পুড়ে মরা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-26 02:07:16

এটাকে পুড়ে মরা না বলে পুড়িয়ে মারা বলাই ভালো! একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে আমরা আবারও দেখলাম অসংখ্য মানুষের করুণ মৃত্যু। চকবাজার এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লেগে মারা গেল ৬৭ জন মানুষ। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া সন্তানের খোঁজে হতভাগ্য স্বজনের আহাজারিতে ঢাকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। বাতাসে পোড়া-লাশের গন্ধ! কার ভুলে, কার পাপে, কার উদাসীনতায় আজ এমন ট্র্যাজিক মৃত্যু সংঘটিত হলো? আর কতো এমন আগুনে পোড়া লাশ দেখতে হবে আমাদের? আর কত দিন এই দেশে বেঁচে থাকার জন্য জীবন্ত অঙ্গার হয়ে যেতে হবে? এই প্রশ্নগুলোই মানুষের বিষাদময় মনে ঘুরেফিরে আসছে!

নয় বছর আগে পুরান ঢাকার নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদামগুলো সরানোর দাবি উঠেছিল জোরেশোরে, কিন্তু তা হয়নি। আর না হওয়ার কারণেই নিমতলীর এক কিলোমিটারের মধ্যে চকবাজার চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পাশের কয়েকটি ভবনের আগুনে ভস্মীভূত হলো এত এত প্রাণ! কাকে দায়ী করব এই ঘটনার জন্য? কি বলে সান্ত্বনা দেব নিজেকে, স্বজন হারানো মানুষগুলোকে? তাদের তো কেবল স্বজনরাই পোড়েনি, পুড়েছে তাদের সুখ-স্বপ্ন-আশা, বেঁচে থাকার যাবতীয় অবলম্বন! যারা আগুনে পুড়ে কোনো মতে বেঁচে আছে, কি সান্ত্বনা দেব তাদের?

আমরা কি আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি? কর্তাব্যক্তিরা কি তাদের দায়িত্ব ঠিকঠাক মতো পালন করেছেন? ২০১০ সালে নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মানুষের প্রাণহানির জন্য কেমিক্যালের গুদামগুলোকে দায়ী করা হয়। তারপর তদন্ত কমিটির সুপারিশে কেমিক্যালের অনিরাপদ গুদামগুলো সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছিল। দুই বছর আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন পুরান ঢাকার কেমিক্যালের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে তার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। নিমতলীর ঘটনার পরও অনেক আহাজারি, অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। সতর্ক হওয়ার তাগিদও সে সময় অনেক উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু আমরা সতর্ক হইনি। আর হইনি বলেই চকবাজারে আবার একই রকম ঘটনা ঘটল! ক্ষমাহীন উদাসীনতা আর এক শ্রেণির মানুষের লোভাগ্নিতে পুড়ে ছাই হলো অসংখ্য অসহায় মানুষ! প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন পণ্যের পাইকারি এই বাজারে অধিকাংশ ভবন অনেক পুরনো, একটির সঙ্গে আরেকটি লাগানো, ফলে আগুন লাগলে তা দ্রুত ছড়ায়। আর রাস্তা সরু ও আশপাশে খোলা জায়গা না থাকায় আগুন নেভানোর কাজ করতেও বেগ পেতে হয় অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর কর্মীদের।

আমাদের দেশে কোথাও কোনো নিয়ম বা শৃঙ্খলা নেই। আইন মেনে চলার এবং আইন মানানোর কোনো বালাই নেই। ফলে বিভিন্ন কারখানা থেকে শুরু করে সিএনজি চালিত গাড়ি ও বাসাবাড়িতে ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় মানুষ পুড়ে কয়লা হচ্ছে। কারখানা আইন, বাসাবাড়ি তৈরির তৈরির আইন সবই আছে। কিন্তু এসবের কোনো প্রয়োগ নেই।

যে কোনো আইন বা কোড মেনে চলার দায় বাড়ি-গাড়ি-কারখানার মালিক পক্ষের। আর কোড অনুসরণ নিশ্চিত করার দায় সরকারি কর্মকর্তাদের। আগুন লাগতেই পারে – সেইটা দুর্ঘটনা- কিন্তু দাহ্যপদার্থের প্রভাবে আর ব্যবস্থাপনার অভাবে পুড়ে শত শত মানুষ কয়লা হয়ে যাওয়া মোটেও দুর্ঘটনা নয়, এটা একটা অপরাধ। আইনের ভাষায় যাকে বলা হয়– "ক্রিমিন্যাল নেগলেজেন্সি"।

সোজা কথা হলো– এই ঘটনার জন্যে দায়ী বাড়ি ও কারখানার মালিক, আর সরকারি পরিদর্শক– যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে তাদের দায়িত্ব পালন না করে এই গণহত্যা ঘটিয়েছে। কোনো তদন্ত কমিটির নামে এই ক্রিমিনালদের আড়াল করার চেষ্টা করা না হয়। দ্রুত এই লোকগুলোর নামে মামলা করে তাদের গ্রেফতার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

গণমাধ্যমের উচিত ঘটনাকে করুণ রসে জারিত করে মানুষের করুণা সৃষ্টির চেষ্টা না করে ক্রিমিনালদের ছবি দেখান – তাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সহায়তা করুন। খুঁজে বের করুন সেই পরিদর্শক আর তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের– যাদের দায়িত্বে ছিলো ফায়ার কোড অনুসারে বাড়ি ও কারখানা পরিচালনার বিষয়ে। কার অবহেলা, কার অসচেতনতায়, কার দুর্নীতির কারণে এমন ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটেছে– সেটা খুঁজে বের করাই এখন সময়ের দাবি।

যারা নিয়ম-আইন মানেননি, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভবিষ্যতের ব্যাপারে এখনই কঠোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে হবে। ভবিষ্যতে আর এই ধরনের ঘটনা ঘটবে না, তা নিশ্চিত করতে হবে। মুনাফা লোভী ব্যক্তি আর দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি পরিদর্শকের কারণে যাদের নির্মম মৃত্যু হয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

শুধু ক্ষতিপূরণ দিয়ে নিজেদের দায় শেষ করা যাবে না। মানুষের জীবনের কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। ক্ষতিপূরণ হয় না স্বামী, স্ত্রী, বাবা মা, ভাইবোনের মৃত্যুর। কোনো মানুষের মৃত্যু হলে তার শূন্যতা সেই পরিবারে অপূরণীয়। যে শিশুরা এতিম হলো তারা কি আর কখনও বাবা মায়ের স্নেহ মমতা ফিরে পাবে? মমতার কি কোনো ক্ষতি পূরণ হয়? হয় না। তাদের বাবা মাকে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু তাদের জীবন ধারণের নিশ্চয়তাটুকু অন্তত দেওয়া সম্ভব। তাদের বেঁচে থাকার চাহিদাগুলো নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের মৃত্যু যেন ভবিষ্যতে আর কখনও না ঘটে নিশ্চিত করতে হবে সে বিষয়টি। এটাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর