সুন্দরবনে হরিণ নিধন ও কিছু কথা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

আলম শাইন | 2023-08-26 22:11:36

সুন্দরবনের মোট আয়তন দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার। তার মধ্যে বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত অংশের আয়তন ৩,৯৮৩ বর্গ কিলোমিটার। দু’টি অংশ মিলিয়েই সুন্দরবনের বিস্তৃতি। এই বিশাল আয়তনের বনটি ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্যতম ‘ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ’ হিসেবে স্থান পেয়েছে। এটি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্রমুখী সীমানার নিকটবর্তী গঙ্গা ও ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর মোহনায় অবস্থিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ‘ম্যানগ্রোভ’ অরণ্য। নি:সন্দেহে বলা যায় এটি প্রকৃতির অপূর্বসৃষ্টি।

এই শ্বাপদশংকুল বনটি যুগযুগ ধরে মানুষের কাছে এক রোমাঞ্চকর জঙ্গল হিসেবে পরিচিত। আর রোমাঞ্চকর বলেই হয়তো এ জঙ্গলের গুরুত্ব অপরিসীম পর্যটকদের কাছে। যার ফলে প্রকৃতির এ লীলাভূমি দর্শনের উদ্দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক ছুটে আসেন সুন্দরবন এলাকায়। ফলে পর্যটনখাতে আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি মাছ, মধু, গোলপাতা ও জ্বালানি কাঠ থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক ব্যবহৃত বহুবিধ জিনিস পেয়ে থাকি। পেয়ে থাকি বিশাল অংকের রাজস্বও। সেটি বিবেচণা করে সরকার ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছেন সুন্দরবনকে আগামী দশ বছরের জন্য সংরক্ষণ করার। সরকারের এই উদ্যোগের ভূয়ষি প্রশংসা না করে পারছি না আমরা। যদিও এ উদ্যোগটি নেয়া উচিত ছিল ঘূর্ন্নীঝড় সিডর বয়ে যাওয়ার পর পরই। তবে দেরিতে হলেও উদ্যোগটির প্রশংসার দাবি রাখেন সরকার।

সুন্দরবন দেশের জাতীয় সম্পদই নয়, এটি দেশের জাতীয় বনের মর্যাদাও পেয়েছে। সেই সুবাদে অরণ্যটির গুরুত্বও ব্যাপক। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্রও দুর্লভ। সুন্দরবনে প্রায় ৪২৫ প্রজাতির প্রাণী, ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদ। প্রাণীদের মধ্যে ৩০০ প্রজাতির পাখি, ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভয়চর প্রাণী রয়েছে। বিপন্ন প্রজাতির ইরাবতী ডলফিনেরও বাস সুন্দরবনের জলজ সীমানায়। অর্থাৎ সব মিলিয়ে সুন্দরবনের আকর্ষণ যেমনি রয়েছে তেমনি রয়েছে বহু প্রাপ্তিও। সে প্রাপ্তিটিও বিরাট অংকের। বছরে প্রায় ৫৮৫৬ কোটি টাকা।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনষ্টিটিউট (আইএফই এসসিইউ) এক সমীক্ষায় জানিয়েছেন তথ্যাদি। বিশদ ব্যাখ্যাও দিয়েছেন, পর্যটন থেকে বছরে আয় হয় ৪১৪ কোটি টাকা। বনজীবীদের আয় ১১৬১ কোটি টাকা। অপরদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে ৩৮৮১ কোটি টাকার সম্পদ।

সুন্দরবনের ৩০০ প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রাণী হচ্ছে চিত্রল হরিণ। সুন্দরবনের আর্কষণীয় প্রাণীদের মধ্যে বাঘ এবং চিত্রল হরিণ অন্যতম। বাঘের সংখ্যা অপ্রতুল হলেও হরিণের সংখ্যা সংখ্যা প্রচুর; দেড় লাখের ওপরে। ফলে সুন্দরবনের যত্রতত্র হরিণের সাক্ষাত ঘটে পর্যটকদের। বাঘের দেখা না পেলেও হরিণ দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারেন পর্যটকরা। মূলত পর্যটকদের আগমন ঘটে এই দুই প্রজাতির প্রাণী সাক্ষাতের লোভে। অথচ এই দুই প্রজাতির প্রাণীই বেশি নির্যাতিত হচ্ছে। বাঘের সংখ্যা অপ্রতুল বিধায় দু-একটি বাঘ শিকার হলেই কিংবা নির্যাতিত হলে হইচই পড়ে যায়।

অপরদিকে হরিণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। ডজন-ডজন হরিণ শিকার হলেও তা নিয়ে খুব বেশি হইচই হতে দেখি না আমরা। সুন্দরবনের চোরা শিকারিদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে হরিণ। বিভিন্নভাবে ওরা হরিণ শিকার করে। সুন্দরবনের যে সব এলাকায় হরিণের বিচরণ বেশি সেসব স্থানে নাইলনের জালপেতে, বিষ মাখিয়ে, স্প্রীং বসানো ফাঁদপেতে, কলার মধ্যে বড়শি ঝুলিয়ে, চেতনা নাশক ওষুধ দিয়ে, তীর অথবা গুলি ছোড়ে শিকার করে। এসব বেশি করা হচ্ছে হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, কটকা, তালপট্টি, কচিখালি, দুবলা চান্দেরশ্বর, বগি, চরখালি এলাকায়। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম বেড়ে যায় এতদাঞ্চলে। বিশেষ করে রাসমেলার মৌসুমে শিকারিরা বেপরোয় হয়ে ওঠে।

বিগত বছরের রাসমেলার মতো চলতি বছরের রাসমেলা চলাকালীন সময় বন বিভাগের লোকজনের হাতে ৫৭ জন গুপ্ত শিকারি আটকের ঘটনাও ঘটেছে সপ্তাহ দুয়েক আগে। হরিণ শিকারের সরঞ্জামাদিসহ হাতেনাতে আটক করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। সাধুবাদ জানাতে হয় তাই বনবিভাগকে।

রাসমেলাকে টার্গেট করার প্রধান কারণ হচ্ছে, এসময় পর্যটকের আনোগোনা বেড়ে যায়। ফলে চড়াদামে হরিণের মাংস বিক্রি করার সুযোগ পায় ওরা। এ ছাড়াও হরিণের চামড়া-শিং সৌখিন ব্যক্তিরা সংগ্রহ করে ড্রইংরুম সাজাতে। বনাঞ্চল এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিরা হরিণের মাংস খাইয়ে উৎসবাদিও পালন করেন। কোনো বড় ধরনের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কর্তাব্যক্তিদের খুশি করতে গোপনে হরিণের মাংস সরবরাহ করেন; এমন তথ্যও আমরা জানতে পেরেছি।

শুধু আমরাই নই, হরিণ নিধন সম্পর্কে লন্ডনের একটি সংস্থা, ‘ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাষ্ট অফ বাংলাদেশ ও জু-লজিক্যাল সোসাইটি’ তথ্য সংগ্রহ করেছে। সংস্থাটি বিম্ময়কর তথ্য প্রদানও করেছে। সংস্থার তথ্যমতে সুন্দরবনে বছরে প্রায় ১০ হাজারের বেশি হরিণ নিধন হচ্ছে! যা শুধু দু:খজনকই নয়, উদ্বেগও বটে! যে উদ্বেগ কাটাতে হলে বন বিভাগকে শিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। বন্যপ্রাণী নিধন আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে যথাযথ। জেল-জরিমানার পাশাপাশি পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে; মুক্তিপেয়ে যেন বেপরোয়া না হয়ে ওঠে ওরা। বিষয়টি নিয়ে খুব দ্রুত ভাবতে না পারলে প্রজাতির অস্তিত্ব বিলীন ঠেকানো মুশকিল হয়ে যাবে। কাজেই ‘ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাষ্ট অফ বাংলাদেশ ও জু-লজিক্যাল সোসাইটি’র তথ্যটিকে গুরুত্ব দিতে হবে সর্বাগ্রে।

আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ।

 

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর