এবিএম মূসা : পরিবেশ ও উন্নয়ন সাংবাদিকতা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

কামরুল ইসলাম চৌধুরী | 2023-08-31 16:28:44

আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি। বরেণ্য সাংবাদিক এবিএম মূসার ৮৮তম জন্মদিন। বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের ৩৬ বছর পূর্তি। এদেশের পরিবেশ আন্দোলন, পরিবেশ মন্ত্রণালয় গঠন আর টেকসই উন্নয়ন সাংবাদিকতার বিকাশে বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের রয়েছে গৌরববোধ করার মতো অবদান। এবিএম মূসা ছিলেন পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরিবেশ মন্ত্রণালয় গঠনেও রয়েছে তার অবদান।

জন্মদিনে প্রয়াত মূসা ভাইয়ের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

পরিবেশ ও উন্নয়ন সাংবাদিকতার প্রসঙ্গ এলেই আমার চোখে ভেসে ওঠে প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মূসার অতি আপন চেনা চঞ্চল মুখ। মনে পড়ে এসএম আলী, তোয়াব খান, আহমেদ নূরে আলম, শেহাবউদ্দিন আহমেদ নাফা, বদিউল আলম, মোস্তফা কামাল মজুমদারের কথা। স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে ড. কাজী ফরজাদ জালাল আর ড. রেজাউল করিমের উৎসাহী উদ্যমী যত সব টেকসই উন্নয়ন আয়োজন।

আমি বলছি আশি দশকের গোড়া কথা। পরিবেশ ও উন্নয়ন সাংবাদিকতা তখন আমাদের এ অঞ্চলের দেশগুলোতে পল্লবিত সবুজের আচ্ছাদন মেলেছে মাত্র।

উন্নয়ন আর পরিবেশের দ্বন্দ্ব চিরায়ত। চুম্বকের উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর মতোই যেন ধ্রুব সত্য। উন্নয়নের মাশুল গুনতে হয় প্রকৃতিকে, প্রাণবৈচিত্র্যকে, ইকো সিস্টেমকে, সর্বোপরি মানুষকে। আবার মানুষের ক্ষুধা ও দারিদ্র হটাতে, প্রাচুর্যের যোগান দিতেই প্রয়োজন অর্থনৈতিক উন্নয়ন।

ষাটের দশকে এসে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ চিন্তার জন্ম। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আর অর্থনীতিবিদরা ভাবতে শুরু করেন কী করে উন্নয়ন কৌশলে, পরিকল্পনায় পরিবেশ সংরক্ষণ চিন্তাকে একাকার করা যায়। বিশ্ব রাজনীতির পুতুল নাচের রূপক রাজারা বরাবরই সমৃদ্ধির যূপকাষ্ঠে প্রকৃতিকে বিসর্জন দিয়েছেন। গ্লোবাল ভিলেজ কনসেপ্টের বড় বাধাও হলেন তারা। তেমনি এক টালমাটাল স্নায়ুযুদ্ধকালে এলো পরিবেশ ও উন্নয়ন সাংবাদিকতা। আপন ঐতিহ্য সংরক্ষণ চিন্তা, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার এক নিরবধি প্রয়াস।

তাপদাহ উন্নয়নের অগ্নি স্রোতে আমার কৃষকের চিরচেনা বীজ যেন হারিয়ে না যায়। চিরসবুজ বৃক্ষরাজি যেন বিপণনী পণ্য গাছকাঠ লুপ্ত না হয়। চিরস্বাদের মিঠাপানির চেনা চেনা মাছগুলো যেন উন্নয়নের রাক্ষুসে প্রজাতি গিলে ফেলতে না পারে। নদ-নদী-খাল-বিলে-জলাভূমিতে দখলদারিত্ব যেন বন্ধ হয়। তেমনি এক টেকসই উন্নয়ন মতবাদ থেকেই পরিবেশ ও উন্নয়ন সাংবাদিকতার জন্ম।

ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকার হরণ না করে, প্রকৃতিকে ধ্বংস না করে কীভাবে উন্নয়ন ঘটানো যায়, তেমনি চিন্তাধারাজাত সাংবাদিকতাই হলো পরিবেশ সাংবাদিকতার মূল কথা। পরিবেশ সাংবাদিকেরা উন্নয়ন নিয়ে যেমনি ভাববেন, তাদের রিপোর্ট, ফিচারে, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় লেখার সময় এবং ফটোগ্রাফে ঠিক তেমনি প্রাকৃতি ভারসাম্য সংরক্ষণের বিষয়টিও মাথায় রাখবেন। পরিবেশ সাংবাদিকতা, পরিবেশ আন্দোলন যেন নতুন বিশ্বের শান্তিরই এক বাতাবরণ।

জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান দেড় দশক আগে ঢাকায় এসে বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।কফি আনানের সেই হুঁশিয়ারির সঙ্গে বিজ্ঞানীরা একমত যে, বাংলাদেশ মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে। আবহাওয়া পরিবর্তনের নির্মম শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। ভবিষ্যতে বিপর্যয় আরো ঘনীভূত হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা মাত্র এক মিটার বাড়লেই দেশের সাড়ে ১৭ ভাগ ভূমি সাগরতলে হারিয়ে যাবে চিরতরে। কয়েক কোটি লোক পরিবেশ আর জলবায়ু শরণার্থী হবে। বিশ্বের সবচেয়ে যে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, তা সাগর কোলে তলিয়ে যাবে। বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হবে।

মোট কথা হলো, বাংলাদেশের পরিবেশ সমস্যা আর সংকট-এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এক আলোচিত বিষয়। আমাদের আর্সেনিক সমস্যা, ঢাকা মহানগরীর বায়ূদূষণের সংকট বিশ্ব পরিবেশ নিয়ে যারা মাথা ঘামান, তাদের উৎকণ্ঠিত করে তোলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এ দেশের পরিবেশ ভাগ্যবিধাতারা সে ব্যাপারে এখনও তেমন একটা উচ্চকণ্ঠ নন।

অথচ পরিবেশ খাতে বাংলাদেশের রয়েছে বেশ কিছু সাফল্য। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতৃত্বদানকারী বেশ কিছু পরিবেশ বিজ্ঞানী এবং পরিবেশবাদী রয়েছেন আমাদের। বিশ্ব জুড়ে গর্ব করে বলার মতো আমাদের রয়েছে প্রথম পরিবেশ কর্মপরিকল্পনা। তবু পরিবেশের সব মাপকাঠিতেই বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়া এক দেশ। পরিবেশের ঘাত-প্রতিঘাতের নির্মম শিকারও। আঠার কোটি মানুষের জনবহুল এ দেশের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখোমুখি। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ আচ্ছাদন। অবাধে উজাড় হচ্ছে বনরাজি। সুন্দরবন, মধুপুরের শালবন, পার্বত্য বন-বনানী আজ হুমকির সম্মুখীন। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলীসহ নদ-নদীগুলোতে চলছে নির্লজ্জ দখলদারিত্ব। পানি দূষণ, বায়ূ দূষণ, আর্সেনিক দূষণ, মাটি দূষণ আমাদের পরিবেশ- প্রতিবেশ সমস্যাকে জটিল করে তুলছে। নানা সরকারি বেসরকারি কর্মসূচী সত্ত্বেও আমাদের পরিবেশ অবক্ষয় ঘটে চলছে দ্রুতগতিতে। পরিবেশ বিষয়ক আইন ও বিধি বিধানের ফাঁকফোকর ও শিথিল প্রয়োগের সুযোগে চলছে নির্বিচার এ ধ্বংসযজ্ঞ এবং ক্রমাবনতি। বাংলাদেশ ব্যাপক জনসংখ্যার ছোট এক দেশ। ১৯৭০ সালে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। ২০৩০ সালের মধ্যে বেড়ে দাঁড়াবে ২৫ কোটিতে। অর্থাৎ প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব হবে ২০০০ জন। শতাব্দী শেষে লোকসংখ্যা বর্তমানের চেয়ে প্রায় তিনগুণ হচ্ছে। আর এ জন্যে দেশটির প্রধান শঙ্কার কারণ হচ্ছে, টেকসই পরিবেশ বজায় রাখা যাবে কতটুকু? কার্যকর জীবনযাপন ব্যবস্থা গড়ে তোলা আমাদের জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ।

উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল অথবা উপকূলীয় এলাকার আর্থ-সামাজিক জীবন, এর কৃষি ভিত্তি অথবা ঘূর্ণিজড়ের প্রচণ্ডতা, বিশ্ব উষ্ণায়ন অথবা টর্নেডোর ভীতি যাই হোক না কেন, বাংলাদেশকে এর পরিবেশ সংরক্ষণের জন্যে একটি প্রতিরক্ষামূলক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া পরিবর্তনের এক বড় শিকারে পরিণত হতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা। এ তো আর অমূলক আশঙ্কা নয়। দেড় দশক আগে জাতিসংঘের মহাসচিব আনান বাংলাদেশ সফরকালে এ ব্যাপারে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করে গেছেন। পরবর্তী সকল মহাসচিব সে আশংকার কথা জানিয়ে হুঁশিয়ার করেছেন। কিন্তু সমুদ্রপৃৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত সম্ভাব্য ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে আমাদের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের আর বন বিভাগের অনেক কর্মকর্তাকে তেমন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতে দেখা যায়নি।

অথচ আমাদের এখানে পরিবেশবাদীদের দাবিতেই পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম (এফইজেবি)সহ সংরক্ষণবাদীদের সেই শোরগোলের কারণেই পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সৃষ্টি হয়েছে ১৯৮৯ সালে। পরিবেশ অধিদফতরের জন্ম ১৯৭৭ সালে। পরিবেশ আন্দোলনের কারণেই জাতীয় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনা (নেমাপ) প্রণীত হয়েছে ১৯৯১-৯৫ সময়কালে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়, এনজিও আর পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই অংশীদারিত্বমূলক এই পরিবেশ পরিকল্পনা তৈরি করা হয় সাধারণ মানুষের মতামতের ভিত্তিতে। তৃণমূলের মানুষ তাদের পরিবেশ ভাবনা এই কর্মপরিকল্পনায় তুলে ধরেন, সমাধানও বাতলে দেন। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এডাব, এফইজেবি, সিইএনসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিবেশ কর্মপরিকল্পনা তৈরির কাজটি সম্পন্ন করে বিদেশী বিশেষজ্ঞ ছাড়াই। প্রণীত হয় পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫। তৈরি হয় পরিবেশ সংরক্ষণ বিধি ১৯৯৭। পরিবেশ আইন এবং বিধি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এডাব, সিইএন, বেলা, এফইজেবিসহ নাগরিক সমাজ। নবীণ মন্ত্রণালয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় সহযোগিতা, বিশেষজ্ঞদের জ্ঞান ও পরামর্শে পরিবেশ আইন ও বিধি প্রণয়নের মতো জটিল কাজ শুরু হয়। বাস্তবায়িত হয় ইউএনডিপি’র আর্থিক সহায়তায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবেশ কর্মসূচী- টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচী। নানা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মন্ত্রণালয় বেসরকারি প্রতিনিধিরা একযোগে কাজ করেন। পরিবেশকে ঘিরে রচিত হয় সরকারি বেসরকারি সহযোগিতার এক অনন্য বন্ধন। নেমাপ অর্জন করে আন্তর্জাতিক প্রশংসা। সরকারি বেসরকারি সহযোগিতার এই বন্ধন বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্¦ল করে। ব্রাজিলে ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিরা কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে কাজ করেন। ধরিত্রী সম্মেলন-উত্তরকালেও এ ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকে। ২০১২ সালে রিও+২০ সম্মেলনেও সকলে এক সুরে কথা বলেন। নেমাপের অন্যতম প্রণেতা হিসেবে আমি মনে করি, পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে সিকি শতাব্দী আগে তৈরি করা নেমাপ দলিলের হালনাগাদ করা এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সদস্য আর গণমাধ্যম কর্মীদের ক্লান্তিহীন পরিশ্রমে পরিবেশ বিষয়ক খবরাখবরের পরিমাণ এখন যথেষ্ট বেড়েছে। এদেশের সংবাদপত্রে, রেডিও- টেলিভিশনে ষাটের দশকে পরিবেশ বিষয়ক সংবাদ ছিল প্রায় শূণ্যের কোঠায়। সত্তর ও আশির দশকে শূন্য থেকে ২০ কলাম ইঞ্চিতে তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। এখন প্রতিদিনি ২৫০ থেকে ৩০০ কলাম ইঞ্চি পরিবেশ বিষয়ক রিপোর্ট, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, ফিচার, আলোকচিত্র দৈনিক কাগজে প্রতিদিন বেরুচ্ছে। নিয়মিত পরিবেশ বিষয়ক পাতাও প্রতি সপ্তাহে বেরুচ্ছে কয়েকটি কাগজে। টেলিভিশনে ষাট ও সত্তর দশকে নিয়মিত কোনও পরিবেশ বিষয়ক সংবাদ পাওয়া যেতো না। এখন বিটিভিতে প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দশ মিনিট পরিবেশ বিষয়ক খবরাখবর ও অনুষ্ঠান থাকছে। অন্যান্য বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো এবং রেডিওতেও একইভাবে পরিবেশ বিষয় থাকছে। মোট কথা, গুণগত মান যাই হোক না কেন, পরিমাণগত দিক থেকে পরিবেশ বিষয়ক লেখালেখি আর খবরাখবর গত কয়েক দশকে ধীরে ধীরে বেড়েছে। তবে গত কয়েক বছরে পরিবেশ সাংবাদিকদের কল্যাণে তা বেড়েছে অতি দ্রুত গতিতে। গণমাধ্যমের এই ইতিবাচক ও সক্রিয় ভূমিকার কারণে বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ সামগ্রিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। এমনকি ওসমানী উদ্যান পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশ সমস্যা বিশ্ব পর্যায়ে উঠে এসেছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি সমস্যা সমাধানে সহযোগিতার হাত তেমন একটা বাড়িয়ে দেয়নি বিশ্ব সম্প্রদায়।

বার বার তাই কানে ভেসে আসছে জাতিসংঘ পরিবেশ সংস্থার তদানিন্তন নির্বাহী পরিচালক ক্লাউস ট্রপারের কথা, ‘বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ক্লাসিক কেস’। সত্তর দশকে ক্লাউস ছিলেন জার্মান পরিবেশমন্ত্রী। রাইন নদী তখন মারাত্মক দুষিত। তিনি ঝাঁপ দিলেন রাইনে। সাঁতার কাটলেন। ইউরোপের নানা দেশে নানা পরিবেশ জলবায়ু সম্মেলন সেমিনারের যোগ দিতে গিয়ে দেখি, সেই রান নদী এখন দূষণমুক্ত। মার্গারেট থ্যাচার দূূষিত টেমসকে রক্ষার জন্য তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে ‘টেমস বাচাঁও’ শিরোনামে কর্মসূচী রেখেছিলেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি সত্যি সত্যি টেমস নদীকে বাঁচিয়েছিলেন। আজ টেমসের বুকে ঢেউ খেলে যায়। অথচ আমাদের বুড়িগঙ্গার জন্যে অনেকের মন গলে না। ঢাকার বায়ুতে সীসার পরিমাণ নিয়ে তেমন টনক নড়ে না। আর্সেনিক দূষণে গ্রাম-গ্রামান্তরের কোটি হতদরিদ্র মানুষ আক্রান্ত। নীতিনির্ধারকদের অনেকের সে ব্যাপারে নেই কোন মাথাব্যাথা। সত্যি এ যেন এক নির্লজ্জ ক্ষমাহীন ক্ল্যাসিক কেস। কফি আনানের কথা বোঝার মতো লোকের বড় অভাব এ দেশে। যেমন অভাব কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর (প্রয়াত পরিবেশবাদী ওবায়দুল্লাহ খান) কবিতার সুরেলা ধ্বনি মরমী সুর উদ্ধারকারীর। বাংলাদেশের মাটি, নিসর্গ, প্রকৃতি, শস্য-শ্যামল গ্রান্তরের প্রতি অসীম মমত্ববোধ সম্পন্ন এমন উচ্চমানের পরিবেশবাদী কবির জন্ম এ দেশে আর হবে কিনা সন্দেহ!

পাশের দেশ ভারতে পরিবেশ আইনের কঠোর প্রয়োগ হচ্ছে। ভারতীয় সুপ্রীমকোর্ট এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। আমাদের সুপ্রীমকোর্ট সে তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এ আমাদের আরেক ব্যর্থতা। দেশের বিদ্যমান পরিবেশ আইনগুলো সুষ্ঠু প্রয়োগ হলে জাতির টেকসই উন্নয়ন যাত্রা এগিয়ে যেত অনেকদূর। সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ, সমন্বয় আর পারস্পরিক সহযোগিতা পরিবেশ সংরক্ষণে আজ অপরিহার্য।

দু’দশক আগে সরকার ঢাকা মহানগরী থেকে টু স্ট্রোক থ্রী হুইলার বেবী ট্র্যাক্সি আর দেশব্যাপী পলিথিন নিষিদ্ধ করায় দেশবাসী পরিবেশগত সুফল ভোগ করতে শুরু করেছিলো। তবে, প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল যৎসামান্য। আমাদের নষ্ট রাজনীতির নকল পুতুল রাজাদের মনে রাখা উচিত, চীনের মতো ১৩৫ কোটি মানুষের দেশও আজ দুনিয়া জোড়া পরিবেশ আন্দোলনের সম্মুখ কাতারে থাকতে আগ্রহী। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে সবুজ জাতীয় আয় গণনার আর সবুজ উন্নয়ন নীতি কৌশল অনুমোদন তারই প্রমাণ। আরও প্রমাণ চান। কেন, দেখতে পাননি শান্তির জন্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কেনিয়ার বিপ্লবী পরিবেশবাদী ওনানদা মাথাই। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য নোবেলও পেয়েছেন মার্কিন সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি আল গোর ও আইপিসিসি।

২০০৮ সালে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (বিসিসিএসএপি) আমরা তৈরি করি। ২০০৯ সালে তা সংশোধিত হয়। বাংলাদেশ প্রথম দেশ যে এটি করেছে। দশ বছর পর এখন এটি জন অংশগ্রহণের ভিত্তিতে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের দ্বারা হালনাগাদ করা প্রয়োজন। এ দলিলের অন্যতম প্রণেতা হিসেবে এটি আমার দাবি। তা হলে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল এবং কর্ম পরিকল্পনার একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন দেখতে পাবে। এটির মেয়াদ ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো প্রয়োজন। সকল জাতীয় পরিকল্পনার মূলধারায় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার ওপর জোর দিতে হবে। এতে বাংলাদেশকে জলবায়ু সহিষ্ণু দেশে পরিণত করার জন্য রূপান্তরমূলক অভিযোজন অর্জনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এসডিজিগুলোর সঙ্গে ডেল্টা প্ল্যান এবং দেশের ৮ম ও ৯ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সাথে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনকে সংযুক্ত করে সমগ্র সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন করা দরকার। ব-দ্বীপ পরিকল্পনাটিকেও জনমতের প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

আজ আমাদের শ্লোগান হোক-হটাও দূষণ, বাঁচাও মানুষ। ক্লাউস, মাথাই, কফি আনানের মতো হাজারো পরিবেশবাদীর জন্ম হোক আমার দেশে। আমরা সেই সবুজ বাংলাদেশের সন্ধানে। বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের ৩৬ বছর পূর্তির আনন্দঘন মূহূর্তে সেই হোক সকলের একান্ত কামনা। তাহলেই হয়তো ধরিত্রীর কাছে আমাদের অনেক ঋণের খানিকটা শোধ হবে। পাখ-পাখালির কলকাকলি মুখরিত সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের নদীর ঢেউ, কৃষকের ধানের শীষে ভোরের শিশির ফোঁটার অনিন্দকান্তি, পল্লীবধূদের বীজ তুলে রাখার প্রাণান্তকর প্রয়াস, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন, চঞ্চল হরিণ শাবকের প্রকৃতির কোলে নিশঙ্ক ছুটে চলা, রাখালের বাঁশির সুরেলা সুমধুর ধ্বনিতে পরিবেশ সংরক্ষণে উজ্জীবিত হোক আমাদের এ দেশ। সবুজ উন্নয়নের পথে টেকসই উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় শরীক হই।

কামরুল ইসলাম চৌধুরী: বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান এবং জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর