নিউজিল্যান্ডে ‘কালো দিন’ ও মুসলিম-বিদ্বেষ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-26 11:03:46

শুক্রবার সকালটা ছিল বিশ্ববাসীর জন্য অনেক বিষাদের। সকালে ঘুম থেকে উঠেই খবর মিলল, নিউজিল্যান্ডে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৫০ জন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। এই হামলায় নিহত হয়েছেন বাংলাদেশেরও তিনজন নাগরিক। আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। মসজিদে পৌঁছাতে দেরি হওয়ার কারণে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের সদস্যরা। তাদেরও ওই মসজিদে নামাজ আদায়ের কথা ছিল। কিন্তু তারা পৌঁছোনোর মিনিট পাঁচেক আগেই মসজিদে নারকীয় হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্যরা সেখান থেকেই নিরাপদ স্থানে চলে আসেন।

নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব পাশাপাশি মুসলিম বিদ্বেষের কারণে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে প্রায় ৫০ জন মুসল্লিকে হত্যা করেছেন ব্রেনটন ট্যারেন্ট নামে এক সন্ত্রাসী। তাকে ‘শ্রেষ্ঠত্ববাদী অস্ট্রেলিয়ান শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী’ হিসেবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বর্ণনা করা হচ্ছে। ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলাটি ছিল সুপরিকল্পিত। এ হামলার আগেই হামলাকারী টুইটারে ৭৩ পাতার ইশতেহার আপলোড করে হামলার ঘোষণা দেন।

হামলাকারীর বর্ণনা অনুসারে, ইউরোপের মাটিতে সরাসরি অভিবাসীদের সংখ্যা কমাতেই এই হামলা চালায় সে। এই ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের পর অভিবাসী ও ইসলামপন্থি জঙ্গিদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে ব্রেন্টন। তার মতে, ‘‘আমাদের দেশ কখনোই তাদের হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত একজন শ্বেতাঙ্গও জীবিত থাকবেন ততক্ষণ আমাদের দেশ আমাদেরই। তারা কখনোই আমাদের ভূমিদখল করতে পারবে না।’’

দু'বছর ধরেই এমন হামলার পরিকল্পনা করে আসছিল বলে জানিয়েছে ব্রেনটন। তিনমাস আগেই ক্রাইস্টচার্চে হামলার সিদ্ধান্ত নেয়সে। তবে নিউজিল্যান্ডই তার হামলার মূল লক্ষ্য ছিল না বলেও উল্লেখ করে সে। বক্তব্যে ইসলামপন্থি জঙ্গি ও অভিবাসীদের ‘হামলাকারী’ আখ্যা দিয়ে নিউজিল্যান্ডে হামলার মাধ্যমে তাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে বলে জানিয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলা এবং এসব হামলার সঙ্গে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সংশ্লিষ্টতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। ক্রাইস্টচার্চের ঘটনাটি তারই সর্বশেষ প্রকাশ। আসলে ইউরোপ-আমেরিকায় অনেকে মুসলিম ও জঙ্গিবাদ সমার্থক মনে করছেন। জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দায়ী করে পশ্চিমাদের এই মুসলিম বিদ্বেষ বিশ্বজুড়ে এক নতুন সংকট সৃষ্টি করছে।

ইসলাম এবং জঙ্গিবাদকে সমার্থক করে দেখার বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমেও অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এর আগে ভ্যাটিকানের পোপ পর্যন্ত বলেছিলেন, “সহিংসতার সঙ্গে ইসলামকে একাত্ম করে দেখা ঠিক নয়। এটা ঠিক নয় এবং এটা সত্যও নয়।” এ ধরনের কথা অনেক বুদ্ধিজীবীও বলেছেন। কিন্তু তাতে ইউরোপ-আমেরিকার সাধারণ মানুষের মনোভাবে বদলাতে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ইউরোপ-আমেরিকা ওদের ভাষায়, ‘ইসলামিস্ট টেরোরিস্ট’ আতঙ্কে ভুগছে।

আবার এটাও ঠিক যে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, বেলজিয়াম, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র– সব দেশই জিহাদি হামলা হয়েছে। ‘রাজনৈতিক ইসলামের’ জঙ্গি, ওয়াহাবি-সালাফি জিহাদ অনেক দেশেই ‘রপ্তানি’ হয়েছে এবং হচ্ছে। আর এতে সম্প্রসারিত হচ্ছে ইউরোপের দেশে দেশে বসবাসকারী লাখ লাখ মুসলিমের বিরুদ্ধে সন্দেহ, বিদ্বেষ, জাতি-ঘৃণা এবং আক্রমণ। নিউজিল্যান্ডের হামলার ঘটনাটি তারই নজির।

যে উদার নীতি অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন মারফত পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে অগণিত মুসলিম ও প্রাচ্য দেশীয়ের ভাগ্যান্বেষণ উৎসাহিত করেছিল, তা সংকুচিত করে পুবের সব দরজা বন্ধকরে দেওয়ার দাবি উঠতে শুরু করেছে। দেশে দেশে এখন মুসলিম অভিবাসনের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান গ্রহণ কারীরাই জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হচ্ছেন।

আমেরিকায় ট্রাম্প মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন। জার্মানিতেও ইসলাম-আতঙ্ক দক্ষিণপন্থী নব্য-নাৎসিদের শক্তিশালী করে তুলছে। ফ্রান্সে ইসলাম বিরোধী স্লোগান অতি-দক্ষিণ ন্যাশনাল ফ্রন্টকে জনপ্রিয় করে তুলছে।

ইসলাম-আতঙ্ক এমনকি সুইডেন বা ব্রিটেনের মতো সহনশীল গণতন্ত্রকেও মুসলিমদের প্রতি অসহিষ্ণু করে তুলছে। বছর দুই আগে সুইডেনে পর পর তিনটি মসজিদে অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীরা হামলা চালিয়েছে। মসজিদের দেওয়ালে ‘মুসলমানরা বিদায় হও’ স্লোগান লেখা হয়েছে। কুইন্সল্যান্ডের রেস্তোরাঁর দরজায় ‘মুসলিমদের প্রবেশ নিষেধ’ লেখা বোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টির প্রধান ইউরোপের ‘নব্য-অটোমান দখল’এর আশঙ্কা প্রচার করছেন। নেদারল্যান্ডসে পার্টি ফর ফ্রিডম বলছে: মরক্কোর মুসলিমদের তাড়াও, হল্যান্ডকে ইসলামমুক্ত করে। সে দেশের ৪৭৫টি মসজিদের এক-তৃতীয়াংশের দেওয়ালে হয় নাৎসি স্বস্তিকা চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়েছে, নয়তো বোমা মারা হয়েছে।

ইউরোপের ইসলাম বিরোধী, অভিবাসন বিরোধী দলগুলোর সমর্থন হু হুকরে বেড়ে চলেছে। ব্রিটেনের দক্ষিণপন্থী ইন্ডিপেনডেন্স পার্টির জনসমর্থনও দ্রুত বাড়ছে। একদিকে জার্মানি, বেলজিয়াম ও ফ্রান্সে জিহাদি সন্দেহে মুসলিমদের বাড়িতে হানা দেওয়া, তাদের গ্রেফতার করা, গুলি চালিয়ে দেওয়ার ঘটনা হঠাৎ বেড়ে গেছে–অন্যদিকে সুইডেন থেকে কানাডা, স্পেন থেকে অস্ট্রেলিয়া, সর্বত্র সন্ত্রাস ও জিহাদ রোধ করার নামে রকমারি দমনমূলক আইনকানুন প্রণয়ন করা হচ্ছে। ইউরোপে মুসলিমরাক্রমেই সন্দেহের পাত্রে পরিণত হচ্ছে। ইহুদি-বিদ্বেষে নাৎসিরা যে সন্দেহ, অবিশ্বাস, ঘৃণা লালন করত– আজ ইসলাম সম্পর্কে, মুসলিম জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সেই একই বিষাক্ত সংশয় ঘনিয়ে তোলা হচ্ছে ।

নামাজের সেজদারত অবস্থায় যদি কাউকে গুলি খেয়ে মরতে হয়, সেটা কেমন সমাজ, কেমন দেশ? এর চেয়ে সন্ত্রাস ও অপরাধ আর কি হতে পারে? এটা রীতিমতো ‘আগ্রাসী সন্ত্রাসবাদ’ যা কার্যত সংখ্যালঘুর আত্মপরিচয়ের অভিজ্ঞানেই আঘাত করে। তার ধর্মের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে। জিহাদিরা কিন্তু ঠিক এটাই চাইছে। তাদের লড়াই তোআসলে কিছু গোঁড়া ধর্মান্ধ লোকের সংকীর্ণ, নোংরা ধান্দাবাজি। কিন্তু সেটাকেই তারা পবিত্র ধর্মযুদ্ধ বলে চালাতে চায়।

তাই এই মতলববাজ ঘাতকদের অভিপ্রায় বানচাল করতে আরও সতর্কতাচাই, চাই সহিষ্ণুতার সংস্কৃতির চর্চা। অন্য ধর্ম, ভিন্ন গোষ্ঠীকে বোঝার, শ্রদ্ধা করার মানসিকতা। কিন্তু বিশ্বজুড়ে আজ সেটারই যে সবচেয়ে বড় অভাব!

অনেকে বলেন, মুসলমানরাই কি টুইন টাওয়ার ধ্বংস করেনি? মুসলমানরাই কি শার্লি এবদোর ঘটনা ঘটায়নি? মুসলমানরাই কি প্যারিস কিংবা নিসে হত্যালীলা চালায়নি? আর মুসলমানরাই কি আইএস তৈরি করেনি? করেছে তো! কিন্তু সে জন্য সব মুসলমান কি খারাপ?

আজকাল প্রায় প্রতি সপ্তাহে মানসিক ভারসাম্যহীন কিন্তু আপাত-সুস্থকিছু সাদা আমেরিকান স্কুল-কলেজে গিয়ে গুলি চালাচ্ছে, বাচ্চাদের মেরেফেলছে– তাদের মতো দেখতে গোটা আমেরিকান জাতটাকেই তো তাহলেভয় পেতে হয়– সব মুসলিমকে ‘সন্ত্রাসী’ সন্দেহ করার যুক্তি মানলে। কই, আমেরিকার লোকজন তো তাদের সন্ত্রাসী বলে ভয় পায় না, মানসিক রোগী হিসেবেই চিহ্নিত করে!

তাহলে মুসলমানদের ক্ষেত্রে বা ‘তাদের মতো দেখতে’ মানুষজনের ক্ষেত্রেএই ভিন্ন ব্যবহার কেন? তার কারণ, সাংস্কৃতিক দূরত্ব, পরিচয়হীনতা। জানা শোনার অভাব। ইউরোপ-আমেরিকার অধিবাসীদের একটা বড়অংশ শুধু জানে যে, মুসলমান মেয়েরা বোরকা পরে, মুসলমান ছেলেদের দাড়ি থাকে আর তারা ‘সন্ত্রাসবাদী’। ইউরোপ-আমেরিকা মুসলমানদের চেনে না, জানে না, চিনতে চায় না, জানতে চায় না। কিন্তু যদি জানতে চাইত, তাহলে দেখত যে, ৯/১১এর পর থেকে ১৩ বছরে আমেরিকান-মুসলিমরা মোট যত লোক মেরেছে, শুধু ২০১৭ সালে অন্যান্য পাইকারি বন্দুক বাজিতে তার প্রায় তিনগুণ বেশি লোকের প্রাণ গেছে।

দেশে দেশে এখন মুসলিম অভিবাসনের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান গ্রহণ কারীরাই জনপ্রিয় হচ্ছেন। ইউরোপে-আমেরিকায় মুসলিমদের সম্পর্কে এক ‘অজানা ভয়’ বাড়ছে। মুসলিমরা তাদের কাছে ‘অপরিচিত’, তাই ভয়ের। অন্ধকারও অপরিচিত, তাই ভয়ের। অপরিচয় থেকে ভয়, ভয়থেকে গভীর অবিশ্বাস, সেই অবিশ্বাস গড়ছে মানসিক হিংসা। সেইলালিত হিংসাই মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বানিয়ে তুলছে অপরাধী। এফবিআইএর রিপোর্ট বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১এর আগে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যত ‘হেইট-ক্রাইম’ হত, এখন হয় তার পাঁচ গুণ। মুসলিমরা সেখানে অবহেলিত, বিচ্ছিন্ন।

মুসলিম যদি গুলি চালান, যদি বিমান ছিনতাই করেন, যদি তিনি হনমানব-বোমা– এই ভয়াতুর অবিশ্বাসের ঘূর্ণিতে পড়ে তাঁকে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অপমান করা হচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ অন্যায়। তিনি যে বিপজ্জনক, এমন প্রমাণ মেলেনি। তাঁর একটি মাত্র অপরাধ, তিনি ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির।

অপমান থেকে ক্রোধ জন্ম নেয়। একজনকে ভয় পেয়ে দূরে ঠেলে দিলে সে-ও ভয় পেয়ে যায়। সাপ নাকি এই যুক্তিতে ছোবল মারে। এটা একটা দুষ্টচক্র। আক্রমণকারী আর আক্রান্ত দুপক্ষই ভয়ে দিশেহারা। দুপক্ষই নিজেকে বাঁচানোর জন্য ঝাঁপায়। আর এই তাড়নাতেই মানুষ একটা সময়বোধ হারিয়ে মুহূর্তের উদভ্রান্তিতে বাঁচার মরিয়া চেষ্টায় অপরাধ করে বসে।

তাহলে এর সমাধান কোন পথে? না, কোনো রেডিমেড পথ বা পদ্ধতিনেই। অচেনা অপরিচিতকে চেনা-জানা-বোঝার চেষ্টা করা, ‘আপন করে নেওয়া’ ছাড়া আর কোনো ঠিকঠাক উপায় আপাতত দেখা যাচ্ছে না।সিদ্ধান্তটা ইউরোপ-আমেরিকাকেই নিতে হবে।

নিউজিল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী এ দিনটিকে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের অন্যতম কালো দিন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ‘নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব‘ জাহির আর ‘মুসলিম বিদ্বেষ’-এর ঘেরাটোপ থেকে পুরো ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকাকে বের করে করে আনতে না পারলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন ‘কালো দিন’ ঘুরে ফিরেই আসতে পারে!

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।

এ সম্পর্কিত আরও খবর