পাকিস্তানের শান্তির বার্তা ও ভারতের যুদ্ধপ্রস্তুতি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-09-01 20:06:03

ভারত-পাকিস্তান চলমান উত্তেজনা নিরসনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শান্তির বার্তা দিতে তাদের হাতে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আটক ভারতীয় বিমান বাহিনীর পাইলট উইং কমান্ডার অভিনন্দনকে ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একই সাথে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ শাহ কুরেশি জানিয়েছেন যে তাদের প্রধানমন্ত্রী সংকট নিরসনের উপায় অন্বেষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে টেলিফোনে কথা বলতে চান। এহেন পরিস্থিতির নেপথ্য কারণ হিসেবে ভারতের জম্মু কাশ্মীর সীমান্তে ভারতের বিপুল সেনা সমাবেশ এবং যুদ্ধাবস্থায় বেসামরিক লোকজনের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ভারতের পক্ষ থেকে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ১৪ হাজার বাংকার নির্মাণকে অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

বর্তমান সংকটের সূচনায় পাকিস্তানের দায় রয়েছে এই মর্মে যে তাদের ঘোষিত নিষিদ্ধ সংগঠন গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারত শাসিত পুলওয়ামায় আত্মঘাতি বোমা হামলা চালিয়ে ভারতীয় সৈন্য এবং বেসামরিক লোকের প্রাণহানি ঘটিয়েছে, যা ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তান সরকারের পরোক্ষ মদদে সংগঠিত হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

ঘটনার পরপরই ভারতের কড়া জবাবের হুশিয়ারিতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তুলনামূলক নরম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হলেও ভারতের যে কোনো আঘাতের পাল্টা জবাব দিতে পাকিস্তান প্রস্তুত রয়েছে বলেও জানিয়ে দেয়া হয়। আর পাকিস্তান সেটি কিছুটা করে দেখিয়েছে ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুটি বিমানকে ভূপাতিত এবং একজন বৈমানিককে আটক করার মাধ্যমে। তবে উদ্ভুত পরিস্থিতে পাকিস্তান যে যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে চায় সেটা তারা তাদের আচরণে নানাভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী এবং সবচেয়ে বড় দুটি দেশ বৃটিশ শাসনের অবসানের পর থেকেই একে অপরের সাথে তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে চলছে এবং বলার অপেক্ষা রাখেনা যে এই সমস্যার মূলে রয়েছে কাশ্মীর। বৃটিশ শাসকবৃন্দ কর্তৃক দেশ ভাগ করা হলেও কাশ্মীরের বিষয়টি তাদের নিজেদের ওপর ছেড়ে দেয়ার পর থেকেই বিপত্তির শুরু। তখনকার হিন্দুরাজ জম্মু কাশ্মীরে মুসলমানদের আধিক্য থাকা সত্ত্বেও কাশ্মীরকে ভারতের সার্বভৌমত্বের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করান, যার পথ ধরে পরবর্তিতে কাশ্মীর নিয়ে ভারত, পাকিস্তান এবং চীন এই তিন দেশের মধ্যে বিরোধ চলতে থাকে। এ পর্যন্ত ভারত এবং পাকিস্তান – এই প্রতিবেশী দেশ দুটি এনিয়ে দুবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এবং আজকে তাদের যে পারমাণবিক সামর্থ্য সেটাও মূলত কাশ্মীরকে কেন্দ্র একে অপরের পাল্টাপাল্টি শক্তির প্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

অবশ্য বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের বিকাশের ধারাবাহিকতায় কাশ্মীর সমস্যার অস্তিত্ব না থাকলেও তারা পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হতে চাইত কি না সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে।

দুই দেশের মধ্যে এ নিয়ে দুটি যুদ্ধ ছাড়াও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের পক্ষান্বেষণের নেপথ্যে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সাথে তিক্ততাপূর্ণ সম্পর্ককেও একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বলা চলে। এর বাইরেও বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্ন ছোটখাট সংঘাত এবং ১৯৮৯ সালে কারগিল সীমান্ত্রে উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে তারা যুদ্ধের বেশ কাছে চলে আসে। পরবর্তিতে নাটকীয়ভাবে যুদ্ধে না গিয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে সংকট সমাধানের চেষ্টা করতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় দুই দেশের মধ্যে ২০০৩ সালে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে উভয়ই সীমান্ত থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার এবং শান্তি বিনষ্ট হয় এমন কোনো কাজ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়।

এরপর বিভিন্ন সময়ে ভারতের ভূখণ্ডে পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী কিছু সন্ত্রাসী হামলা চালায়, যার মধ্যে অন্যতম ২০১০ সালে হোটেল তাজ এবং ট্রাইডেন্টে জঙ্গী হামলা, যা মাত্র ১১ জন সন্ত্রাসীর উদ্যোগে সংগঠিত হয় এবং এতে ১৭০ জনের প্রাণহানি ঘটে।

এই সন্ত্রাসবাদের ঘটনায় ভারত একমাত্র জীবিত জঙ্গিকে গ্রেফতার করে বিচারের রায় মোতাবেক ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করে। এর বাইরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাকিস্তানী সন্ত্রাসী বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী অবস্থায় রয়েছে এবং তাদের বিচারকাজ চলছে।

এসব বিষয়ের অবতারণা এই কারণে যে বর্তমান সংকটের সূচনার পেছনেও রয়েছে এধরণের সন্ত্রাসী হামলা, যা আগেও অনেকবার সংগঠিত হয়েছে এবং এ নিয়ে দুই দেশই কঠোর অবস্থান দেখিয়ে আসছে। পাকিস্তানের বিগত সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্বরিত বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য জঙ্গির ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।

তবে ভারতের দিক থেকে এই সংকটের পেছনে অনেকটা দায় রয়েছে এই কারণেই বলা যে দুই দেশের সমস্যার বাইরেও বিগত বছরগুলোতে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ ভারত সরকার কর্তৃক শোষিত বলে মনে করে। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু কাশ্মীরের জনগণের ৬০ শতাংশই মুসলিম এবং তারাসহ অনেক মানুষ হয় একটি স্বাধীন কাশ্মীর অথবা পাকিস্তানের সাথে ইউনিয়নভূক্ত হবার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আসছিল। এসব বিদ্রোহীদের একজন বুরহান ওয়ানী যে ছিল ২২ বছরের যুবক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বিদ্রোহ প্রস্তুতির বিভিন্ন ভিডিও শেয়ার করে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিল এবং এক পর্যায়ে ২০১৬ সালে ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে সে নিহত হলে মানুষ আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। তার শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে এবং সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আরও ৩০ জন নিহত হয়।

২০১৮ সালেও বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৫ শতাধিক বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষোভের মাত্রা বাড়তে থাকে। বিগত সময়গুলোতে ভারত সরকারের নির্দেশে কিছু কাশ্মীরি হোটেল কাশ্মীরের নাগরিকদের সেখানে অবস্থানে কড়াকড়ি আরোপ করায়, কাশ্মীরের মানুষদের ব্যাপক বেকারত্ব এবং বৈষম্যমূলুক আচরণ বাড়তে থাকায় সেখানকার সরকারের উদ্যোগে জনগণ ভারতীয় পণ্য বর্জন করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আত্মঘাতি হামলা সংগঠিত হয়, যেখানে ৪০ জন ভারতীয় নাগরিক নিহত হয়।

উল্লিখিত ঘটনার আলোকে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতে পারে এখানে পাকিস্তানের প্রতি ভারতের এই কঠোর অবস্থান এবং যুদ্ধের প্রস্তুতির নেপথ্যে কি ভারতের কোনো দায় নেই? যেখানে ভারত সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির প্রতি সাধারণ মানুষ ক্রমাগতভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে সেখানে একটি সন্ত্রাসী হামলার জন্য সরাসরিভাবে নির্দিষ্ট কোনো দেশকে দায়ী করে সেদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে হামলা চালানো উস্কানি ছাড়া আর কিছু নয়। আর যদি ভারত নিজ থেকেই এমন উস্কানিমূলক আচরণ করে থাকে তবে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসতে পারে এই সময়ে এর কি কারণ থাকতে পারে।

এর স্বপক্ষ্যে অন্ততঃ দুটি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে; প্রথমত, আর মাত্র দুই মাসের মধ্যে ভারতে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জন্য অগ্নিপরীক্ষার সামিল। মোদি তার মেয়াদের প্রথম কয়েকটা বছর ভাল চালালেও ক্রমাগতভাবে জনমত তার প্রতিকূলে যেতে শুরু করেছে। বিগত কয়েকটি প্রাদেশিক নির্বাচনে বিজেপির শক্ত ঘাটিগুলো বিরোধীদের দখলে চলে যাওয়া, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলগুলোর নতুন করে জোটভুক্ত হওয়া এবং তার নিজের জোটের কিছু দলের সে জোটে সামিল হওয়া, ব্যাপক বেকারত্বের কারণে তরুণদের মধ্যে আস্থাহীনতা বাড়তে থাকা মোদির জন্য নির্বাচনী বিতরণী পার হওয়া অনেক কঠিন করে তুলেছে, দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতাসীন হবার পর থেকে দেশের তলানীতে যাওয়া অর্থনীতিকে গতিশীল করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে তিনি এই দুরাবস্থা কাটাতে সাহায্য চেয়েছেন। কিছু প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন, এর মধ্যে সৌদি আরবের কাছ থেকে তিনি আশাতীত সাড়া পেয়েছেন। মাত্র কয়েকদিন আগে সৌদি প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান সেদেশ সফরে কয়েক বিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। এহেন অর্থনৈতিক দুরাবস্থা কাটাতে পাকিস্তান সরকারের মনযোগ সরিয়ে নিয়ে আরেকটিবারের জন্য যুদ্ধের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারলে ভারতের জন্য তা হবে নিশ্চিতভাবে জয়ের। আর সেটা যদি মোদি সরকারের দ্বারা করা সম্ভব হয় তবে আগামী নির্বাচনের ফলাফলও তাদের অনুকূলে থাকার সম্ভাবনা বেশি।

অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত পাকিস্তানের রিজার্ভ যেখানে মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলার সেখানে যুদ্ধ তাদের জন্য বিলাসিতার সামিল। আর সেজন্য সেদেশের পক্ষ থেকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অপরাপর শক্তিধর দেশগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাস্যা সমাধানের অনুরোধ জানালেও ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান কৌশলগত সুসম্পর্ক এবং পাক-চীন সম্পর্ক দুই দেশের আচরণকে যথেষ্টইভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর