রক্তপাতে শান্তির দ্বার খোলে না

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মুফতি এনায়েতুল্লাহ | 2023-08-28 22:18:07

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদে স্থানীয় সময় শুক্রবার (১৫ মার্চ) বেলা দেড়টার দিকে জুমার নামাজ আদায়রত মুসলিমদের ওপর হামলা চালায় অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ‘ব্রেন্টন টারান্ট’। এর কিছুক্ষণ পর শহরের লিনউডএভিনিউয়ের আরেক মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় ডিনস এভিনিউয়ের আল নুর মসজিদে ৪১ জন ও লিনউড এভিনিউয়ে ৭ জন ঘটনাস্থলে মারা যান। হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান লিনউডে আহতদের আরেকজন। বিশ্বের শান্তি প্রিয় মানুষ এ হামলায় মর্মাহত ও ব্যথিত।

হামলার ঘটনা বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে, হামলাকারী ওই খ্রিস্টান জঙ্গি প্রশিক্ষিত। এমনকি সে এই হামলার পেছনে ভাবাদর্শিক মেনিফেস্টো প্রচার করেছে এবং হামলার ভিডিও করেছে। মুসলমানবিরোধী তীব্র ঘৃণার গভীরতা এবং তারভাবাদর্শিক ব্যাপকতা এসব তথ্য থেকে স্পষ্ট। এই হামলা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, কারণ হামলাকারী নিজে ঘটনার ভিডিও করে প্রচার করেছে। সে বিশ্বের সামনে এটাকে একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে আনতে চেয়েছে এবং তাতে ব্রেন্টন অনেকটাই সফল।

ইউরোপের মাটিতে সরাসরি অভিবাসীদের সংখ্যা কমাতে হামলা চালায় সে। এই ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের পর অভিবাসী ও ইসলামপন্থীদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে ব্রেন্টন। শ্বেতাঙ্গদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং শ্বেতাঙ্গ শিশুদের ভবিষ্যতনিশ্চিত করা উচিত বলেও উল্লেখ করে সে। ইউরোপজুড়ে বিদেশি ‘হামলাকারী’দের হাতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতেই এই হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি ব্রেন্টনের।

নিউজিল্যান্ডের এই ঘটনা প্রমাণ করে, ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলের মুসলমানদের অসহায়ত্ব। তথাকথিত ‘ইসলামভীতি’র নামে কট্টর জাতীয়তাবাদীদের মাঝে কতটা নিচু ও ঘৃণ্য মনোভাব লুকায়িত তা স্পষ্ট। সুতরাং এই হামলাকে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, আরাকানের ঘটনাবলী থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইসলামফোবিয়ার নামে ঘৃণার উদগীরণ ও নির্যাতনের যে চিত্র দেখা যায়, এই হামলা তারই একটি চিত্র বিশেষ।

এসব হামলা, হামলা পরবর্তী ঘটনা পরিক্রমা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বৈশ্বিক রাজনীতির অংশ। এটা নিয়ে কথা বলার কিছু নেই। হামলাকারী সন্ত্রাসী। তার কোনো ধর্ম নেই, তার কোনো দেশ নেই। সে সবার জন্য ক্ষতিকর। তার কাছে কেউ নিরাপদ নয়, সে বিশ্বের জন্য, বিশ্ববাসীর জন্য, তাবৎ জীব-জন্তু এমনকি মাটির জন্যও নিরাপদ নয়।

কিন্তু কোনো মুসলিম সংগঠন ও ব্যক্তি দ্বারা যখন এমন ঘৃণ্য ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা ঘটে, তখন প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নাম, বংশ ও ধর্মীয়পরিচয়সহ নানা বিষয়ে একাধিক অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ হতে দেখা গেছে অতীতে। কিন্ত নিউজিল্যান্ডের এই ঘটনার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা গেল। এটা কি মিডিয়ার ব্যর্থতা না ইচ্ছাকৃত ভুল তা স্পষ্ট নয়। নাকি সে মুসলিম নয় বলে তার প্রতি এমন দয়ার্দ্র আচরণ, তাও স্পষ্ট নয়। বিষয়টি আমাকে মারাত্মকভাবে পীড়িত করেছে। কোনো মুসলিম যদি সন্ত্রাসী হামলা চালায়, তবে তাকে ইসলামী জঙ্গি বলে আখ্যায়িত করা হয়, যেটা খ্রিস্টান হামলাকারীর ক্ষেত্রে বলা হয় না। আগেই বলেছি, সন্ত্রাসীর একমাত্র পরিচয় সে সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসী যে ধর্মেরই হোক না কেন তার আসল পরিচয় সে সন্ত্রাসী। সব ধর্মের জন্যই সে ক্ষতির কারণ।

ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে যে হামলা হয়েছে সেটি পুরোপুরি মুসলিম সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে করা হয়েছে। হামলাকারীর প্রকাশিত ৭৪ পৃষ্ঠার মেনিফেস্টো থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এটি একটি বর্ণবাদী হামলা, প্রচণ্ড রকম মুসলিমবিদ্বেষ থেকে সে এই হামলা করেছে। হামলাকারী শ্বেতাঙ্গ এবং সে বিশ্বাস করে, মুসলিম অভিবাসীদের জন্য শ্বেতাঙ্গরা জায়গা হারাচ্ছে, ফলে সে মুসলিমদের নির্মূল করতে চায়। এই হামলাটি সেক্ষেত্রে অবশ্যই একটি জঙ্গি হামলা।

আসলে আমরা মনে করি, আমাদের উচিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক হয়ে কথা বলা। এই হামলার জন্য হয়তো আবার কোনো মুসলমান খ্রিস্টানদের ওপর হামলা করবে, সেই হামলার জন্য কোনো খ্রিস্টান আবারও হামলা করবে কোনো মুসলমানের ওপর। এই বিদ্বেষ হামলা দিয়ে মেটানোর নয়। এটা মেটাতে হবে ন্যায়বিচার দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, মানবতা দেখিয়ে।

মানছি, জঙ্গি হামলা যেকোনো ধর্মের যেকোনো মানুষ করতে পারে। ফলে ‘ইসলামি জঙ্গি’, ‘মুসলিম সন্ত্রাসী’ জাতীয় শব্দ এখনই পুরোপুরি নির্মূল করা উচিত। অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি যে বিরূপ মন্তব্য আমরা প্রতিনিয়ত ছুঁড়ছি, তা দিয়ে জয়লাভ করা কখনোই সম্ভব না। অতীতেও আঘাত করে, বোমা মেরে, অবরোধ ডেকে হিংসা-বিদ্বেষ দূর করা যায়নি; ভবিষ্যতেও যাবে না। হিংসা কখনও হিংসা নির্মূল করে না, রক্তপাত দ্বারা শান্তির দ্বার খোলে না। একটা সহিংস ঘটনা আরও অনেক সহিংস ঘটনার জন্ম দেয়। এটাই পৃথিবীর নিয়ম।

মসজিদে হামলা অবশ্যই নিন্দনীয় ঘটনা। কিন্তু বিভিন্ন দেশে এটা ঘটছে। এর পরিসংখ্যানও বেশ বড়। উদার গণতান্ত্রিক দেশ কানাডা, সুইডেন ও ফ্রান্স সবদেশেই মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এবার হামলা হলো শান্তির দেশ বলে খ্যাত নিউজিল্যান্ডে। আমাদের একান্ত প্রার্থনা, এটাই হোক বিশ্বের শেষ রক্তপাতের ঘটনা। আমরা রক্ত দেখতে চাই না। রক্তাক্ত মানুষের আহাজারি শুনতে চাই না। কোনো মায়ের বুক খালি হোক, কোনো শিশু অভিভাবকহীন হোক- এটা দেখতে চাই না। আমরা চাই, শান্তির পৃথিবী, শান্তিময় পৃথিবী।

ইসলাম কোনো ধর্ম সম্প্রদায় কিংবা তাদের উপাসনালয়ের ওপর আঘাত হানার বিষয়কে অনুমোদন দেয় না। ইসলামে এ ধরনের আচরণ অন্যায় ও ভীষণ পাপের কাজ হিসেবে বিবেচিত। একইসঙ্গে নিজ ধর্মের সম্মান রক্ষা ও মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা মুসলমানদের কাছে এক পবিত্র দায়িত্ব। তাই নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলার ঘটনায় মুসলমান মাত্রই ব্যথিত ও মর্মাহত। কিন্তু মুসলমানদের এ বেদনা যেন বর্তমান বিশ্বের হর্তাকর্তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম নন। মুসলমানদের উপাসনালয়ে যখন হামলা চালানো হয়, তখন তাদের অধিকার সম্পর্কে পৃথিবীর মিডিয়া ও মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়নরা নিশ্চুপ থাকে। এটা কি ডবল স্ট্যান্ডার্ড নয়? মসজিদে হামলা হলে সেটা কি সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী ঘটনা নয়? অথচ এই ঘটনা সম্পর্কে কাউকে তেমন উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় না। এ কারণে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মুসলমানরা নিজেদের ‘অত্যাচারিত’ হিসেবে মনে করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিক্ষুব্ধ মুসলমানরা যেক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকে তার মূল কারণ কিন্তু এখানেই নিহিত। সহাবস্থান ও সহমর্মীতাই শান্তির মূল নিয়ামক। হিংসা দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

বিশ্বে শান্তি ও প্রগতির জন্য প্রয়োজন বৈষম্যমূলক আচরণের বদলে ন্যায়বিচার। বিশেষ উদ্দেশ্যে, প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে বিশেষ কোনো ধর্ম গোষ্ঠীর লোককে সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করলেই বিশ্ব থেকে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর হয়ে যাবে বিষয়টি এমন নয়। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলার নৈতিকতা অর্জন করলেই কেবল এ পৃথিবী মুক্ত হতে পারে সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতাসহ বিভিন্ন অনাচার থেকে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাই উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।

আল্লাহতায়ালা মানুষকে ইচ্ছাশক্তির স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাই সেখানে কারও হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। কিন্তু মানুষের এই স্বাধীনতা যাতে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বিশ্বের ক্ষতিসাধন করতে না পারে, সে জন্য সংশ্লিষ্ট সমাজ ও রাষ্ট্রে কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। কিন্তু এমন কোনো বিধি-বিধান প্রণয়ন করা যাবে না, যার মাধ্যমে মানুষের ধর্মীয় অধিকার কিংবা মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হয়। এই নিরীখে বর্তমান সময়ে আমরা সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসের প্রতি অনীহা প্রকাশ করি, এসব সমর্থন করি না।

কিন্তু লক্ষণীয় হলো, যখনই কোনো সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে সঙ্গে সঙ্গে এর সাথে ইসলাম ও মুসলমানকে যুক্ত করার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যেন সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে অন্য কোনো সম্প্রদায় বা অন্যকোনো মহলের কোনোই যোগসূত্র নেই। এমন একচোখা নীতি ও চিত্র যে বর্তমান বিশ্বের প্রকৃত চিত্র নয় তা অনুসন্ধানী পাঠক মাত্রই জানেন। তার পরও বছরের পর বছর আমরা তাই দেখছি। কিন্তু এর ফলে কি বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। সন্ত্রাসীদের নিয়ে রাজনীতি করলে তাতে সন্ত্রাসবাদকেই মদদ দেয়া হয়। আমরা যেকোনো সন্ত্রাসবাদেরই বিরোধীতা করি। সব ধর্মই সন্ত্রাসের বিরোধীতা করে। সন্ত্রাসের সাম্প্রদায়িকীকরণ মূলত বিশ্ব মোড়লদের রাজনীতিরই অংশ। সন্ত্রাসীরা এই রাজনীতির সুযোগ নেয় মাত্র। তাই হিংসা ও দোষারোপের এই রাজনীতি থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে। সন্ত্রাসীদের বিচারের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হোক, সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদ নিপাত যাক-এটাই কাম্য।

মুফতি এনায়েতুল্লাহ: বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর