ডাকসু নির্বাচন: যে পথ ধরে খুলল রুদ্ধ দুয়ার

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

রেজা-উদ্-দৌলাহ প্রধান | 2023-09-01 16:57:06

রেজা-উদ্-দৌলাহ প্রধান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক এই শিক্ষার্থী বর্তমানে কাজ করছেন বার্তা২৪-এর স্টাফ করেসপন্ডেন্ট হিসেবে। প্রায় তিন দশকের অচলায়তন ভেঙে সচল হতে চলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু। ডাকসুর অবরুদ্ধ দুয়ার উন্মুক্ত করার পেছনে আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি যুগপত আইনি লড়াই চালিয়েছেন যে ক’জন শিক্ষার্থী, রেজা-উদ্-দৌলাহ প্রধান তাদেরই একজন।তারা উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। আজকের এই ডাকসু নির্বাচন তাদেরই আইনি লড়াইয়ের ফল। ডাকসু নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি তুলে ধরেছেন সেই আন্দোলন-সংগ্রাম ও আইনি লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত।

গত কয়েক প্রজন্মের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ সংক্ষেপে ‘ডাকসু’ মানে ছিল ক্যাফেটেরিয়া ও সংগ্রহশালা। পড়ালেখার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সাংস্কৃতিক চর্চা ও নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশের প্লাটফর্ম যে ডাকসু সেটাও জানত না অনেকেই। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৯০-এর দশক পর্যন্ত সব আন্দোলন-সংগ্রামে ডাকসু নেতাদের কালজয়ী ভূমিকার কথা কেউ কেউ শুনেছেন স্মৃতি চারণায় কিংবা বইয়ের পাতায়। কিন্তু আজ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার পাটাতন বলে খ্যাত ‘ডাকসু’ সবার মুখে মুখে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনাকারী ডাকসু অকার্যকর ছিল প্রায় তিন দশক। সেই বন্ধ্যাত্ব এবার ঘুচতে যাচ্ছে।

২৮ বছর পর আজ আবারো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ডাকসু নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। তিন দশক পর ফের প্রাণ ফিরে পেতে যাচ্ছে ডাকসু ভবন। আর এই নির্বাচনকে ঘিরে এখন উৎসবমুখর গোটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। এই দীর্ঘ সময় পর কীভাবে এলো আজকের ডাকসু নির্বাচন, রুদ্ধ দুয়ার খোলার পেছনের ইতিহাস জানাতেই লেখাটির অবতারণা।

২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র সংসদ কার্যত অচল ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ১৯৭৩ সালের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী সিনেট সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত এবং আচার্যের মনোনীত একজন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করার কথা থাকলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। সিনেট সদস্যদের ভোটে নয়, আচার্যের মনোনয়ন নিয়েই বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করার রীতি চালু করেন উপাচার্যরা।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে শুরু করে আবাসিক হল, ক্লাসরুম সবখানেই আধিপত্য বিস্তার করে ক্ষমতাসীন উপাচার্যের পছন্দের ব্যক্তিরা। ফলে আবাসিক হলে শিক্ষার্থী নির্যাতন, ক্যাম্পাসে তুচ্ছ কারণে সহিংসতা, ক্লাসরুমে শিক্ষক কিংবা সহপাঠীর কাছে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নিপীড়ন, ক্লাসরুমে কিংবা পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে শিক্ষকদের স্বেচ্ছাচারিতার মতো অনিয়মের বিষয়গুলো এক ধরনের অলিখিত নিয়মে পরিণত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।

শিক্ষার্থীরা এসব ঘটনার শিকার হলেও প্রতিবাদ করার কোনো প্ল্যাটফর্ম ছিল না। শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার মতো কোনো সর্বজনস্বীকৃত নেতা ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এ সুযোগে ব্রিটিশদের দেখানো সেই পুরনো ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বেচ্ছাচারী প্রশাসন কায়েম করেছিল শিক্ষক ও তাদের পছন্দের শিক্ষার্থীরা। আমরা দেখলাম এই অশুভ চক্র ভাঙতে পারে একমাত্র কার্যকর ছাত্র সংসদ। সে জন্য ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়াজ তোলা শুরু করি আমরা।

আমি তখন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলাম। আমার বিভাগের কিছু সিনিয়র প্রায়ই ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। এমনকি আগেও তারা ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে বিচ্ছিন্ন আন্দোলন, সভা, সেমিনার, পাঠচক্র, প্রকাশনা বের করেছিলেন। কিন্তু এবার তারা আরো সংগঠিত ও বিস্তৃত আকারে আন্দোলন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

শিক্ষার্থীদের কমন একটি প্ল্যাটফর্ম করার চিন্তা-ভাবনা শুরু হয় ২০১১ সালের জুলাই থেকেই। এমনি এক প্রেক্ষাপটে ২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ডাকসু ভবনের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ’। ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন শুরু হয় এ মঞ্চ থেকে। দ্বিতীয় বর্ষের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে তখন প্রতিটি কর্মসূচিতেই ছিল আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।

মঞ্চের বেসক্যাম্প ছিল আমাদের মহসীন হলের ৪৬৪ নম্বর রুম। এই রুমের নাম ছিল ‘হট্টমন্দির’। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা, কর্মসূচী নির্ধারণ, ব্যানার, পোস্টার লিফলেট লিখন, সর্বোপরি ডাকসু নিয়ে সার্বিক আলোচনাই হত এইখান থেকে। মাসের পর মাস ধরে চলে আমাদের আন্দোলনের কর্মসূচি। সেগুলোর মধ্যে আছে অসময়ের কাগজের সহযোগিতায় জরিপ, স্মারকলিপি, মানববন্ধন, স্বাক্ষরগ্রহণ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতি খোলা চিঠি, সভা, সমাবেশ, সংহতি সমাবেশ, প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক আয়োজন, লিফলেট-বুলেটিন প্রকাশ, ক্লাসে ক্লাসে ক্যাম্পেইন, হলে হলে ক্যাম্পেইন এবং বিক্ষোভ মিছিল, ভিসির কার্যালয় অবরোধ, সিনেট সভা অভিমুখে বিক্ষোভ, ১৯ জুলাই ক্যাম্পাসে সর্বাত্মক ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে আমরা দীর্ঘদিনের মৃতপ্রায় ডাকসু-ইস্যুটিকে সেদিন পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চের আন্দোলনের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ছিলেন। তবে এই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের তুলনায় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল তুলনামূলক বেশি। বামপন্থী ছাত্র সংঠনগুলোর নেতাকর্মীরা এই আন্দোলনে বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখলেও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণও ছিল। আমাদের আন্দোলনে দল-মত নির্বিশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল প্রায় সকল প্রগতিশীল ও মুক্তমনা শিক্ষার্থী ও সংগঠনের নিবিড় সহযোগিতা পেয়েছিলাম আমরা। তেমনি অসহযোগিতা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।

আন্দেলন-সংগ্রাম স্বভাবতই একপর্যায়ে থেমে আসে। আমরা যখন আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যাচ্ছিলাম তখনই গণজাগরণ মঞ্চের আবির্ভাব ঘটে। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আমরা ডাকসু ভবন পেইন্টিং কর্মসূচীর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। বিকেলে খবর আসে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে অবরোধ শুরু হয়েছে। আমরাও দ্রুত সেখানে গিয়ে মানববন্ধনে যোগ দেই। কিছু সময় পরই স্বভাবতই সারাদেশ তখন উত্তাল হয়ে ওঠে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে। বাকীটা ইতিহাস! গণজাগরণ মঞ্চের দীর্ঘস্থায়ীত্ব আমাদের অধিকার মঞ্চের আন্দোলনকে আরো নিস্তেজ করে দেয়। একসময় আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেছিলাম, তাদের অনার্স-মাস্টার্স শেষ হয়ে আসে। যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারাও অনেকেই কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

আমরা শুধু মাঠেই আন্দোলন করেছিলাম সেটা নয়, রাজপথের পাশাপাশি আইনীভাবে আমাদের সংগ্রাম ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ জন শিক্ষার্থী উচ্চ আদালতে ডাকসু নির্বাচনের দাবীতে রীট করি। আমাদের আইনজীবি ছিলেন মনজিল মোরশেদ। তিনি আমাদের হয়ে স্বেচ্ছায় আইনী সহায়তা দেন। উচ্চআদালতে আমাদের রিটের পক্ষে একদিন শুনানিতেও অংশ নেই আমরা। এরপর একাধিকবার শুনানি পেছানো হয়। ডাকসু নির্বাচনের সেই রিট আবারও চাঙ্গা হয়ে ওঠে ২০১৭ সালে এসে।

২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত আবারও ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে অনশন করেন সমাজকল্যাণ অনুষদের সান্ধ্যকালীন শিক্ষার্থী ওয়ালিদ আশরাফ। ওয়ালিদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একঝাঁক বর্তমান শিক্ষার্থী সংহতি জানান। একপর্যায়ে বর্তমান উপাচার্য ওয়ালিদের অনশন ভাঙিয়ে নির্বাচন দেওয়ার আশ্বাস দেন।

২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি উচ্চ আদালত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ডাকসু নির্বাচনের নির্দেশ দেন। উচ্চ আদালতের আদেশের সাত মাস পেরিয়ে গেলেও নির্বাচনের কোনো আয়োজন দৃশ্যমান না হওয়ায় ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উকিল নোটিশ পাঠান আমাদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। জবাব না পেয়ে ১২ সেপ্টেম্বর উপাচার্যসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উচ্চআদালতে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন তিনি। এর পর উচ্চআদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে ঘোষণা দেয় ২০১৯ সালের মার্চের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে ডাকসু নির্বাচন।

সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি চূড়ান্তভাবে ডাকসু নির্বাচনের তারিখ ১১ মার্চ ঘোষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এভাবেই এলো আজকের ডাকসু নির্বাচন। এভাবেই ২৮ বছরের অচলায়তন ভেঙে আজকের ডাকসু নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।

আমরা চাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাণের সংগঠন ডাকসু কার্যকর হোক। ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসুক আগামীর উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের নেতৃত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থী সমান আত্মমর্যাদা বিচরণ করুক নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় এটিই প্রত্যাশা। সেই সঙ্গে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি। কারণ একমাত্র কার্যকর ছাত্র সংসদ ও নির্বাচিত নেতৃত্বই পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে। আমাদের ‘মুক্ত ও স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়’ আমরাই গড়ব এটাই হোক শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অঙ্গীকার।

রেজা-উদ্-দৌলাহ প্রধান: স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম ও ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে উচ্চ আদালতে অন্যতম রিটকারী।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর