জাতীয় সংগীত বিতর্ক: মা, তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি

, যুক্তিতর্ক

অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান | 2024-09-10 19:21:45

প্রতিটি মানুষই গর্ভধারিণী মাকে ভালোবাসে। এতোটাই ভালোবাসে যে, সেই ভালোবাসার সাথে পৃথিবীর অন্য কোনো ভালোবাসার তুলনা হয় না, সে সুযোগও নাই। পিতার একাধিক স্ত্রী থাকার কারণে কারো যদি একাধিক মা থাকে, সেক্ষেত্রেও অন্যান্য মায়ের তুলনায় গর্ভধারিণী মায়ের সম্পর্কের অনুভূতিগত গভীরতা ভিন্ন মাত্রার হয়। ‘জন্ম’ অনেক বড়ো ব্যাপার। জন্মের সাথে যার সম্পর্ক সে সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, তুলনাহীন। জন্মের পর সদ্যজাত শিশুকে গর্ভফুল থেকে আলাদা করার জন্য নাড়ী কেটে দেওয়া হয়। নাড়ী কেটে বিচ্ছিন্ন করার বিষয়টি দৃশ্যমান কিন্তু নাড়ীর যে অদৃশ্য বন্ধন, তা কখনো কাটা সম্ভব হয় না। এই অদৃশ্য বন্ধনই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বন্ধন।

প্রতিটি মানুষের নিজস্ব দৃষ্টিতে, অনুভূতিতে, সর্বগুণ বিবেচনায়, সর্বদিক বিবেচনায় তার মা-ই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা। নিজস্ব অনুভূতিগত দৃষ্টি ও বিবেচনার বাইরে গিয়ে সর্বম্বাভাবিক বিবেচনায় যদিও সেই মা হয়তোবা একজন অখ্যাত নারী, একজন তুচ্ছাতিতুচ্ছ অতিক্ষুদ্র মানুষ। এই পৃথিবীর কয়েক কোটি কুকুর আছে, মানুষের কাছে যাদের মূল্য হয়তো ওই মায়ের থেকে বেশি। ওই কুকুরগুলোর কুকুরাধিকার ওই মায়ের মানবাধিকারের চেয়ে বেশি সংরক্ষিত। তবুও তিনি তার মা, তার কাছে তার মা-ই সেরা মা।

অনেকের মা-ই হয়তো তাকে ঠিকমতো খাওয়াতে পারেনি, পরাতে পারেনি, পরিচর্যা করতে পারেনি। মা সন্তানকে অনেক মেরেছে, বকেছে, অভিশাপ দিয়েছে। সন্তান মায়ের উপরে অভিমান করেছে, কটূকথা বলেছে, ঝগড়া করেছে, দোষারোপ করেছে, অভিযোগ করেছে। কিন্তু কোনো সন্তানই মায়ের থেকে ভালো কাউকে বাসতে পারেনি। জন্মদানের মহাত্ম্য কখনো ম্লান হয় না, জন্মঋণ কখনো পরিশোধ করা যায় না, জন্মসম্পর্ক কখনো ছিন্ন করা যায় না। এজন্য সন্তানের কাছে ‘মা’ পৃথিবীর সর্বসেরা নারী ও মানবী; আর এজন্যই সকল দেশের সেরা ভূমি, আমার জন্মভূমি।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের প্রেক্ষাপট:
১৯০৫ সালের পূর্বে ব্রিটিশ-ভারতে ‘বঙ্গ প্রদেশ’ বা ‘বাংলা প্রেসিডেন্সি’ নামে যে প্রদেশটি ছিল তার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল ছিল সমগ্র বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলা), বিহার, উড়িষ্যা, মধ্য প্রদেশ ও আসামের কিছু অংশ। প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির কথা বলে লর্ড কার্জন ১৯০৩ সালে এই বিরাট প্রদেশকে দুইভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি উত্তর ও পূর্ব বাংলাকে আসামের সাথে সংযুক্ত করে একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করেন এবং নবগঠিত সেই প্রদেশের নামকরণ করেন পূর্ব বাংলা ও আসাম। অপরদিকে পশ্চিম বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সমন্বয়ে আরেকটি প্রদেশ গঠন করে তার নাম দেওয়া হয় ‘বাংলা প্রদেশ'। এই বিভাজনটি ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গ আইন কার্যকর হয়।

বাংলাকে এভাবে ভাগ করাটা তখনকার জনসাধারণ মেনে নেয়নি, ফলে বঙ্গভঙ্গ রোধ করার জন্য ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পক্ষে, অর্থাৎ বাংলা বিভক্তির বিরুদ্ধে, বাংলাকে একীবদ্ধ রাখার জন্য ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি রচনা করেন। গানটির মূল পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি, ফলে গানটি রচনার সুনির্দিষ্ট তারিখ জানা যায় না। সত্যেন রায়ের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের ৭ই আগস্ট কলকাতা টাউন হলে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আয়োজিত একটি প্রতিবাদসভায় গানটি প্রথম গাওয়া হয়। ওই একই বছরের ৭ই সেপ্টেম্বর মোতাবেক ২২শে ভাদ্র, ১৩১২ বঙ্গাব্দে ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাক্ষরে গানটি ছাপা হয়। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বাউল” নামক গ্রন্থে গানটি অন্তর্ভুক্ত আছে।

গগন হরকরা বা গগন চন্দ্র দাস ছিলেন একজন বাংলা লোকসংগীত শিল্পী, সংগীত রচয়িতা ও বিশিষ্ট বাউল গীতিকার। তাঁর জন্ম বাংলাদেশের শিলাইদহের নিকটস্থ আড়পাড়া গ্রামে। পেশায় তিনি ছিলেন চিঠি বিলিকারী। শিলাইদহ ডাকঘরে চিঠি বিলি করতেন। শিলাইদহে অবস্থানকালীন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বিশেষ অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। তাঁরা দুজনে প্রায়ই আলাপ-আলোচনা ও সংগীত চর্চা করতেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’র সুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংগ্রহ করেছিলেন গগন হরকরার রচিত ও সুরারোপিত গান "আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনে মানুষ যে রে" গানের সুর হতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও সে কথা বলে গিয়েছেন।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী রাজনীতিক, স্বদেশী কর্মী ও বিপ্লবীরা বাঙালি জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য গানটিকে ব্যাপকভাবে প্রচার করেন। ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ শাসক লর্ড হার্ডিঞ্জের শাসনামলে দিল্লীর এক সভাতে ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জের উপস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়।

বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সাথে গানটির ঐতিহ্যগত ও বৈপ্লবিক সম্পর্ক:
১. সার্বিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বাঙালির প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের অভিষেকসহ অন্যান্য নানা অনুষ্ঠানে গানটি বারবার গীত হয়েছে।
২. একুশের প্রভাত ফেরির অন্যতম গান হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা গানটি’ ১৯৫৩ সাল থেকেই গীত হয়ে আসছিল।
৩. মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ২৮ জুন কুড়িগ্রামের রৌমারী ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা’র ভিডিও আমাদের প্রাণে এখনও শিহরণ জাগায়। মুক্তিযুদ্ধের অনেকগুলো জনপ্রিয় গানের মধ্যে এটি একটি অন্যতম জনপ্রিয় গান।
৪. স্বাধীনতা প্রাপ্তির পূর্বে, ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জীবন থেকে নেওয়া’ সিনেমায় গানটি স্থান পায়। জহির রায়হান নির্মিত ওই সিনেমায় তৎকালীন স্বাধীনতা আন্দোলনকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। ফলে গানটি স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা শক্ত ও অমোচনীয় সাংস্কৃতিক ভিত্তি হয়ে আছে।
৫. ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ এক সমাবেশের আয়োজন করে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে চেতনা জাগানোর নিমিত্তে সেই সমাবেশে এই গানটি গাওয়া হয়।
৬. ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের আগে গানটি গাওয়া হয়।
৭. ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্যারেডে গানটি গাওয়া হয়।
৮. বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকার আয়োজিত অনুষ্ঠানে গানটি গাওয়া হয় এবং প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
৯. মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পরিবেশন করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় গানটির যন্ত্রসুর করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার অজিত রায়।
১০. স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন হলে, এর ৪.১ অনুচ্ছেদে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির প্রথম ১০ চরণ (মোট চরণ ২৫ চরণ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১১. গানটির প্রথম ১০ ছত্র কণ্ঠসংগীত এবং প্রথম ৪ ছত্র যন্ত্রসংগীত; সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার করা হয়।
১২. ’৬৯-এর উত্তাল গণ-অভ্যুত্থানের কাল পেরিয়ে ’৭০-এর নির্বাচন ও ’৭১-এ মুক্তিসংগ্রামের ব্রত নিয়ে সংগঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ’৭১-এর ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ক্যান্টিনে জাতীয় সংগীত সংক্রান্ত আলোচনায় সর্বসম্মতিক্রমে গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্ধারণের প্রস্তাব গ্রহণ করে।
১৩. ঢাকায় ৩ মার্চ ১৯৭১-এ অনুষ্ঠিত প্রতিবাদী জনসভায় গানটি গীত হয়।
১৪. ১৩ই জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে এ গানটির প্রথম দশ চরণ সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।
এখানে কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করো হলো। বস্তুত স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে এ গানটির এরকম শত-সহস্র সংশ্লিষ্টতা আছে।

শ্রোতা জরিপ ও বিশ্ব মঞ্চে আমাদের জাতীয় সংগীত:
১. ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার শ্রোতা জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি গানের মধ্যে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রথম স্থান অধিকার করে।
২. বেইজিং অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাজানো ২০৫টি দেশের জাতীয় সংগীতের মধ্যে ‘সেরা দশ’ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত দ্বিতীয় স্থান লাভ করে।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি:
গবেষক ও সাংবাদিক হাসান শান্তনুর লেখা থেকে জানা যায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে তিন বার সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের আলোচনা হয়েছে।
১. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি পদে বসে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. দ্বীন মুহাম্মদকে চেয়ারম্যান করে গঠিত ওই কমিটি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’, ফররুখ আহমদের ‘পাঞ্জেরি’ কবিতাকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব দেয়।
২. রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালের ৩০ এপ্রিল ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে বাদ দিয়ে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করা হয়। মোশতাকের সরকার পাল্টা ক্যু ও জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় সে প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
৩. ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে চারদলের জোট সরকারের আমলে, ২০০২ সালের ১৯ মার্চ তখনকার দুই মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের জন্য প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে যৌথ সুপারিশপত্র জমা দেন। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ওই যৌথ প্রস্তাবটিকে আমলে নেননি।

৫ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের সাম্প্রতিক দাবি:
সাম্প্রতিককালে সুনির্দিষ্ট চিহ্নিত মহলের কিছু ব্যক্তিবর্গের মধ্য থেকে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কানাঘুষা ও আলাপ-আলোচনা শোনা যাচ্ছে। আমি একটি উদাহরণ দিয়ে আলোচনাটা করার চেষ্টা করছি। গত ৩রা সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে, জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থী’ আখ্যা দিয়ে তা পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী। তিনি জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংবিধানকেও নতুন করে রচনার দাবি জানান।

আমান আযমী বলেন, ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ-রদ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এই জাতীয় সংগীত দুই বাংলা এক করার জন্য জাতীয় সংগীত। আমরা কি দুই বাংলা এক হতে চাচ্ছি? আমরা কি স্বাধীন বাংলাদেশ রাখতে চাই, নাকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত রাজ্য হতে চাই?

তিনি বলেন, আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশে থাকতে চাই। এই জাতীয় সংগীত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থী। আমি জোর দাবি জানাচ্ছি, আমাদের নতুন জাতীয় সংগীত তৈরি করা হোক।
জনাব আযমী বাহাত্তরের সংবিধানকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে বলেন, ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছ থেকে ম্যান্ডেট নিয়েছিল পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনেই পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য, স্বাধীন সংবিধান রচনা করে নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি-আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু তারা জনগণের কাছ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কোনো ম্যান্ডেট নেয়নি। সুতরাং এই সংবিধান আমার দৃষ্টিতে বৈধ নয়। নতুন করে একটা কমিটি করে নতুন সংবিধান তৈরি করা হোক, এটা বাতিল করা হোক।

জনাব আযমীপন্থীরা নানাভাবে নানা যুক্তি তুলে ধরে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি তুলছেন এবং সেইসাথে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও স্বাধীনতা অর্জনের প্রকৃত সত্যকে মনগড়া ও অর্পিত অপ্রকৃত দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চাইছেন। যেমন- এই গানটিতে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা নাই, আছে ‘বাংলা’, ফলে এটা পশ্চিম বাংলা নাকি পূর্ব বাংলা সেটার পার্থক্য করা যায় না। এরকম আরও অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে।

জনাব আযমী সাহেবের বক্তব্য ও যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য তো নয়ই বরং এটা খুবই ঘৃণ্য এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান দেশকে অস্বীকার করার মতো চরম মৌলিক উপাদান সম্বলিত ও সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এই বক্তব্যের বিপরীতে কথা বলতেও রুচিতে বাধে। তারপরেও দু/চারটি কথা বলতে হচ্ছে। কারণ, এইরকম আসার বক্তব্যকে মহাবাণী হিসেবে গ্রহণ করে, তাকে সমর্থন করার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যত্বের প্রাদুর্ভাবে আক্রান্ত লোকজনের সংখ্যা এ দেশে কম নয়।

প্রথমেই বলে রাখি, আযমী সাহেব বলেছেন, “আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশে থাকতে চাই।” এই কথাগুলোর প্রথম অংশ সত্য নয়। আযমী সাহেবরা তখন স্বাধীনতা চাননি। কথাগুলোর পরবর্তী অংশ সত্য কিনা তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, তারা কীভাবে থাকতে চান; স্বাধীনভাবে, নাকি কারো ছায়াতলে!

১৯৭০ সালের নির্বাচন হয়েছিল পাকিস্তানের অধীনে। স্বভাবতই সেই নির্বাচনের ম্যান্ডেট ছিল পাকিস্তানকেন্দ্রীক। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর স্বাধীনতার আগের সেই পাকিস্তানকেন্দ্রীক ম্যান্ডেট কার্যকর থাকার প্রশ্নই আসে না। স্বাধীন দেশে স্বাধীন সংবিধান রচনা হবে সেটাই স্বাভাবিক। জনাব আযমী সাহেব, স্বাধীন দেশে পাকিস্তানের সংবিধান কার্যকর রাখার পক্ষে এবং বাংলাদেশের সংবিধান রচনার বিপক্ষে কথা বলেছেন। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য বক্তব্য হতেই পারে না। এই যুক্তি তুলে ধরে, তিনি ও এই ধারার মানসিকতাধারীরা কী চাইছেন, সেটা বোঝার জন্য বোধ হয় খুব বেশি বুদ্ধি খরচার দরকার নাই।

আমার সোনার বাংলা গানটি বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে রচিত বলে এটা বাংলাদেশের ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে না, জনাব আযমী সাহেবের এ যুক্তিটিও একটি খোঁড়া এবং অগভীর জ্ঞান থেকে উত্থিত সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ধ্যানধারার প্রতিনিধিত্বকারী যুক্তি। এর মাধ্যমে তিনি ইতিহাস ঐতিহ্যকে অস্বীকার করেছেন। এই গানটির সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে সম্পর্ক আছে, তার কয়েকটি উদাহরণ ইতোমধ্যে দিয়েছি, পরে আরও বিস্তারিত বলব।

ভারত বিভক্তি: এক জগাখিচুড়ি, না হয়েছিল জাতির ভিত্তিতে, না হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে:
১৯৪৭ সালে জওহরলাল নেহেরু, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং সরদার ভল্লভভাই প্যাটেল-সহ কংগ্রেস নেতাগণ ব্রিটিশ-ভারতকে এক রেখে, একজাতির একদেশ দাবি করেছিলেন। তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন বলেছিলেন, "হিন্দু মুসলিমদের একই জাতীয় পরিচয়ে পরিচিত করা একটা স্বপ্নমাত্র।" মি. জিন্নাহ তখন দ্বি-জাতি তত্ত্ব দিয়েছিলেন। এর আগে ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের প্রথমদিন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কুখ্যাত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ঘোষণা দেন। তিনি ধর্ম ও জাতিকে এক করে ফেলেছিলেন, কিন্তু ধর্ম ও জাতি এক নয়। একটি ধর্মে বিভিন্ন জাতির মানুষ থাকতে পারে, আবার একটা জাতিও বিভিন্ন ধর্মের লোকের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে। জনাব জিন্নাহ, ধর্মকে জাতি হিসেবে নিয়ে ভারত বিভাজনের মূল ব্লেন্ডারটা করেছিলেন। জনাব জিন্নাহর কারণে, শেষ পর্যন্ত ভারত বিভক্তিটা- না হয়েছিল জাতির ভিত্তিতে, না হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। জাতির ভিত্তিতে হলে দুই বাংলা এক থাকার কথা, ধর্মের ভিত্তিতে হলে কাশ্মীরের পুরোটাই পাকিস্তানের অংশ থাকার কথা। ফলে জগাখিচুড়ি করে ভারত বিভক্ত হয়েছিল এবং এই জগাখিচুড়ির দায় জনাব জিন্নাহর।

ব্রিটিশ শাসিত বাংলা দুইভাগে ভাগ হয়েছিল বলে তাদের কৃষ্টি, ভাষা, সংস্কৃতি ভাগ হয়ে যায়নি। ফলে বঙ্গভঙ্গের আগে দুই বাংলার যে কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা ও ঐতিহ্য ছিল তা পরিবর্তন হয়ে যায়নি। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি অখণ্ড বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেছিল বলে, খণ্ডিত বাংলায় সেটা পরিবর্তন হয়ে যায়নি। কারণ, গানটিতে যে অখণ্ডতার কথা বলা হয়েছে সে অখণ্ডতা শুধু ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা নয়, স্বজাতির আত্মিক ও সাংস্কৃতিক অখণ্ডতাও বটে। বাংলাদেশ থেকে বহির্বিশ্বে অন্য কোনো দেশে গিয়ে কেউ নাগরিকত্ব নিলে তাঁর কৃষ্টি, সংস্কৃতি পরিবর্তন হয়ে যায় না, তার নাগরিকত্ব, জাতীয়তা পরিবর্তন হয় কিন্তু জাতি পরিবর্তন হয় না। বরং এখানে যে প্রশ্নটি করা যায় তা হলো- ভারতকে বিভক্তির সময়ে কেন বাংলাকে অখণ্ড রেখে বিভক্ত করা হলো না? একটা জাতির মধ্যে ছুরি চালিয়ে, তাকে কেটে কেন দুভাগ করা হলো? বাংলাকে এভাবে ভাগ করার দায় তো রবীন্দ্রনাথের নয়, এ দায় জিন্নাহর। ফলে, জনাব আযমী যদি তাঁর বক্তব্যে জিন্নাহকে দায়ী করতেন, সেটা বরং গ্রহণযোগ্য হতো। ফলে এই কারণ দেখিয়ে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও এ গানটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং বহুল ব্যবহৃত একটি গান। আন্দোলনের পরতে পরতে গানটি গাওয়া হয়েছে। মানুষকে উজ্জীবিত করার জন্য এর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের আবহাওয়া, ঋতুর বৈশিষ্ট্য, আবেগ, সংস্কৃতি সবকিছুর সাথে গানটির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।

পশ্চিম বাংলার সাথে আমাদের অনেককিছুরই মিল আছে বলে তার সবকিছুকে বাদ দিতে হবে এমন চিন্তা কোনো সুচিন্তা হতে পারে না। ওরা বাংলায় কথা বলে, এজন্য আমরা বাংলায় কথা বলা ছেড়ে দেবো? ওরা ‘মা’ বলে, এজন্য আমরা ‘মা’ বলব না? একাধিক দেশের সাথে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতির মিল থাকাটা গর্বের, এটাকে অগর্বের বলে প্রচারের মধ্যে ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকটতা দায়ী। যুগ যুগ ধরে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যাবে, তারা তাদের কৃষ্টি, ভাষা ইত্যাদিকে দখলদার ভূখণ্ডের উপরে চাপিয়ে দিয়ে তাদের নিজেদের কৃষ্টির মতো করতে চেয়েছে। সেটা গর্বের বলেই চেয়েছে। পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে আপনা-আপনিই যে মিল রয়েছে তা গর্বের হতে পারে, অগর্বের বা বিভেদের হতে পারে না। সারা পৃথিবী যদি আমাদের ভাষা ও কৃষ্টির মতো বা তার কাছাকাছি হতো সেটা হতো আরও গর্বের। আমরা আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবার কাজটি করতে পারি কিন্তু এটাকে সঙ্কুচিত করে এমন প্রয়াস নিতে পারি না।

বাংলার বাঘ, বাংলার বাঘিনী, বাংলার দামাল ছেলে, বাংলা মায়ের সন্তান, বঙ্গ জননী ইত্যাদি শব্দগুলোর বহুল ব্যবহার আছে। শব্দগুলোকে বাংলাদেশের বাঘ, বাংলাদেশের বাঘিনী, বাংলাদেশের দামাল ছেলে, বাংলাদেশের মায়ের সন্তান, বঙ্গদেশের জননী বলার প্রয়োজন নাই। আবার “দেশনেত্রী” শব্দটিও আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত। এখানে বলার প্রয়োজন নাই “বাংলাদেশ নেত্রী”। কবিতা, গান ও অনেক সম্মানসূচক শব্দাবলী উচ্চারণের সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই শব্দের প্রচ্ছন্নতা বা অ্যাবসট্রাক্ট, সংক্ষিপ্ত রূপ ইত্যাদি ভাষার সৌন্দর্য বর্ধন করে। এগুলো হলো সেরকম বিষয়। ফলে গানটিতে ‘বাংলা’ শব্দ আছে কিন্তু ‘বাংলাদেশ’ শব্দ নাই, এ কথাগুলো যারা বলছেন, তাদেরকে বড়োজোর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বলা চলে। যদি সেটা তারা মানতে রাজি না হন, তবে মানতে হবে, তাদের এসব কথা বলার পিছনে অন্য কোনো দুরভিসন্ধি ও ক্ষুদ্রতা ক্রিয়াশীল।

‘আমি নয়ন জলে ভাসি’ কথাগুলোর অর্থ কেউ যদি বোঝে- নয়নের জলে কী বন্যা হয়, যে সেই জলে ভাসবে? এটা যে বুঝছে তার সমস্যা, কথাগুলোর সমস্যা না। ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’- এই কথাগুলোর বিরোধিতায় একশ্রেণির মানুষ দ্রোহী হয়ে বলে, মুসলমানরা আল্লাহর কাছে ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নত করতে পারে না। বোধগত অর্থ না বুঝাতে পারার এই যে বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যত্ব, এটার দায় তো লেখকের নয়। এটা যে বুঝতে পেরেছে না তার সমস্যা এবং এটাকে যারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য ভুলভাবে বোঝাচ্ছে তাদের দোষ।
জাতীয় সংগীতের উপরে বার বার কেন এ কুঠারাঘাত:
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির শাসকগণ এবং তাদের সমর্থকগণ, বাঙালির প্রাণসঞ্জীবনী রবীন্দ্রনাথ ও তার গানের উপরে বার বার কুঠারাঘাত করেছে, নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এর কারণ বহুমুখী। এরমধ্যে হিন্দু বিদ্বেষ ও ঐতিহাসিক সত্যকে চাপা দিয়ে অর্পিত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা-বিষয়ক কারণ দুটি অন্যতম।

হিন্দু বিদ্বেষের বিষয়টিকে যদি আলোচনা করতে চাই তবে এর মূলভিত্তিতে যেতে হবে, যেখানে পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্ব বিষয়ক প্রসঙ্গটি প্রাসঙ্গিক। জনাব জিন্নাহ সাহেব তার রাজনৈতিক জীবনে ধর্মকে কাজে লাগিয়েছেন এবং ধর্মকে জাতি বানিয়ে ধর্মবানতাকে উস্কে দিয়ে নিজেকে ধর্মবান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে সফল হয়েছেন। তিনি বিলেতে লেখাপড়া করেছেন এবং বিলেতি জীবনচর্চায় অভ্যস্ত ছিলেন। মুসলিম প্রীতি প্রচার করে নিজেকে খাঁটি মুসলিম হিসেবে দেখানোর মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত কারণ লুকায়িত ছিল।

জিন্নাহর পিতামহ প্রেমজিভাই ঠাকর ছিলেন হিন্দু। তিনি ছিলেন ভারতের গুজরাটের কাঠিয়াওয়ারের গোন্ডাল রাজ্যের পানেলি মতি গ্রামের বানিয়া সম্প্রদায়ের লোহানা উপ-বর্ণের উপজাত। তিনি মাছের ব্যবসা করতেন বলে নিরামিষ হিন্দু লোহানা উপজাত থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তিনি মাছের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে আবার তাঁর বর্ণে ফিরে আসার চেষ্টা করেন কিন্তু লোহানা উপজাত তাকে গ্রহণ করেনি। একারণে ক্রুদ্ধ হয়ে, প্রেমজিভাই ঠাকর তাঁর চার ছেলেসহ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং স্থায়ীভাবে বোম্বেতে চলে আসেন, সেখান থেকে পরবর্তীতে পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান।

প্রেমজিভাই ঠাকরের চার ছেলের মধ্যে বড়ো ছেলের নাম ছিল পুঞ্জলাল ঠাকর। এই পুঞ্জলাল ঠাকর ছিলেন জিন্নাহর পিতা। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর জিন্নাহর পিতা পুঞ্জলাল ঠাকর, পুঞ্জাভাই জিন্নাহ নাম ধারণ করেন। পুঞ্জাভাই জিন্নাহর স্ত্রী মিথিবাইয়ের গর্ভে সাত সন্তানের জন্ম হয়, যারমধ্যে জিন্নাহ ছিলেন সবার বড়ো। জিন্নাহর বাবা পুঞ্জাভাই জিন্না ছিলেন খোজা ইসমাইলি ফিরকা বিশ্বাসের অনুসারী প্রথম প্রজন্মের মুসলমান, যদিও তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের ধর্ম বিশ্বাস শিয়া ইসলামের দিকে নিয়ে যায়।

জনাব জিন্নাহ বিলেতে লেখাপড়া করেন, তাঁর জীবন ধারায় ইসলামের চেয়ে বিলেতি চর্চা প্রধান ছিল। বিলেতে গিয়ে ছেলের মনমানসিকতা পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা থেকে জিন্নাহর মা বিলেতে যাবার আগেই নিজের পছন্দমত মেয়ের সাথে তাঁর বিয়ে দেন। জিন্নাহর প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল এমিবাই। তিনি ছিলেন জিন্নাহর দূর সম্পর্কের চাচাত বোন। তিনি ব্রিটিশ ভারতের গুজরাটের রাজকোট জেলার পানেলি মতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার নিজারি ইসমাইলি শিয়া মুসলিম পটভূমির গুজরাটি খোজা ছিলেন। বিয়ের সময় জিন্নাহর বয়স ছিল ১৬ বছর এবং এমিবাইয়ের বয়স ছিল ১৪ বছর। জিন্নাহর মায়ের আশঙ্কা সত্য হয়েছিল। বিলেতে যাবার পর জিন্নাহ তাঁর স্ত্রীর আর কোনো খোঁজ-খবর নেননি। জিন্নাহর বিলেতে থাকা অবস্থায়ই তাঁর প্রথম স্ত্রী এমিবাইয়ের মৃত্যু হয়।

জিন্নাহর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন দ্বিতীয় ব্যারোনেটের কন্যা রতনবাই পেটিট। রতনবাইয়ের পরিবার পার্সি সম্প্রদায়ের অন্তর্গত জরথুস্ট্রিয় ধর্মের অনুসারী ছিলেন। পেটিট পরিবার ছিল অত্যন্ত ধনী, নামী, সুশিক্ষিত এবং উচ্চ পাশ্চাত্য। রতনবাই পেটিটের পিতামহ দিনশ মানেকজি পেটিট ভারতের প্রথম তুলা মিল প্রতিষ্ঠা করেন। শিল্প, বাণিজ্য এবং জনহিতৈষীতে অনন্য অবদানের কারণে তিনি ব্যারোনেটসি উপাধি অর্জন করেছিলেন। এই বিয়ের কারণে পেটিট পরিবার তাদের মেয়ে রতনবাইকে অস্বীকার করে। জিন্নাহ ও রতনবাইয়ের বয়সের ব্যবধান ছিল চব্বিশ বছর।

রতনবাঈয়ের গর্ভে তাদের একমাত্র কন্যা দিনার জন্ম হয়, ১৯১৯ সালের ১৫ই আগস্ট। ১৯৩৮ সালে উনিশ বছর বয়সী দিনা এক পার্সি যুবকের প্রেমে পড়েন। এ সময়ে জিন্নাহ ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে পাকিস্তানের সর্বেসর্বা নেতা হতে চলছেন। ফলে জিন্নাহ নিজে অমুসলিম পার্সিকে বিয়ে করলেও ক্ষমতার মোহে বিভোর হয়ে মেয়েকে অমুসলিমের সাথে বিয়ে দিতে অস্বীকার করেন। বাবার নিষেধ সত্ত্বেও মেয়ে দিনা, পার্সি বংশোদ্ভূত এবং পরে ভারতীয় হওয়া নেভিল ওয়াদিয়াকে বিয়ে করেন। নেভিল ওয়াদিয়ার জন্ম ইংল্যান্ডের লিভারপুলে, স্যার নেস ওয়াদিয়া এবং লেডি ইভলিন ক্লারা পাওয়েল ওয়াদিয়ার ঘরে। ১৯৪৩ সালে দিনা-নেভিলের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে এবং তারপর থেকে দিনা তাঁর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বোম্বেতে নিজের পিতামহের বানানো পৈত্রিক নিবাসে বসবাস শুরু করেন। দিনা কখনো তাঁর পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পরিচয় দেননি, তাঁর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেননি।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়। জিন্নাহ তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। প্রবল পরাক্রমশালী ব্যক্তি। তিনি মেয়ে দিনাকে তাঁর কাছে পাকিস্তানের করাচিতে চলে আসতে বলেন। মেয়ে দিনা তখন বাবাকে প্রশ্ন করেন- আমার মায়ের কি হবে? তুমি কী আমার মায়ের কবর বোম্বে থেকে পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পারবে? তিনি জিন্নাহর মৃত্যুর পর পিতার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ১৯৪৮ সালে একবারমাত্র পাকিস্তান গিয়েছিলেন। দিনা জিন্নাহর ছেলে অর্থাৎ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নাতি বর্তমান ভারতের অন্যতম শীর্ষ ধনী ওয়াদিয়া গ্রুপের মালিক নাসলি ওয়াদিয়া। দিনার মেয়ে ডায়ানা ওয়াদিয়া। নাসলি ওয়াদিয়ার দুই সন্তান- জাহাঙ্গীর ওয়াদিয়া এবং নেস ওয়াদিয়া। ভাগ্যের এক নির্মম পরিহাস- লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান আদায় করে নেওয়া জিন্নাহর সব উত্তরাধিকারই ভারতীয় নাগরিক, পাকিস্তানে তাঁর কেউ নেই।

পাকিস্তানের জাতির পিতার জন্ম, বিবাহ ও পরিবারে হিন্দু ও অমুসলিম সংশ্লিষ্টতা আছে বলে সেটাকে কাউন্টার করার জন্য একশ্রেণির মানুষ বাংলাদেশের জাতির পিতার সাথে ওই একই ধরনের হিন্দু ও অমুসলিম সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করেন এবং কাল্পনিক সম্পর্ক তৈরি করে তার প্রচার-প্রচারণাও করেন। যারা এই কাজটি করেন তারা পাকিস্তানপন্থী এই ধারার সাথে সম্পর্কিত। দ্বি-জাতিতত্ত্ব নামক অগ্রহণযোগ্য ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকতার যে বীজ জিন্নাহ সাহেব ও তাঁর সমর্থকগণ বপন করেছিলেন, সেই বীজের বংসপ্রবাহ সেই থেকেই হিন্দু বিরোধিতা করে আসছে।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনেকে হিন্দু মনে করেন, যদিও তিনি হিন্দু ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ ছিলেন কুশারী এবং পরবর্তীতে ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষিত। গানের সুরকার গগন হরকরা ছিলেন হিন্দু। হিন্দু বিরোধিতার সেই ধারার লোকজনই তাদের ধারাকে প্রবাহিত করার জন্য জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন চায় এবং সে পরিবর্তনের পক্ষে নানান যুক্তি তুলে ধরে, যাকে যুক্তি না বলে কুযুক্তি বলাই যুক্তিযুক্ত।

এ দেশের মুসলমানদের আরেকটি ধারা আছে, যেটা মওদুদী ধারা। মওদুদী ধারার অনুসরণকারীরাও হিন্দু বিদ্বেষী এবং হিন্দুবিরোধী। শুধু হিন্দু বিদ্বেষী ও হিন্দুবিরোধী বললে কম বলা হবে, এরা মূলত ইসলাম ধর্ম বাদে অন্যান্য সকল ধর্ম বিদ্বেষী ও বিরোধী। মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী ভারতের বর্তমান তেলেঙ্গানা রাজ্যের হায়দ্রাবাদের আওরঙ্গবাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে সামাজিক-রাজনৈতিক ইসলামি আন্দোলনের অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯২৮ সালে মিশরে হাসান আল বান্না মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেন। এটি প্রথম দিকে প্যান-ইসলামিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক আন্দোলন হিসাবে গঠিত হলেও পরবর্তীতে রাজনৈতিক অঙ্গনে অগ্রসর হয়। এদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলো শরিয়া আইন দ্বারা শাসিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। বিশ্বব্যাপী এদের বিখ্যাত স্লোগান হলো- ইসলামই সমাধান। মওদুদী মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শের সাথে সমন্বয় করে জামায়াত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

মওদুদী তথা জামায়াত ব্রিটিশের কাছ থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল এবং ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টিরও বিরোধিতা করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর জামায়াত দলটি ভারত ও পাকিস্তানে যথাক্রমে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ ও জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান নামে পৃথক স্বাধীন সংগঠনে বিভক্ত হয়। স্বাধীনতার পূর্বে ব্রিটিশের কাছ থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির বিরোধিতা এবং পরে উগ্র ধর্মীয় উস্কানিমূলক কার্যক্রমের ফলে মওদুদী তাঁর জন্মভূমি হায়দ্রাবাদ ও ভারতে নিষিদ্ধ হয়ে পড়েন এবং পাকিস্তানে চলে আসেন। তিনি যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, পরবর্তীতে সেই পাকিস্তানকেই ইসলামিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি কিছু ধর্মীয় উস্কানিমূলক কার্যক্রম করেন যা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে।

কাদিয়ানি নামে পরিচিত আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার দাবি করে তীব্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির জন্য ১৯৫৩ সালের ৮ই মে পাকিস্তানের আদালত মওদুদীর ফাঁসির আদেশ দেয়। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে দাঙ্গা ঘটিয়ে শত শত মৃত্যুর জন্য তাকে দায়ী করে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিল সে সময়ের পাকিস্তান সরকার। এই দাঙ্গার ফলে ১৯৫৩ সালের ৬ মার্চ পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি হয়। পরে অবশ্য সামরিক সরকার ১৯৫৫ সালের ২৯ এপ্রিল মওদুদীকে ছেঁড়ে দেয়। অদ্ভুত ব্যাপার হলো- মাওলানা ভাসানী ও আজাদ পত্রিকার সম্পাদক মওলানা আকরাম খাঁ মওদুদীর ফাঁসির আদেশের বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের প্রতিবাদের মুখেই মওদুদীর ফাঁসির আদেশ বাতিল করে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর পরে তো ছেড়েই দেওয়া হয়।

মওদুদী ও তাঁর দল জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের স্বাধীনতারও বিরোধিতা করেছিল। যদিও পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর এ দেশে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে জামায়াতের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হয়। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান এবং জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে এবং মওলানা গোলাম আজম সেই লিয়াজোটি রক্ষা করে চলে। পাকিস্তান এই সংগঠনটির মাধ্যমে যুদ্ধে হেরে যাবার প্রতিশোধ নেবার জন্য তাদের কৌশল বাস্তবায়ন করতে থাকে। নানাবিধ সেসব কৌশল ও নীতির মধ্যে পূর্ব থেকে চলমান হিন্দু বিরোধিতার ধারাটিও ক্রিয়াশীল থাকে। এদের মতে, ভারতের রাজনৈতিক চালবাজিতে পাকিস্তান ভেঙে দুটো রাষ্ট্র হয়েছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যে, আশিকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় একপর্যায়ে তা স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নিয়ে, সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে- এই সত্যকে তারা গৌণভাবে দেখে। ভারত পাকিস্তানকে ভেঙেছে- এই ক্ষোভ থেকে তারা সবাই ভারত বিরোধী, পক্ষান্তরে হিন্দু বিরোধী।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মুসলমানেরা নিজেদের দেশে, সমাজে সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একেবারে নিষ্প্রভ থাকলেও ভারত ও হিন্দু বিরোধিতার বিষয়ে এরা খুবই সরব থাকে। এর কারণ, আর কিছু নয়, পূর্ব থেকে চলে আসা জিন্নাহ এবং মওদুদীবাদের রাজনৈতিক ধারার প্রতিফলন।

কেন স্বাধীনতা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ইত্যাদির প্রতি এরা ক্ষুব্ধ:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও স্বাধীনতা অর্জনের সাথে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর অবস্থান ও সংশ্লিষ্টতা একবারেই নেতিবাচক এবং বিরোধী। স্বাধীন দেশ তার স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসকে গর্বের সাথে ধারণ করবে, পালন করবে, উদযাপন করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই কাজগুলি করতে গেলে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর সেই সময়ের বিরোধী অবস্থান ও সংশ্লিষ্টতা সামনে চলে আসে। এজন্য তারা সেই ইতিহাসগুলিকে মুছে ফেলতে চায়। এজন্য তারা ঐতিহাসিক সত্যকে চাপা দিয়ে অর্পিত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টারত। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের বিষয়টি সেই প্রচেষ্টা ও দুরভিসন্ধিরই অংশ। সংবিধান পরিবর্তন, জাতীয় পতাকার পরিবর্তন, স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে যুক্ত সকল ব্যক্তি ও ইতিহাসের পরিবর্তন ও সবকিছুকে মুছে দেবার উন্মত্ততা সেই ধারাবাহিক প্রচেষ্টারই প্রতিফলন।

পৃথিবীর কয়েকটি দেশের জাতীয় সংগীত, যেখানে দেশপ্রেমের ছিটেফোঁটাও নাই:
ইংল্যান্ডের জাতীয় সংগীত রচিত হয় ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৯০০ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে গানটি জাতীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করে। গানটির বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় অনেকটা এরকম-

“রানিকে রক্ষা কর ভগবান
রানি আমাদের হোক আয়ুষ্মান
জয়ী কর তাঁরে; দাও তাঁরে যশ
দাও দাও তাঁরে বিমল হরষ
সুখ শান্তিতে রাজ্য করুক, এই কর ভগবান
জাগো জাগো প্রভু! জাগো জাগো ভগবান!
শত্রু দলিতে হও হে অধিষ্ঠান
নষ্ট কর হে শত্রুর ছল
নাশো দুষ্টের বুদ্ধি ও বল
হে চির-শরণ, বিপদে মোদের অভয় কর হে দান”

একটি দেশের জাতীয় সংগীতের ওপর শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, গানটিতে দেশ বন্দনার লেশ মাত্র নেই। নেই দেশের মানুষের জন্য কল্যাণকামনা। আদ্যোপান্ত রানির মঙ্গল প্রার্থনা করা হয়েছে এতে। দেশ ও জাতির পারস্পরিক সম্পর্কসূত্রের উল্লেখ এখানে সুদূর কল্পনাতেও স্থান পেয়েছে বলে মনে হয় না। তাই বলে তারা তাদের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করছে না।

ফ্রান্স থেকে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পটভূমিতে ১৭৯২ সালের এপ্রিল মাসে একটি কবিতা রচনা করা হয়। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে ওই কবিতাটি ফ্রান্সের জাতীয় সংগীত হিসেবে গণ্য হয়। এটি রাইনের সৈন্যবাহিনীর যুদ্ধের গান হিসেবে পরিচিত। গানটির বাংলা অনুবাদটি এরকম–

“ফরাসি ভূমির সন্তানসবে আয়রে আয়রে আয়
কীর্তিলাভের শুভ অবসর যায় রে যায় বহিয়া যায়
অত্যাচারের উদ্যত ধ্বজা রক্তে করিয়া স্নান
আমাদের পরে বৈর সাধিতে হয়েছে অধিষ্ঠান
শুনিছো কি সবে কী ভীষণ রবে কাঁপায়ে জলস্থল,
দম্ভের ভরে গর্জন করে শত্রু সৈন্যদল!
তারা যে আসিছে কেড়ে নিতে বলে তোমার সকল ধন,
গ্রাসিতে শস্য—ক্ষেত্র নাশিতে পুত্র ও পরিজন
ধর হাতিয়ার ফ্রান্সের লোক, বাঁধ দল, বাঁধ দল!
চল রে চল চল রে চল!
ঘৃণা শোণিতে হবে কি সিক্ত মোদের ক্ষেত্রতল!”

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গানটি শুধুমাত্র যুদ্ধের বারতা দেয়। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর একটি দেশের এ জাতীয় আক্রমণাত্মক জাতীয় সংগীত ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসকেই পুনর্জাগরুক করে। এটি পরিবর্তনের কথা কেউ বলে না।
১৮২৩ সালে রচিত একটি গান ১৮৪৪ সালে হাঙ্গেরির জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃত হয়। সার্বজনীনতা আর জাতিসত্তার পরিচয়হীন এই গানটিও যেন যুদ্ধের ডঙ্কা বাজায়। মূল গানের বাংলা ভাষান্তর—

“দেশের দশের ডাক শোন ওই
ওঠ ওঠ ম্যাগিয়ার
এই বেলা যদি পারো তো পারলে
নইলে হলো না আর
মুক্ত হবে? না রইবে অধীন
বুঝে চিনে লও পথ
ম্যাগিয়ার আর রবে না অধীন
করিনু এই শপথ
আমরা সবাই করিনু শপথ
লয়ে দেবতার নাম
আর রবো না অধীন প্রভু!
পুরাও মনস্কাম।”

স্বাধীনতা লাভের প্রায় দুইশ বছর পরও অধীনতা থেকে মুক্তির ক্রমাগত প্রার্থনা কতখানি যৌক্তিক ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। এখনো এটিই তাঁদের জাতীয় সংগীত।

জাপানের জাতীয় সংগীত পৃথিবীর প্রাচীনতম কবিতা। ৭৯৪ সালে থেকে ১১৮৫ সাল পর্যন্ত যা বারবার সম্প্রসারিত এবং পরিবর্তন করা হয়েছে। মূল সংস্কারক হেইকান কাল। প্রথম চারটি লাইন তুলে ধরলেই পাঠকদের কাছে পরিষ্কার হবে এর সারমর্ম–

“অযুত যুগ ধরি বিরাজো মহারাজ
রাজা হোক তব অক্ষয়
উপল যতদিন না হয় মহীষর
প্রভূত শৈবালে শোভাময়”
এই সংগীতটি পরিবর্তনের জন্য জাপানের জনগণ কোনো দাবি তোলে না।

৫ই আগস্টের শ্রাবণ বসন্ত এবং তথাকথিত দ্বিতীয় স্বাধীনতা:
দেশ দুনিয়ায় বহু ধরনের স্বাধীনতা আছে- বাক স্বাধীনতা, কর্ম স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি ইত্যাদি। সব স্বাধীনতারই দরকার আছে, সব স্বাধীনতাই গুরুত্বপূর্ণ, তবে কোনো স্বাধীনতাই ভূখণ্ডগত স্বাধীনতার সাথে তুলনীয় নয়। লেখার শুরুতে গর্ভধারিণী মায়ের ভালোবাসার উদাহরণ দিয়ে যে কথাগুলো বলে লেখাটি শুরু করেছিলাম সেই রেফারেন্স দিয়ে আবারও বলি- গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার পতন একটা বড়ো অর্জন কিন্তু এটা স্বাধীনতা নয়। এটাকে স্বাধীনতা বলার প্রশ্নই আসে না। স্বৈরাচার পতনকে কোনোভাবেই ১৯৭১ সালে অর্জিত ভূখণ্ডগত স্বাধীনতার সাথে তুলনা করা যায় না। এটা ধৃষ্টতা, রাজনৈতিক আক্রোশের উলঙ্গ ও উৎকট বহিঃপ্রকাশ। ১৯৭১ সালে অর্জিত ভূখণ্ডগত স্বাধীনতা এই ভূখণ্ডের সবচেয়ে বড়ো অর্জন। অন্য কোনো অর্জনই এই অর্জনের সাথে তুলনীয় নয়। এই তুলনা যারা করছেন তারা ওই স্বাধীনতাবিরোধী ধ্যানধারণার চর্চাকারী ও সমর্থক।

কোটা আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধার কোটা বাতিলের দাবির মাধ্যমে। সেটা পরবর্তীতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং শেষে এক দফার স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয় এবং সফল হয়। এই আন্দোলনে যারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তাদেরকে শহিদের মর্যাদা দিয়ে তাদের পরিবারের চাকরি, বাসস্থান ইত্যাদি দেবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এটি একটি ভালো ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে শহিদ ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মানিত করার কথা বলা হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, ভাস্কর্য ইত্যাদি নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে। নিজেদের কলঙ্কিত অতীত মুছে ফেলার জন্য জাতির অতীত গৌরবকে মুছে ফেলার এ উৎকট কর্মযজ্ঞ দেশকে ভালো কিছু দেবে না। এতে চলমান বৈষম্যগুলো আরও প্রকট হবে। আক্রোশী হয়ে বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়।

ইতোপূর্বেও আমরা পতিত সরকার দেখেছি। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতিত হওয়া, এক-এগারোর গণঅভ্যুত্থানে বিএনপি সরকারের পতিত হওয়া আমরা দেখেছি। পতিত হবার পরে তপস্যা করে নির্বাণ লাভ করে নিষ্পাপ মহামানব হয়ে এরা আবার ফিরে আসেনি, বরং যা ছিল তারসাথে আক্রোশ ও সর্বগ্রাসী ক্ষুধার জিঘাংসা নিয়ে ফিরে এসেছে। এটা অশনি। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমরা দেখেছি। কোনো গণঅভ্যুত্থানের ফসলই দীর্ঘমেয়াদে জনমুখী হয়নি।

স্বৈরাচার পতনের পর দেশ বিনির্মাণের জন্য গণঅভ্যুত্থানকারীগণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি পাওয়া খুনি, দাগী শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রয়োজনীয়তাকেও খুব প্রবলভাবে অনুভব করছেন এবং সে কারণে তাদেরকেও পাইকারি হারে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। সবাইকে নিয়ে কাজ করার আনন্দটা আসলেই অন্যরকম। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের থেকেও এদের মূল্য বেশি দেবার মতো এমন উদারতা কয়জন দেখাতে পেরেছে? সারা দেশব্যাপী এমন অসংখ্য উদারতার স্বেচ্ছা-প্যাকেজের যে মহাসমারোহ চলছে তাতে আমরা অচিরেই আফগানিস্তান, সিরিয়া, প্যালেস্টাইনের মতো উন্নত রাষ্ট্রের তকমা লাগাতে পারবো।

তথ্যসূত্র:
১. জাতীয় সংগীত: পুরনো তর্ক, নতুন পরীক্ষা, নবনীতা তপু, বিডিনিউজ২৪.কম, ৫ই সেপ্টেম্বর ২০২৪
২. বাঙলা বাঙালী ও বাঙালীত্ব, আহমদ শরীফ
৩. বাঙালীর জাতীয়তাবাদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
৪. বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন- শতবর্ষ স্মারক সংগ্রহ
৫. বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংবর্ধনা- বাংলা একাডেমি
৬. ভ্রান্তি অবসানে আর কালক্ষয় নয়- ড. সাখাওয়াৎ হোসেন (দৈনিক সমকাল- ২৬ আগস্ট ২০১৮)
৭. বাঙালির সংস্কৃতি রক্ষায় ঐক্য - এম আর খায়রুল উমাম
৮. শুদ্ধ সুরেই জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হোক- শীলা মোমেন (দৈনিক সমকাল- ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
৯. জাতীয় সংগীত গাইতে হবে শুদ্ধ ভাবে- আ.ব.ম রবিউল ইসলাম (দৈনিক সংবাদ, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
১০. দেশ-বিদেশের জাতীয় সঙ্গীতের কথা- হাবিবুর রহমান স্বপন
১১. বিতর্কে জাতীয় সংগীত– ‘আমি নয়ন জলে ভাসি’, অজয় দাশগুপ্ত, বিডিনিউজ২৪.কম, ৫ই সেপ্টেম্বর ২০২৪
১২. জাতীয় সঙ্গীত বদল - বিতর্কের উদ্দেশ্য কি? মীনাক্ষী ভট্টাচার্য, সহমন, ১৯শে ডিসেম্বর, ২০২০
১৩. শ্রীলঙ্কা মাতা, উইকিপিডিয়া
১৪. আমার সোনার বাংলা, উইকিপিডিয়া
১৫. সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান, বিবিসি.কম
১৬. জাতীয় সংগীতের সময় দাঁড়াতে হয়, জানেনা অনেকেই, ওবায়দুল্লাহ সনি, নিউজরুম এডিটর, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১২
১৭. বঙ্গভঙ্গের গান ‘আমার সোনার বাংলা’ যেভাবে জাতীয় সংগীত করা হয়, যুগান্তর ডেস্ক, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
১৮. ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের কারণ ও ফলাফল, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
১৯. জিন্নাহ পরিবার, উইকিপিডিয়া
২০. দ্বি-জাতিতত্ত্ব, উইকিপিডিয়া


অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান, লেখক ও গবেষক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

এ সম্পর্কিত আরও খবর