রাজনীতি কি তবে নির্বাসনে যাচ্ছে?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-23 20:24:22

বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে তারা আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ এই সরকারের অধীনে কোনো প্রকার নির্বাচনে যাবে না। এমতাবস্থায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উপ-নির্বাচনসহ সব নির্বাচনে সরকার মনোনীত প্রার্থীরা একপ্রকারের ওয়াকওভার পেতে যাচ্ছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। অবশ্য মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী দলটি জোট থেকে বের হয়ে সত্যিকারের বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাওয়ার প্রয়াসে এবারে তারা সরকারের মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তবে এই সিদ্ধান্তে জাতীয় পার্টির অনেক সাংসদ ক্ষুব্ধ হলেও তারা এখন পর্যন্ত মুখ খুলছেন না প্রকাশ্যে। সম্ভবত এই যুক্তি এবং মানবিক বিবেচনায় যে, দলটির চেয়ারম্যান ভীষণ অসুস্থ এবং ইতোমধ্যে চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় পার্টিতে একটা বড় ধাক্কা আসতে যাচ্ছে সেটা প্রায় নিশ্চিত।

এই ধাক্কার মূলত দুটি কারণ- এক. এরশাদের শারীরিক অসুস্থতা ও অনুপস্থিতি এবং দুই. দলের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি জিএম কাদেরের সঙ্গে বেগম রওশন এরশাদের মধ্যকার নেতৃত্বজনিত দ্বন্দ্ব। সুতরাং এমন বিবেচনায় জাতীয় পার্টির বর্তমান ২২ জন সাংসদ নিয়ে ভবিষ্যতে দলটি যদি আরও দুই বা ততোধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এই সবকিছু মিলে সরকার সমর্থকরা এটা মনে করে আনন্দ পেতে পারেন যে তাহলে আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনার পথে ভবিষ্যতের জন্য আর কোনো চ্যালেঞ্জই থাকবে না। কিন্তু বিষয়টি কি আসলে তাই!

জাতীয় নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ বদলাচ্ছে। বিএনপি এতদিন তাদের রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তার জন্য জনমানুষের কাছে সমালোচনার মধ্যে পড়লেও তাদের অতীতের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত সাম্প্রতিক নির্বাচনের আলোকে যথার্থ ছিল বলে এক ধরণের জনসমর্থন পেতে শুরু হয়েছে। যদিও বিএনপির উপজেলা নির্বাচনসহ সকল নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তের জবাবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, তারা না এলে তাদের আনার জন্য কোনো চেষ্টা করা হবে না। আমরা ধরে নিলাম তারা (বিএনপি) নির্বাচনে এলো না এবং নির্বাচন হয়ে গেল। ফলাফলটা কি হবে সেটাও আমরা অনুমান করতে পারছি। এমন একটা পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ্যে আগামী ৫ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করা কতটুকু স্বস্তিদায়ক এবং সহায়ক হবে সেটা নিয়ে কিন্তু যথেষ্ট প্রশ্ন থেকে যায়।

এক.
দশম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিসহ অপরাপর বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মাঠ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিলেও সরকার নিরবিচ্ছিন্নভাবে ৫ বছর রাষ্ট্র পরিচালনায় তেমন কোনো বাধার সম্মুখিন হয়নি মূলত এই বিবেচনায় যে সরকারকে একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হয়েছে। তখন বিএনপি নির্বাচনে না থেকে এবং পরবর্তীতে তাদের যৌক্তিক আন্দোলন পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়ে বাধ্য হয়ে এবারের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল এই যুক্তিতে যে তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা জনিত কারণে তারা বাস্তবিক অর্থে ক্ষমতাসীন হবে এমনটা কখনও তাদের বিশ্বাস ছিলো না, বরং তারা এটা প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে তারা এতদিন ধরে যা বলতে চেয়েছে তার পেছনে অনেক যুক্তি রয়েছে। নির্বাচনোত্তর প্রায় একমাসের পরিস্থিতি বিশ্লেষণে আমি মনে করি তারা সেটা করতে কিছুটা হলেও সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা যদি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে অটল থাকে তবে সেই কারণে জনমত তাদের বিপক্ষে থাকবে সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ফলে অর্থ যা দাঁড়াল তা হচ্ছে, সরকার দলীয় প্রার্থীরা ব্যাপকভাবে বিজয়ী হলো। কিন্তু তারপর?

দুই.
বিএনপি এই নির্বাচনে না এলে তাদের সাংগঠনিক শক্তি আরও বেশি মুখ থুবড়ে পড়বে। তার পরও তাদের নির্বাচনে না আশার সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। আর নির্বাচনে এসেও যে তারা খুব একটা ভালো করতে পারবে সেটা মনে করার কোনো কারণ নেই। দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচন থেকে দূরে থাকলে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে প্রণোদনা পান না এটা যেমন সত্য, অপরদিকে নির্বাচনের ফলাফল যদি আগে থেকেই অনুমেয় থাকে তবে সেই নির্বাচনে যাবার কি কোনো অর্থ থাকতে পারে?

তিন.
একদিকে সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে না এলে তাদের কিছু করার নেই। তাদের ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অপরদিকে সরকারের পক্ষ থেকে আবারও ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে নির্বাচনোত্তর মতবিনিময়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যা থেকে বুঝা যায়, সরকার ঐক্যফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোকে নির্বাচনে আনার চেষ্টা করছে, নিদেনপক্ষে তাদের দিক থেকে হয়ত এমন চেষ্টা থাকবে যে বিএনপি না এলেও ঐক্যফ্রন্টের অপরাপর দলগুলোকে তারা নির্বাচনে এনে এই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়া।

চার.
সদ্যসমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া সরকারের জন্য যেমন জরুরি ছিল, নির্বাচনোত্তর সময়ে অপরাপর নির্বাচনগুলোতে তাদের অনুপস্থিতি তেমনি নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দেবে সন্দেহ নেই। আমরা যদি একটু পেছন ফিরে দেখি, তবে নিশ্চয়ই দেখতে পাব যে; দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জন করার পর বিএনপিসহ অপরাপর দলের প্রতি ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষিতে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে অংশ নেয় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার একটা ক্ষেত্র তৈরি করে। এই নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের পক্ষে গেলে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি এবার আগের মতো দৈন্যতায় পতিত হয়নি। তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে আগের মতোই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে।

পাঁচ.
দল হিসেবে বিএনপির পুণরুত্থানের সমস্যার অন্তরালের কারণগুলো কি, তা মোটামুটিভাবে সবারই জানা। এসব সংকট কাটিয়ে রাতারাতি তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। ফলতঃ যা দাঁড়াচ্ছে তা হচ্ছে, একতরফাভাবে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের অবাধ বিচরণের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হতে যাচ্ছে আসন্ন উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। সাড়ে চার শতাধিক উপজেলা নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত হবে প্রায় সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। উপজেলা নির্বাচনে যে কারণে তারা অংশ নেবে না ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও সেই একই কারণ বিদ্যমান থাকার অর্থ দাঁড়াচ্ছে সেখানেও তারা অংশ নেবে না, অর্থাৎ ধীরে ধীরে স্থানীয় সরকারের সব স্তরে কেবল আওয়ামী লীগ (এবং নামমাত্র ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির)-এর দাপট থেকে দেশে রাজনৈতিক চর্চার অভাব প্রবলভাবে অনুভূত হবে।

ছয়.
রাজনীতির মাঠে রাজনৈতিক দলগুলোর মিথস্ক্রিয়ার এই অভাব থেকে দেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে চলবে প্রবল আধিপত্যবাদের লড়াই। দলের ভেতর এই লড়াইয়ের নেতিবাচক প্রভাব হয়ত তেমন একটা চোখে পরবে না দল যতদিন ক্ষমতায় থাকবে ততদিন। কিন্তু ধীরে ধীরে একদলীয় রাজনীতি আমাদের জাতীয় জীবনে যে কি ধরণের বহুমাত্রিক সংকট তৈরি করতে পারে তার নজির আমরা কিন্তু অতীতে দেখেছি। আমাদের সমস্যা হচ্ছে- দলগুলো যতক্ষণ ক্ষমতাসীন থাকে ততক্ষণ সেগুলো বুঝতে চায় না।

দেশের আজ অনেক উন্নতি হয়েছে এবং ক্রমেই আরও উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে সন্দেহ নেই। এই অবস্থায় আমাদের সামনে একটি বিরাট প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এই ক্রমবর্ধমান উন্নতির ক্ষেত্রে বিরাজনীতিকে উৎসাহ দেব, নাকি রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়াকে প্রাধান্য দেব; সেটাও এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেননা এভাবে চলতে থাকলে কিন্তু একসময় রাজনীতি আমাদের কাছ থেকে নির্বাসিত হয়ে যাবে। সকল দলই এই বাস্তবতার নিরিখে সহনশীল রাজনীতির চর্চা করবে- এটাই প্রত্যাশিত।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও খবর