দুর্নীতির মহাসমুদ্রের চুনোপুটি ও রাঘব-বোয়াল

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

আসাদুজ্জামান কাজল | 2023-08-27 13:36:20

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে ২১টি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ ও ’তারুণ্যের শক্তি-বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’র পরেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল দুর্নীতির ওপর। গত ৩০ ডিসেম্বর বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর থেকেই দুর্নীতি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার বার হুশিয়ারি দিয়ে আসছেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ এই হুশিয়ারি থেকে বাদ যায়নি তার দলের সংসদ সদস্য ও মন্ত্রিসভার সদস্যরাও। আমরা ইতোমধ্যে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমও লক্ষ্য করেছি। দুদক বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শনে যাচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।  দল-মত নির্বিশেষে এ দেশের সবাই এই বিষয়ে একমত যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণকে একবার যে কথা দেন তিনি সেটা বাস্তবায়ন করেন। তাই দুর্নীতির বিষয়ে তিনি যে পদক্ষেপ নেবেন সেটা সবারই প্রত্যাশা ছিল এবং আমরা ইতিমধ্যে সেটা লক্ষ্য করছি।

জঙ্গী ও মাদক বিরোধী অভিযান সফল করা সম্ভব হয়েছে বর্তমান সরকারের পক্ষেই। তাই, প্রধানমন্ত্রী মন থেকে চাইলে জঙ্গীবাদের মত দুর্নীতিও নিমূল করা সম্ভব বলেই জনগণ মনে করে। যদিও সমালোচনা রয়েছে- মাদকের সাথে জড়িত রাঘব-বোয়ালদের না ধরে এর সাথে জড়িত শুধু চুনো-পুটিদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে।  আমরা প্রত্যশা করি এবার সেটি হবে না। এবার যেই দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকবে তাকেই শাস্তির আওতায় আনা হবে। সে যে দলেরই হোক না কেন এবং যতই শক্তিশালী হোক না কেন।

অনেকেই মনে করেন, যারা চোর ধরবে তারাই যদি চুরি করে তাহলে কী হবে? তাই এই প্রক্রিয়ায় যারা জড়িত তাদের প্রতিও নজর রাখা প্রয়োজন এবং চুনো-পুটিদের পাশাপাশি সত্যিকারের দুর্নীতিবাজদের শাস্তির আওতায় আনা হোক।

সবকিছুকে ঊর্ধ্বে রেখেই যে এবারের অভিযান অব্যাহত থাকবে সেটার অবশ্য কিছু প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে শুল্ক কর্মকর্তা, সোনালী ব্যংকের কর্মকর্তা, ভূমি সার্ভেয়ার এবং দুদকের পরিচালক গ্রেফতার হয়েছে। একই সাথে বুড়িগঙ্গার পাশে অবৈধ উপায়ে নির্মীত আওয়ামী লীগের সাংসদ হাজী সেলিমের বাড়িও গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এবার কেউ বাদ যাচ্ছে না এবং যাবে না বলেই আমরা বিশ্বাস করতে চাই। আর যদি সেটা না হয় তবে এই অভিযান সরকারের জন্য প্রশংসার থেকে বরং নিন্দনীয় হয়ে উঠবে।

দেশে এত উন্নয়নের পরও জনগণ কেন ভিন্ন কিছু চিন্তা করে। অনেকেই মনে করেন, জনগণ বোকা; তারা নিজের ভালো বুঝে না। আসলে কথাটা উল্টো। জনগণ নিজের ভালো বুঝে বলেই ভিন্ন কিছু চিন্তা করে। এত উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামে সাধারণ যেসব জনগণ বসবাস করে তাদের লাভটা কী হয়েছে? হ্যাঁ, তারা বিদ্যুৎ পাচ্ছে, পাঁকা রাস্তা পাচ্ছে, মোবাইলে কথা বলতে পারছে। একই সাথে তো তাদের পাঁকা রাস্তা এক-দুই বছরেই নষ্টও হয়ে যাচ্ছে।

আমার যারা সরকারি সেবা গ্রহণ করি তারা কী পেয়েছি? হাতে গোনা দুই-একটি অফিস ব্যতিত, সরকারি কোনো অফিসে ঘুষ, তদবির ও ভোগান্তি ছাড়া সেবা মিলে না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্জলের সাধারণ মানুষের কাছে দেশের উন্নতি মানে এই যে দেশের সেবার মানের উন্নতি হবে। ভোগান্তি ও ঘুষ ছাড়াই মিলবে সেবা। সবকিছু মিলে তারা ভালো থাকবে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্য আমাদের প্রতিদিনের বিষয়। এই তিন সেক্টোরের কোথায় স্বস্তি রয়েছে? প্রশ্নফাঁস ও লক্ষ লক্ষ জিপিএ-৫ শিক্ষাক্ষেত্রের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে রয়েছে। প্রতিবারের মত এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগসহ নানা বিভাগের সিট খাঁলি রয়েছে কারণ ভর্তি পরীক্ষাতে ইংরেজি ও বাংলাতে পরিক্ষার্থীরা ভালো করতে পারেনি।

সম্প্রতি দুদক সরেজমিনে প্রমাণ পেয়েছে হাসপাতালে ডাক্তার থাকে না, সরকার যে ঔষুধ সরবরাহ করে সেগুলো রোগীদের না দিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়। দুদকের পরিদর্শনের পর প্রধানমন্ত্রী আবারও তাদের সাবধান করেছিলেন। কিন্তু, তারপরও গণমাধ্যমে রিপোর্ট এসেছে ডাক্তাররা হাসপাতালে থাকছে না। শুধু ডাক্তার কেন, কেউই অফিসে থাকবে না এবং নিয়মানুসারে সেবা প্রদান করবে না যদি না নিয়ম ভঙ্গকারীদের শাস্তি দেওয়া  না হয়। যারা এগুলো করে, তারা মনে করে, নতুন সরকার আসলে এমন অভিযান দুই-এক দিন চলে এবং পরে আবার সব কিছইু স্বাভাবিক হয়ে যায়। দুর্নীতিবাজদের এই ধারণাও যেন এবার বাস্তবায়ন না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখা হোক। দ্রুত দুর্নীতি নির্মূল করতে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের কঠিন শাস্তি প্রদান করা হোক।

সরকারি হাসপাতাল ঘুরলে আরো দেখা যাবে, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যে যন্ত্রপাতি প্রদান করা হয় সেগুলো নানা অজুহাতে বন্ধ রাখা হয় অথবা নষ্ট করে ফেলা হয় ডাক্তারদের প্রাইভেট ক্লিনিকের ব্যবসার জন্য। ঘুষ ও সুপারিশ ছাড়া সরকারি হাসপাতালের অপারেশনের সুবিধা পাওয়া কঠিন। আবার খাবারের কোনো উপাদান এই দেশে ভেজাল ছাড়া পাওয়া যায়? দুধ, মাছ, মাংস, তেল, মশলা,সবজি, ফল সবকিছুই ভেজাল।

দেশের কিছু ক্ষমতাশালীরা এতই নিষ্টুর যে তারা অসহায়দেরও ছাড় দেয় না। সরকার দেশের অস্বচ্ছল গর্ভবতী নারী, বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্দ্বী ব্যক্তিদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু, এই ভাতার জন্য কার্ড মেলে না যদি না কেউ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের টাকা না দেয়। গ্রামের স্থানীয় বিচারে সুবিচার মেলে না যদি না কেউ আওয়ামী লীগ নেতাদের টাকা না দেয়। গ্রামের স্কুল,কলেজে ও মাদ্রাসায় দপ্তরী, পিয়ন ও নাইটগার্ডের নিয়োগ পাওয়া যায় না যদি না এসব প্রতিষ্ঠানের সভাপতিকে ঘুষ না দেওয়া হয়। দেশে উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতিও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দুর্নীতি বন্ধ না হলে যতই সেবা প্রদান  করা হোক না কেন সেগুলো জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে না। সরকারি অফিসের পাশাপাশি এই বিষয়গুলোর প্রতিও সরকারের নজর দেওয়া প্রয়োজন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার স্বার্থে এবং এই সরকারের অজর্নগুলো জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু হয়েছে তা অব্যাহত থাকুক এবং দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে দুর্নীতি দমন কমিশনকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হোক। দুদকের শক্তি ও সামর্থ্য যে রয়েছে সেটা আমরা দশ বছর আগেই দেখেছি। সরকার দুদককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিবে এবং দুর্নীতির এই মহাসমুদ্র থেকে দুদকের দক্ষ কর্মকমর্তরা ঠিকই চুনো-পুটিদের সাথে সাথে রাঘব-বোয়ালদেরও ধরে আনবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

আসাদুজ্জামান কাজল: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর