এমন ডাকসু কি আমরা চেয়েছিলাম?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-09-01 04:56:34

প্রায় ২৯ বছর পর গত ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু ও ১৮টি হল সংসদ নির্বাচন। গোটা জাতির বিশাল প্রত্যাশা নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর প্রত্যাশা হতাশায় পরিণত হয়েছে। নির্বাচনের পর চারদিকে একটা গেল গেল রব উঠেছে। অনেকেই বলছেন, এই ডাকসু আমরা চাইনি। এমন নির্বাচন হওয়ার চেয়ে না হওয়াই ভালো ছিল।

অনেকে নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রের পরিচয় দিতেও লজ্জা পাচ্ছিলেন। অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলঙ্কগাঁথা লেখার জন্য যোগ্য কালি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশ তো বটেই পাকিস্তান আমলেও এত খারাপ নির্বাচন হয়নি। গণতন্ত্রের কফিনে নাকি শেষ পেরেক এই ডাকসু নির্বাচন। এমনকি অপরাজেয় বাংলাকে নিয়ে অশালীন কার্টুনও হয়েছে।

আমি নিজেও ‘জাতীয় নির্বাচনের ভূত ডাকসুতে?’ শিরোনামে লিখেছি। ডাকসু নির্বাচনে এমনিতে পর্যবেক্ষণের রেওয়াজ নেই। তবু বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ শিক্ষক কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা তাদের রিপোর্টে বলেছেন, নির্বাচন সর্বাঙ্গীন সুন্দর হয়নি। আমি তাদের এই পর্যবেক্ষণের সাথে পুরোপুরি একমত। ডাকসুর কাছে যে প্রত্যাশা, সেই মানের নির্বাচন হয়নি। পুনর্নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করলেও গণভবনে গিয়ে নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুর বলেছেন, 'এই নির্বাচনে অনিয়ম ত্রুটি চোখে পড়েছে। সামনের নির্বাচনে যেন অনিয়ম ত্রুটি চোখে না পড়ে।

১০০ ভাগ পিউরিটি সব কাজে পাওয়া যায় না। কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি থাকবেই। সেটা ধরে নিয়েই আমরা আগাই।' আমি তার কথার সাথেও একমত। ডাকসু নির্বাচন সর্বাঙ্গীন সুন্দর হয়নি, অনেক অনিয়ম-ত্রুটি ছিল; এটাই এখন বাস্তবতা। ডাকসু নির্বাচনে অনিয়ম তদন্তে একটি কমিটি হয়েছে। কমিটি যে রিপোর্টই দিক, ডাকসু নির্বাচন ভালো হয়নি, এ ধারনা বদলানোর কোনো সুযোগ নেই।

সর্বাঙ্গীন সুন্দর হয়নি, এটা ঠিক। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন নিয়ে যেমন গেল গেল রব উঠেছে, নির্বাচন কি সত্যিই ততটা খারাপ হয়েছে? কুয়েত-মৈত্রী হলে যে ঘটেছে তাতে আমি জাতীয় নির্বাচনের ভুত দেখেছি। সেখানেও আগের রাতে ভোট দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেটা স্বীকার করেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে প্রভোস্টকে অপসারণ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি হয়েছে। তিন ঘণ্টা পর নতুন প্রভোস্টের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। পরের ভোট নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ নেই।

শামসুন্নাহার হলের ছাত্রীরা রাত জেগে হল পাহাড়া দিয়েছেন। সেখানে ভোট নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও সতর্ক ছিলেন। সেখানে অভিযোগ করা হলেও পরে দেখা গেছে অভিযোগ ঠিক নয়। যা যা অভিযোগ। সব তো তাৎক্ষণিকভাবে মেটানো হয়েছে। আর কী অভিযোগ? এই প্রশ্ন আমি পুনর্নির্বাচনের দাবির প্রতি সংহতি জানানো ভিপি নুরুল হক নুরকেও করেছিলাম। আরো অনেককেই করেছি।

সব মিলিয়ে এর বাইরে মূল অভিযোগ ছেলেদের হলে ভোটারদের লাইনে জ্যাম লাগিয়ে রাখা, ভোটের গতি শ্লথ করে দেয়া। হতে পারে এটা ছাত্রলীগের একটা অপকৌশল। কিন্তু মেয়েরা যদি বিক্ষোভ করে তাৎক্ষণিকভাবে প্রভোস্ট বদলে ফেলতে পারে, ছেলেরা কেন লাইন ঠিক করতে পারলো না? এখন যারা পুনর্নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছেন, তারা সেদিন লাইন ঠিক করতে পারলেন না কেন? কেন নেতারা হলের অনিয়ম প্রতিরোধ না করে নির্বাচন বর্জন করতে মধুর ক্যান্টিনে ছুটে এলেন কেন?

এসব প্রশ্নের উত্তরে অনেকে বলছেন, ছাত্রলীগের ভয়ে। ছাত্রলীগ নির্বাচনের দিন যতটা ভয়ঙ্কর ছিল, এখনও তো ততটাই আছে। পুনর্নির্বাচনের দাবিতে এখন যে আন্দোলন করছেন, ছাত্রলীগের সভাপতিকে মুখের ওপর সন্ত্রাসী বলে দিচ্ছেন; এই সাহসটা নির্বাচনের দিন দেখালে হয়তো এখন আন্দোলন করতে হতো না। নাকি নির্বাচন বর্জন, আন্দোলন, আর নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে; এটা প্রমাণ করাই আপনাদের পূর্বনির্ধারিত মূল উদ্দেশ্য।

জাতীয় নির্বাচন খুব খারাপ হয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচন আরও খারাপ হয়েছে, উপজেলা নির্বাচন তো প্রহসন হচ্ছে। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন কি সেগুলোর সাথে এক পাল্লায় মাপার মত খারাপ হয়েছে? যারা নিজেদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে লজ্জা পাচ্ছেন, তারা একটু ভেবে দেখবেন। আচ্ছা সর্বাঙ্গীন সুন্দর নির্বাচন হলে কোটা আন্দোলনের প্যানেল ছাড়া আর কার কার জেতার সম্ভাবনা ছিল? ভোটের হিসাব কী বলে?

বিপ্লবীরা ভাই ও বোনেরা, পুনর্নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছেন, ভালো কথা। আপনাদের আন্দোলন করার, প্রতিবাদ জানানোর উপর আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা। কিন্তু আন্দোলন যদি আপনাদের শোচনীয় পরাজয়ের লজ্জা ঢাকার জন্য হয়, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু আন্দোলন শেষ করে রাতে গিয়ে ভাবুন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে আপনাদের এত দূরত্ব কেন? কেন তারা আপনাদের ভোট না দিয়ে কোটা আন্দোলনের নেতাদের দিল?

নির্বাচন ততটা লজ্জাজনক না হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের আচরণ সত্যি লজ্জাজনক ছিল। এরশাদ পতনের পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একক আধিপত্য থাকে। ছাত্ররাজনীতির এই অনুপস্থিতি পুষিয়ে দিয়েছেন শিক্ষকরা। তারা এখন ছাত্রদের চেয়ে বেশি বিভক্ত, বেশি দলীয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেশের সবচেয়ে মেধাবী, সবচেয়ে অগ্রসর, সবচেয়ে শ্রদ্ধেয়। তাদের কাছ থেকে আমরা নৈতিকতার উচ্চমান আশা করি। কিন্তু এবারের ডাকসু নির্বাচনে শ্রদ্ধার সে আসন টলে গেছে। অনেক শিক্ষার্থীই বলছেন, এই শিক্ষকদের তারা আর শ্রদ্ধা করতে পারবেন না। ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষকরাই নির্বাচন কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা নির্বাচনটা সর্বাঙ্গীন সুন্দর করতে পারলেন না কেন?

কেন ডাকসু নির্বাচনে অনিয়ম-ত্রুটি সবার চোখে ধরা পড়লো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তো আর মাঠ পর্যায়ের নির্বাচন কর্মকর্তা নন, যে পুলিশের থমকেই ব্যালট পেপার দিয়ে দেবেন। শিক্ষকরা বাধা দিলে, চেষ্টা করলে একটা সর্বাঙ্গীন সুন্দর নির্বাচন করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সেটা তারা করতে পারেননি বা করেননি। কেন পারেননি বা করেননি? এই প্রশ্নের দুটি উত্তর হতে পারে, ছাত্রলীগের ভয়ে বা দলীয় আনুগত্যের কারণে। আমার ধারনা দ্বিতীয়টি সত্যি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকেই রাব্বানীর চেয়ে বড় ছাত্রলীগ, শেখ হাসিনার চেয়ে বড় আওয়মী লীগ। অনিয়ম যা হয়েছে, সেগুলো শিক্ষকরা নিজ দায়িত্বেই করেছেন, কেউ তাদের বাধ্য করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যুগ যুগ ধরে নীল, সাদা, গোলাপী রঙে বিভক্ত। তবে এখন দলীয় আনুগত্যটা তাদের নৈতিকতা, ন্যায্যতা জ্ঞানকেও গ্রাস করে নিচ্ছে; সেটাই শঙ্কার।

আটজন শিক্ষক নিজের বিবেকের তাড়নায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে যে দায়িত্ব পালন করেছেন, সবারই সেটা করা উচিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি আদর্শিক কারণে দলের প্রতি ভালোবাসা সত্ত্বে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতেন; তাহলে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে এমন ছি ছিক্কার পড়ে যেতো না। সৎসাহস থাকলে শিক্ষকরা বলতে পারতেন, আমরা নির্বাচন পরিচালনা করেছি।

আমরা জানি নির্বাচন বাতিল করে দেওয়ার মতো খারাপ হয়নি। কিন্তু সেটা তারা পারেননি। বরং সেই আট শিক্ষক সারাদিন ঘুরে সততার সাথে নিজেরা যা দেখেছেন, তাই তুলে ধরেছেন। তারা অনেকের মত ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপও বলেননি, ভালোও বলেননি। তারা বলেছেন, সর্বাঙ্গীন সুন্দর হয়নি। এটাই ডাকসু নির্বাচনের সঠিক মূল্যায়ন। সেই আট শিক্ষকও নির্বাচন বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন। অনিয়মের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকে চরমভাবে বিনষ্ট করেছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন তারা।

আমি ভেবেছিলাম এই আট শিক্ষকের দায়িত্বশীলতা, সততা, সাহসকে ঢাল করে বাকি শিক্ষকরা এবার পার পেয়ে যাবেন। কিন্তু আমি বিস্ময়ের সাথে দেখলাম, ঘটনা ঘটেছে উল্টো। গত সোমবার অনুষ্ঠিত প্রাধ্যক্ষদের সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগ এনে এই আট শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।

প্রভোস্টদের চোখে সেই আট শিক্ষকের তৎপরতাকে 'উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও নিন্দনীয়' বলে অভিহিত করেছেন। এবার লজ্জায় আমাদের মাখা হেট হওয়ার জোগার। তার মানে প্রভোস্টরা কি দাবি করছেন, নির্বাচন সর্বাঙ্গীন সুন্দর হয়েছে? এরপর এই শিক্ষকেরা কিভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সম্মান আর সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শ্রদ্ধা আশা করবেন।

প্রায় ২৯ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচন সর্বাঙ্গীন সুন্দর হয়নি। শিক্ষকরা চাইলে আরও ভালো নির্বাচন হতে পারতো। তবু আমি ডাকসু আবার সচল হচ্ছে, এটাকেই আমি প্রাপ্তি বলে মানি। আমিও ডাকসুর ভিপি নুরের মত সামনে আগাতে চাই। দুইটা দাবি, ডাকসু নির্বাচন যেন নিয়মিত হয় এবং আগামী নির্বাচন যেন সর্বাঙ্গীন সুন্দর হয়।

শনিবার বসছে ডাকসুর প্রথম বৈঠক। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আকাঙক্ষাকে ধারন করে পুরনো আবর্জনা ফেলে, সব গ্লানি মুছে ডাকসু শুরু করুক নতুন যাত্রা। আর যেন জোর করে মিছিলে নেওয়া, গেস্টরুমে নির্যাতনের অভিযোগ শুনতে না হয়। ডাকসুর জন্য শুভকামনা

প্রভাষ আমিন:হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর