশক, জিলাপি-চানাচুরে পোড়া মবিল, বিস্কুট, আইসক্রিম, কোল্ডড্রিংক্স, জুস, সেমাই, আচার, নুডুলস এবং মিষ্টিতে টেক্সটাইল ও লেদার শিল্পে ব্যবহৃত রং, মুড়িতে ইউরিয়া-হাইড্রোজ। এমনকি বিষাক্ত পানি কোনো প্রকার পরীক্ষা ছাড়াই বোতলজাত করে ছেড়ে দিচ্ছে বাজারে। খাবারে ফরমালিন, বস্ত্রকলের বিষাক্ত রং এবং ইউরিয়া সার মেশানো হয় যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পেয়ারা, আনারস, জাম, জামরুল, তরমুজ, বাঙ্গি, আঙ্গুর, নাশপাতিসহ দেশি-বিদেশি প্রায় সব ফলে বিষাক্ত কেমিক্যাল। ফলমূলের উজ্জ্বল রং মানুষকে আকৃষ্ট করে। অন্য মৌসুমে বেশি দামে বিক্রি করা ও নষ্ট হবার হাত থেকে রক্ষা করে মুনাফালাভই এর মুল উদ্দেশ্য।

পাঁচ.
ভেজাল কিংবা বিষাক্ত খাবার গ্রহণের ক্ষতির দিক মানুষের জানা। ক্যান্সার, হাঁপানি, চর্মরোগ, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, তাৎক্ষণিক মৃত্যু, পাকস্থলীতে প্রদাহ, লিভারের সংক্রমন, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, তীব্র মাথা ব্যাথা, ঘূর্ণি রোগ, প্রলাপ, মেজাজ খিটখিটে, স্মরণশক্তি লোপ, ত্বক, মূত্রথলি এবং ফুসফুসে ক্যান্সার হতে পারে। ফরমালিন ও অন্যান্য কেমিক্যাল সামগ্রী সব বয়সী মানুষের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা দিন দিন কমছে। বয়স্ক লোকেরাও এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা ও গর্ভের সন্তানের ক্ষেত্রেও মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। সন্তান প্রসবে জটিলতা, শিশুর জন্মগত দোষ-ত্রুটিসহ আশঙ্কাজনকহারে প্রতিবন্ধী এবং বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে।

মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রবণতা বেড়ে গেছে। আধুনিক সমাজে মানুষের রোগের নামও অত্যাধুনিক। অটিজম, প্রতিবন্ধীত্ব, হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বেড়ে চলেছে। মানুষই মানুষের খাবারে বিষ মেশায়। এর চেয়ে হতাশাজনক আর কি ই বা হতে পারে? সবাই জানে ও বোঝে কিন্তু উপায় কি? কি করে এই ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব? আমাদের ভবিষ্যৎ কি? ভব্যিষৎ কি অনাগত প্রজন্মের? এতদিনের প্রবাস জীবনে একটা প্রতিবন্ধী শিশু দেখিনি। কতই না ভাল লাগে ভাবলে। চোখ বন্ধ করে সবাই খাবার খায়। কারো মনে সন্দেহ নেই কোনো। কিছু মানুষ বিষ মেশায়, আর অনেক মানুষ সেই বিষ খাবারের সাথে খায়। শহরের পাশাপাশি গ্রামের খাবারগুলোর স্বাস্থ্যসম্মত মানও ধরে রাখা দরকার। এখনি সময় এসব থামানোর।

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান: পিএইচডি গবেষক, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর