বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সমাজ দর্শন

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান | 2023-09-01 16:52:18

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মদিন আজ। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানের সব ধরনের বৈষম্যের জবাব দিয়ে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ছিনিয়ে আনা বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৭ মার্চ, ১৯২০ সাল (মঙ্গলবার রাত ৮টায়), প্রাক্তন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে।

বাবুই পাখি, দোয়েল, শালিক ও ময়না পাখির প্রতি বিশেষ দূর্বলতা ছিল তাঁর। গ্রীষ্ম ও শীতের ধুলোবালি, হেমন্তে নবান্নের নতুন ফসলের মৌ মৌ গন্ধ ও আর বর্ষার কর্দমাক্ত পরিবেশে বড় হওয়া বঙ্গবন্ধু প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন বলে খালের পাড়ে বসে মাছরাঙার মাছ শিকার; কাঠঠোকরার গাছের বাকল ফুঁটো করার কৌশল এবং রূপসী বাংলার অপরূপ দৃশ্য গভীর মনোযোগ দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে দেখতেন। গ্রামের সবুজ-শ্যামল পরিবেশে দূরন্তপনা, ফুটবল ও হা-ডু-ডু খেলার অন্তপ্রাণ, নদীতে দলবেঁধে সাঁতার কাটা ছিল তাঁর নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোরে গ্রামীণ জনপদের স্পর্শ পেয়েছিলেন বলেই হয়তবা আকাশসম হৃদয়ের অধিকারী হতে পেরেছিলেন।

শৈশব থেকেই বঙ্গবন্ধু চিন্তার গভীরে মমত্ববোধের সঙ্গে স্বদেশপ্রেম, মানবতাবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবোধ প্রতিপালন করতেন যার প্রতিচ্ছবি তাঁর পরবর্তী জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে বারবার। শৈশবে বৃষ্টিতে ভেজা খেলার সাথীক নিজের ছাতা; দরিদ্র্য সহপাঠীকে নিজের নতুন বই; শীতার্ত অসহায় মানুষকে নিজের শীতবস্ত্র; অন্নহীন মানুষকে নিজের পারিবারিক ধানের গোলা থেকে ধান দিয়ে দেওয়ার ঘটনাগুলো প্রমাণ করে তাঁর মহানুভবতা, উদারতা ও মানবিক মূল্যবোধের প্রাধান্য ছিল আকাশছোঁয়া। দশ বছর বয়সে যখন নিজের জামা অন্যকে দিয়ে ভাবলেশহীন হয়ে বাড়িতে ফিরেছিলেন, তখন তাঁর মমতাময়ী মা বুঝেছিলেন ছেলের মহানুভবতা।

শাশ্বত গ্রামীণ জনজীবনের হাসি-কান্না গভীরভাবে অবলোকনের কারণে মানুষের কষ্ট সহজে বুঝতেন তিনি। কারণ গ্রাম, মাটি আর মানুষ তাঁকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল । বৃটিশ জমিদার, জোতদার, মহাজন, তালুকদারের অত্যাচার, শোষণ ও জুলুম খুব কাছ থেকে দেখেছেন বঙ্গবন্ধু । একই গ্রামের মধ্যে মুসলিম-হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্মিলিত সামাজিক জীবনযাপন তাঁকে অসাম্প্রদায়িকতার দীক্ষা যুগিয়েছিল। তাঁর অসাম্প্রদায়িক অবস্থান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি মানুষকে মানুষ হিসবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ’’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা:১৯১)।

খেলার মাঠের অধিনায়ক, শিক্ষকের প্রিয় ছাত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজক ও স্বেচ্ছাসেবক বঙ্গবন্ধুর শৈশব কেটেছে টুঙ্গিপাড়া গ্রামের ধুলি-বালি-মাটিতে। বাড়ির পাশের বাইগার ও মধুমতি নদীর স্রোতের সঙ্গে সখ্যতা বোধহয় বহুদূর বয়ে চলার শক্তি দিয়েছিল তাঁর। নিজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখলেন, ‘‘আমি খুব রাগী ও একগুঁয়ে ছিলাম, কিছু বললে কড়া কথা বলে দিতাম। কারও বেশি ধার ধারতাম না। আমাকে যে কাজ দেওয়া হত, আমি নিষ্ঠার সাথে সে কাজ করতাম। কোনোদিন ফাঁকি দিতাম না। ভীষণভাবে পরিশ্রম করতে পারতাম। সেই জন্যই আমি কড়া কথা বললেও কেউ আমাকে কিছুই বলত না। ছাত্রদের আপদে-বিপদে আমি তাদের পাশে দাঁড়াতাম। কোন ছাত্রের কী অসুবিধা হচ্ছে, কোন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পায় না, কার ফ্রি সিট দরকার, আমাকে বললেই প্রিন্সিপাল ড. জুবেরী সাহেবের কাছে হাজির হতাম। আমি অন্যায় আবদার করতাম না। তাই শিক্ষকরা আমার কথা শুনতেন। ছাত্ররাও আমাকে ভালোবাসত (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্টা:৩৭)।’’

তাছাড়া তাঁর স্বভাবের বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ‘স্পষ্টবাদিতা’ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘‘আমি মুখে যা বলি তাই বিশ্বাস করি। আমার পেটে আর মুখে এক কথা। আমি কথা চাবাই না। যা বিশ্বাস করি বলি। সে জন্য বিপদেও পড়তে হয়। এটা আমার স্বভাবের দোষও বলতে পারেন, গুণও বলতে পারেন” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্টা:২১৮)।

তাঁর বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর, তখনকার প্রতিবাদ দেখে স্বয়ং পুলিশের বড় কর্মকর্তা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। গোপালগঞ্জে স্বদেশী আন্দোলনের এক জনসভায় পুলিশ নির্বিচারে লাঠিচার্জ করলে বন্ধুদেরকে নিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ফাঁড়িতে ইট-পাথর নিক্ষেপ করেছিলেন। ক্রমান্বয়ে ‘মিয়া ভাই’ হিসেবে নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠা পান তিনি। তবে, কিছু মানুষের রোষানলেও পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন: ‘‘… গোপালগঞ্জ শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি আমার আব্বাকে বলেছিলেন, আপনার ছেলে যা আরম্ভ করেছে তাতে তার জেল খাটতে হবে। তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে, তাকে এখনই বাধা দেন। আমার আব্বা যে উত্তর করেছিলেন তা আমি নিজে শুনেছি। তিনি বলেছিলেন, দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাব না। জীবনটা নষ্ট না-ও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দিব না (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্টা: ২১।’’

শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের ‘গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল’ পরিদর্শনে আসাকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় বিরোধ দেখা দিলে তিনি নোংরা রাজনীতির শিকার হন এবং জীবনে প্রথমবারের মতো সাতদিনের জন্য হাজতবাস করেন। পরবর্তীতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে এলে স্কুলের ছাত্রাবাসের দুরাবস্থার বিষয়টি তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। দুরন্ত কৈশরে বঙ্গবন্ধুর সাহস, মেধা, ও ধী-শক্তির বৈশিষ্ট্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করলে তিনি শেখ মুজিবকে আপন করে নেন। শেখ মুজিবও গণতন্ত্রের মানসপুত্রের সংস্পর্ষ-সান্নিধ্যে গভীর এক আচ্ছন্নের মায়ার বাঁধনে বাঁধা পড়েন। শুরু হয়ে যায় তাঁর রাজনীতির পথচলা। ত্যাগ, সাধনা, রাজনীতি ও জনগণের সুখী জীবনের গভীর উপলব্ধির বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘যেকোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত না, তারা জীবনে কোনো ভালো কাজ করতে পারেনি—এ বিশ্বাস আমার ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম এ দেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে…” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা: ১২৮)।

তবে রাজনৈতিক জীবন নিয়ে তাঁর পিতার দার্শনিক উপদেশ জীবনে কোনোদিন ভুলতে পারেননি তিনি। তিনি লিখেছেন, “আব্বা আমাকে এ সময় একটা কথা বলেছিলেন, ‘বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, “sincerity of purpose and honesty of purpose” থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না’। একথা কোনোদিন আমি ভুলি নাই” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা: ২১)।

রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকার ও তার অনুষদবর্গের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অকপটে ঘোষণা করেন, ‘আমরা এ দেশের শাসক নই, আমরা এ দেশের সেবক এ কথা মনে রাখতে হবে। জনগণের সেবার জন্যই আমরা নির্বাচিত হয়েছি এবং তাদের সেবাতেই আমাদের আত্মনিয়োগ করতে হবে’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, পৃষ্ঠা:৯২৮) ।

৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ পাকিস্তানের লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন যা ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পরিপূর্ণ রূপরেখা। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুদিবসে আলোচনায় স্বাধীন বাংলাদেশের নামকরণ করে ফেলেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, “একসময় এ দেশের বুক হইতে, মানচিত্র হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই।...আমি ঘোষণা করিতেছি—আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইবে পূর্ব পাকিস্তানের বদলে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৬৯) ।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতা উপহার দেওয়া বঙ্গবন্ধুকে মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। কেননা, শোষিত-বঞ্চিত গণমানুষের নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি, বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব ও অমর।

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান: পি.এইচ.ডি গবেষক, জেঝিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর