সুখে নেই বাংলাদেশ!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-31 15:36:15

ভালো নেই বাংলাদেশ, ভালো নেই বাংলাদেশের মানুষ। ২০১৭ এর চেয়ে ২০১৮-তে সুখ ও খুশি দুই-ই কমেছে আমাদের। কোন দেশের মানুষ কতটা খুশি আছেন, সুখে আছেন তাই নিয়ে একটি রিপোর্ট সামনে এনেছে জাতিসংঘ। সেখানেই দেখা যাচ্ছে সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান এখন ১১৫ নম্বরে। গত বছর প্রকাশিত তালিকায় বাংলাদেশ ছিল ১১০ নম্বরে।

পৃথিবীর মোট ১৫৬টি দেশকে নিয়ে তৈরি হয়েছে এই তালিকা। সেখানেই দেখা যাচ্ছে, সারা পৃথিবী জুড়েই খুশিতে থাকা মানুষের সংখ্যা কমছে। পৃথিবীতে বাড়ছে চিন্তা, উদ্বেগ, রাগ এবং দুঃখ। বাংলাদেশে অবশ্য এই খারাপ থাকার প্রবণতা আরও বেশি। তাই ১১০ থেকে নেমে গিয়ে বাংলাদেশ এখন ১১৫ নম্বরে।

এই নিয়ে টানা দ্বিতীয় বার সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষ স্থানে থাকল ফিনল্যান্ড। তার পরেই আছে ডেনমার্ক, নরওয়ে, আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া।

সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের আগে রয়েছে পাকিস্তান (৭৫), ভুটান (৯৭), নেপাল (১০১)। পিছিয়ে রয়েছে শ্রীলংকা ও ভারত। যুদ্ধ, দাঙ্গা এবং খরা বিধ্বস্ত সুদান এই তালিকায় সব থেকে নিচে, ১৫৬ নম্বরে। পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ হওয়া সত্ত্বেও এই তালিকায় ১৬ নম্বরে জায়গা পেয়েছে আমেরিকা।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ২৮ জুন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক অধিবেশনে এ দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দিনটি পালনসংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়, ‘সাধারণ পরিষদের সব সদস্য এ বিষয়ে একমত যে, সবারই জীবনের মূল উদ্দেশ্য সুখে থাকা। শুধু তাই নয়, সার্বিকভাবে এরকম একটি সার্বিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও প্রয়োজন যার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ সর্বোপরি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য প্রতি বছরের ২০ মার্চ এ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’’

আন্তর্জাতিক সুখ দিবস প্রচলনের প্রচারটি শুরু হয় মূলত হিমালয়ের দেশ ভুটানের হাত ধরে। দেশটিতে ইতিমধ্যে সুখ সূচকের ভিত্তিতে জাতীয় সমৃদ্ধির পরিমাপের প্রচলন করা হয়েছে। তারা জাতিসংঘের কাছে বছরের একটি দিন সুখ দিবস পালনের আহ্বান জানায়। তাদের আহবানে সাড়া দিয়েই এখন প্রতি বছর সুখ দিবস পালন করা হয়।

এ বছর সুখ দিবসের থিম ছিল ‘হ্যাপিয়ার টুগেদার’। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ সুখে শান্তিতে থাকুক, তা এক সময় এ অঞ্চলের মানুষ কামনা করত। সবাই যেন সুখী হয়, সকলের যেন নিরাময় হয়, সব মানুষ যেন শান্তি লাভ করে, কখনও কেউ যেন দুঃখবোধ না করে। এমন কামনা এক সময় সাধারণ মানুষের প্রার্থনায় উচ্চারিত হতো। কিন্তু কালক্রমে পরিস্থিতি বদলে গেছে। এখন সবাই সুখী হোক-এই কামনার বদলে তার ঘরে শনি আসুক, ওর কপাল পুড়ুক, সে ধ্বংস হোক, তারা গোল্লায় যাক-এ ধরনের কথাই বেশি শোনা যায়।

এর সঙ্গে অবশ্য আধুনিকতার যোগ আছে। প্রাচীন সেই ভাবনা সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আর ভোগবাদী ভাবনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। আমাদের যে ব্যক্তিগত জীবন, সেই জীবনে ‘সবাই তো সুখী হতে চায়/ কেউ সুখী হয় কেউ হয় না’। মনের মধ্যে অবিরাম পাক খেতে থাকে— ‘সুখের কথা বোলো না আর/ বুঝেছি সুখ কেবল ফাঁকি’। অবিরাম অন্তহীন সুখের অন্বেষণে ছুটে চলাই আধুনিক জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা আনন্দ ও শান্তির তোয়াক্কা না করে দৈহিক ও মানসিক সুখের জন্য দৌড়ই। এক সময় জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মনে হয় ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল/ অমিয় সাগরে সিনান করিতে সকলই গরল ভেল’।

সুখের অবশ্য প্রকারভেদ আছে। ক্ষুধার্ত মানুষের খাদ্যগ্রহণের সুখ আর প্রকৃতি প্রেমিকের সমুদ্রদর্শনের সুখ কখনওই এক নয়। তবে এ দুটো জিনিস পেলে উভয়েই সুখী। তবে সুখ একটা মানসিক অনুভূতি। অনেকে কোনো রকম বেঁচে থেকেও সুখী। আবার কেউ কেউ টাকা-পয়সা-বাড়ি-গাড়ি নিয়েও সুখ-বঞ্চিত। সুখী হওয়াটা একটা আর্ট। এটা চর্চা ও অভ্যাসের মাধ্যমে আয়ত্ত করতে হয়। শিখতে হয় কীভাবে সামান্যতেই ভালো থাকা যায়, সুখী হওয়া যায়। একইসঙ্গে শিখতে হয় কীভাবে খারাপ লাগা বা দুঃখের বিষয়গুলোকে ভুলে যাওয়া যায়।

সুখের সংজ্ঞা নিজে নিজে ঠিক করতে হয়। আজকাল সকলেই ছুটছি, কাজের জগৎ সঙ্গে ব্যক্তিগর জীবন, ব্যালেন্স করাটা খুব জরুরি। এসময়ে আপনাকে কে কী বলল, বা কে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করল, সেটাকে ভেবে মনে মনে কষ্ট পাওয়ার কোনও মানে নেই। নিজের ভালো থাকা, নিজেকে সুস্থ এবং সুখী রাখতে হবে নিজের দায়িত্বেই।

এমন কারও উপরে খুব ভরসা করে ফেললেন, যে একবার সারাদিনে কথা না বলতে পারলে আপনি খুব মন খারাপ করে বসে রইলেন সারাদিন, এটা করলে সুখী হবেন কী করে! বাইরে থেকে যে যাই বলুন, তিনি তো আপনাকে জানেন না, নিজেকে সবচেয়ে বেশি নিজে চিনি আমরা। তাই সেই নিয়ন্ত্রণ আপনাকে রাখতেই হবে। নিজের সুস্থতা এবং সুখের ক্ষেত্রে নিজের ভালোলাগাটাই আসল কথা।

বাঙালির কাছে যেখানে ‘সুখ কেবল ফাঁকি’ সেখানে ফিনল্যান্ডে সবাই কেন ‘সুখে আছি’ বলায় একমত? কারণ সেই দেশের নাগরিকরা সুখে থাকতে জানে। আর ওই দেশের শাসকরা সুখে রাখতে জানে। অথচ ১৯৪৫-এ ফিনল্যান্ড ছিল ইউরোপের সব থেকে গরিব দেশের একটি। তারা একেবারে শূন্য থেকে শুরু করেছিল।

তারপর প্রগতিশীল করনীতি, সম্পদের সঠিক বণ্টন, কাজ ও জীবনে ভারসাম্য, বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে। ট্রান্সপেরেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ফিনল্যান্ডের ৮০ শতাংশ মানুষ দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং পুলিশের উপর বিশ্বাস রাখেন। আর আমাদের দেশের চিত্র ঠিক তার উল্টো।

এক রসিক ভদ্রলোক বলেছিলেন, নিজের ভায়রার চেয়ে যার রোজগার একশোটা টাকা বেশি, সে-ই সুখী! ইয়ার্কির অংশটুকু বাদ দিলে একটা কাজের কথা পড়ে থাকে—আমরা সুখী কি না, সেটা বোঝার একমাত্র পথ তুলনা। হয় চারপাশের লোকদের সঙ্গে তুলনা, অথবা নিজের অতীতের সঙ্গে তুলনা। এ যে সুখের দাঁড়িপাল্লা। উল্টো দিকে অন্য কাউকে না রাখলে সুখের পরিমাণ বোঝার উপায় নেই।

আসল কথা হলো, সুখ সুখ করে কেঁদে, বিলাপ করে কোনো লাভ নেই। সুখ একটা মানসিক অনুভূতি। নিজেকে সুখী মনে করলেই সুখ, না হলে সকলই গরল! সুখী দেশের বিশ্ব র‌্যাংকিং নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তারচেয়ে আসুন, আমরা সমবেত কণ্ঠে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা গান গাই:

‘সুখের কথা বোলো না আর, বুঝেছি সুখ কেবল ফাঁকি/ দুঃখে আছি, আছি ভালো, দুঃখেই আমি ভালো থাকি।’

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।

এ সম্পর্কিত আরও খবর