প্রাথমিক শিক্ষার দীপ্তি, উন্নত জীবনের ভিত্তি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মাছুম বিল্লাহ | 2023-08-30 17:45:11

আমাদের দেশের বেশিরভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদালয়ে খেলাধুলার সরঞ্জাম নেই, খেলাধুলার ব্যবস্থা নেই। কোথাও থাকলেও তা থাকে আলমারীতে তালাবদ্ধ। আর, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ধরনের, কোথাও অনেক ভাল ব্যবস্থা আছে, আর অধিকাংশগুলোতে খেলার মাঠই নেই। বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। এটি কোনভাবেই শিশুবান্ধব নয়, শিশু শিক্ষার্থীদের উপযোগী কোনো প্রতিষ্ঠান নয়।

এসব বিদ্যালয়ে শিশুরা যা শেখে তা আন্তর্জাতিক মানের অনেক নীচে। আমাদের দেশের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিত বুঝে, ৭৫ শতাংশ বুঝে না। ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংল দেখেও পড়তে পারে না। প্রাথমিক শিক্ষার এই বাস্তবতায় দেশে পালিত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ।

এবার প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ পালনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্রাথমিক শিক্ষার দীপ্তি, উন্নত জীবনের ভিত্তি’ । প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ পালনের উদ্বোধনী দিনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, অভিভাবকদের ভাবনা, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব সম্পর্কে যেসব বাণী উচ্চারণ করেছেন সেগুলো শিশু শিক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “অনেক সময় আমরা দেখি প্রতিযোগিতাটা শিশুদের মধ্যে না হলেও মায়েদের মধ্যে বা বাবা-মায়ের মধ্যে একটু বেশি হয়ে যায়। এটি কিন্তু একটু অসুস্থ প্রতিযোগিতা বলে আমি মনে করি। কারণ সব শিক্ষার্থীর তো সমান মেধা থাকবে না। সবাই সমানভাবে করতে পারবে না। স্বভাবতই স্বাভাবিকভারে যার যতটুকু আসবে তাকে সেভাবে সহযোগিতা করতে হবে। শিক্ষাটাকে আপন করে নিয়ে সে যেন শিখতে পারে। শিশুরা কেবল ঘরে বসে শিখবে না, দেখেও শিখবে।’

শিশুদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “তোমরা আমাদের ভবিষ্যত। নিজেদের গড়ে তুলবে, লেখাপড়ায় মনোযোগ দেবে। পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা, যার যে গুণ আছে, সেটা যাতে বিকশিত হয়”। শিশুদের মধ্যে থাকা সুপ্ত প্রতিভা যেন বিকশিত হয় সে জন্য আমাদের সবার কাজ করতে হবে। আজকের শিশুরাই ভবিষ্যত কর্ণধার। হয়তো এর মধ্যে থেকেই কেউ আমার মতোই প্রধানমন্ত্রী হবে। যাদের বিশেষ চাহিদা রয়েছে তাদের শেখাতে হবে। এরাও মানুষ। একই সাথে পাশাপাশি থাকবে। তাদের দেখাশুনার দায়িত্ব যারা সুস্থ শিশু তারাই নেবে, তারাই বন্ধু হবে, তারা একসাথে পড়াশুনা করবে।

শিশুদের পড়াশুনাটা যেন খেলতে খেলতে, হাসতে হাসতে সুন্দরভাবে নিজের মতো করে নিয়ে গড়তে পারে সেই ব্যবস্থাটাই করা উচিত। সেখানে অনবরত পড় পড় বলাটা বা ধমক দেয়াটা, আরো বেশি চাপ দিয়ে শিক্ষার ওপর তাদের আগ্রহটা কমানো ও ভীতি সৃষ্টি করা কোনভাবেই ঠিক নয়।

পৃথিবীর বহু দেশে বাচ্চাদের ছয় বছর এমনকি সাত বছর বয়সে বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়, কিন্তু আমাদের দেশে অনেক কম বয়সে বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। আমাদের দেশে চার বছর বয়স থেকেই বাচ্চাদের স্কুলিং চলছে বহুদিন যাবত, এটিকে এখন সাড়ে তিন বছর করার প্রস্তুতি চলছে। অভিভাবকদের বিষয়টি মনে রেখে সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যে উদ্দেশে বাচ্চাদের ইসিডি (আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট) সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়, অনেক বাবা-মা-ই তা বুঝতে চান না। তারা সিলেবাস দেখতে চান, ক্লাসরুটিন দেখতে চান, বিভিন্ন ধরনের বই দেখতে চান, পরীক্ষা চান।অথচ এতটুকু শিশুর ওগুলো কোনোভাবেই প্রয়োজন নেই। চাপ প্রয়োগ করে কোনো ধরনের শিক্ষা নয়।

শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করতে শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ না করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহবান জানিয়েছেন। লেখাপড়ায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কঠোর শৃংখলে আবদ্ধ করা এক ধরনের মানসিক অত্যাচার যা শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বুঝতে হবে।

শিশুদের যথাযথভাবে শিক্ষা দেওয়ার স্বার্থে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ওপরও জোর দেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া স্কুলে ভর্তি হওয়াকে শিশুদের অধিকার উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, শিশুরা যাতে বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এ কথা বিশ্বজুড়েই স্বীকৃত। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়কে যাতে ফুলের বাগান সদৃশ মনে করে এবং সেখানে আনন্দ ফুর্তির মধ্যে দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। শিশুদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ধমক দিয়ে কিংবা শাস্তি প্রদান করে শেখানোর চেষ্টা করা হয়।

ফলে শিক্ষা জীবনের শুরুতেই পড়াশুনার প্রতি তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, এমনকি শিক্ষাকে তারা ভয়ের চোখে দেখতে শুরু করে। এর ফলে তাদের শিক্ষা জীবনের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যায়। শাস্তি, রাগ ও ভয়ে শিশুর মস্তিস্কে এক ধরনের হরমোন নির্গত হয় যা তার মস্তিস্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতাকে ক্ষণিকের জন্য বাধাগ্রস্ত করে। এই হরমোন তার মস্তিস্কের চিন্তাশক্তির ক্ষেত্রটিতে মেঘের মতো ছায়া ফেলে ঢেকে দেয়।

শিশুরা যখন অতিরিক্ত মানসিক দুংখ, ভয়, ক্রোধ বা মানসিক দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকে, তখন অতি সাধারণ কথা বা তথ্যও তারা মনে করতে পারেনা। আরো দেখা য়ায়, এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটলে শিশুর মস্তিষ্কের গঠন ও আকৃতিতে স্থায়ী পরিবর্তন বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানে বলা হয়েছে যে, শিশুরা খুবই আনন্দপ্রিয়। তারা আনন্দময় পরিবেশেই বেশি শেখে।

পক্ষান্তরে, ভীতিকর বা আনন্দহীন পরিবেশে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে অনেক কম শেখে। শ্রেণিভিত্তিক যোগ্যতা অর্জনের দিক থেকে শিশুরা অনেক পিছিয়ে পড়ে। শিশুরা শিক্ষককে দেখে পরোক্ষভাবে শাস্তি বা মারামারি করা শেখে। স্বাভাবিকভাবে শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সরাসরি শিক্ষক থেকে অনুকরণও করে।

শ্রেণিকক্ষে তারা যে আচরণ পায়, সেটা শিখে ফেলে। ঠিক একইভাবে, শাস্তি দেয়ার প্রক্রিয়া শিশুরা অবচেতনভাবে শিখে ফেলে যা পরবর্তী জীবনে যখন বড় হয় তখন সে শিক্ষকের মতো শাসনের প্রক্রিয়া হিসেবে শাস্তির প্রয়োগ করে থাকে। এসব কারণে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষকদের শিশু মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে, শিশু শিক্ষাবিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা থাকতেই হয়। তাদের জন্য এসব বিষয়ে নিবিড় প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ না পেলেও নিজেদেরকেই এগুলো শিখতে হবে।

একটি শিশু স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত হলে তাকে স্কুলে যেতে হবে, এটি তার জন্মগত অধিকার। অথচ শিশুকে স্কুলে পাঠানোর বয়স হলেই অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার আর শেষ থাকে না। কথিত ভালো স্কুলে সন্তানদের পড়ানোর জন্য অভিভাবকরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন আর তাই এক দৃষ্টিকটু ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে যা বাচ্চাদের শেখার স্বাভাবিকতা নষ্ট করে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন যে, প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রথম শ্রেণিতে যদি ছাপানো প্রশ্নপত্র দিয়েই পরীক্ষা দিতে হয় তাহলে শিশু বিদ্যালয়ে গিয়ে কী শিখবে?

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিকে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর