রোডম্যাপ টু ডিজিটাল বাংলাদেশ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন | 2023-08-30 16:08:16

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বিশ্বের সব উন্নত দেশ। আসন্ন এই বিপ্লবের মাধ্যমে সবাই নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থান আরো দৃঢ় করে তোলার পরিকল্পনা করছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে ইন্টারনেট অব থিংস এর মত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। তাই এই শিল্প বিপ্লব থেকে লাভবান হওয়ার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। এমনকি কয়েক দশক আগেও যেসকল রাষ্ট্র প্রযুক্তি খাতে পিছিয়ে ছিল, তারাও আজ অত্যন্ত দ্রুততার সাথে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে এসেছে।

অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মত বিভিন্ন প্রতিকূলতার মুখে একসময় মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাওয়া বাংলাদেশের পক্ষে যে একদিন প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে তা অনেকেই কল্পনা করতে পারেনি। কিন্তু বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে আজ আমরা প্রযুক্তিখাতে বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করেছি।

আজ দেশের সকল প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে ফোরজি ইন্টারনেট প্রযুক্তি, যা যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। যোগাযোগ মাধ্যম আরো দৃঢ় করার লক্ষ্যে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে দেশের প্রথম নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠছে ২৮টি হাই-টেক পার্ক, যা আমাদের তরুণ উদ্যোক্তা ও ইঞ্জিনিয়ারদের পথকে আরো সুগম করে তুলছে। দেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে গড়ে উঠছে উন্নত ও আধুনিক ল্যাব।

বর্তমান সরকারের এমন প্রশংসনীয় পদক্ষেপের কারণে আমাদের দেশে সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্ম গড়ে উঠছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব থেকে আমরা যদি লাভবান হতে চাই, তাহলে আমাদের দেশকে প্রযুক্তিবান্ধব করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। আর সেই পথে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা উদাহরণ হিসাবে এমন কিছু রাষ্ট্রের পথচলা দেখতে পারি, যারা দ্রুত সময়ে প্রযুক্তিবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়া
আন্তর্জাতিক বিজনেস ও ফাইনান্স ডাটা ও ইনসাইট প্রোভাইডার ব্লুমবার্গের ২০১৮ সালের ইনোভেশন ইনডেক্সে টানা পঞ্চমবারের মতো শীর্ষ স্থান দখল করে রেখেছে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটির সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানি স্যামসাং ইলেকট্রনিকস থেকে একবিংশ শতাব্দীতে শুধুমাত্র ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিনস বা আইবিএম বেশি সংখ্যক ইউএস প্যাটেন্ট অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের সেমিকন্ডাক্টর, স্মার্টফোন এবং ডিজিটাল মিডিয়া ইকুয়িপমেন্ট পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে, যার ফলে কোরিয়ান সাপ্লাইয়ার ও বিভিন্ন বিজনেস পার্টনারদের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ইনোভেশন ইনডেক্সের দ্বিতীয় স্থানে থাকা সুইডেন থেকে দক্ষিণ কোরিয়া প্রায় ৫ পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছে। অথচ দক্ষিণ কোরিয়া আয়তনে বাংলাদেশ থেকেও ছোট (১,০০,২১০ বর্গ কিলোমিটার), তাদের জনসংখ্যাও আমাদের থেকে কম (প্রায় ৫.১৪ কোটি)। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ খুব বেশি নেই, যার ফলে তাঁরা উন্নয়ন ও উপার্জনের জন্য প্রযুক্তি ও মানবসম্পদকে কাজে লাগানোয় বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। দেশের উন্নয়নের জন্য তাঁরা তৈরি করেছে জ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি। তবে প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ রাতারাতি গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে ১৯৭০ সালের পর থেকে দেশটি সরকারি ও বেসরকারিভাবে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে।

সত্তর এবং আশির দশকে দক্ষিণ কোরিয়ায় উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা দৃঢ়ভাবে গড়ে উঠে এবং সরকারি অর্থে তৈরি হতে থাকে বিভিন্ন রিসার্চ ইন্সটিটিউট। একইসাথে তাঁরা তাদের রপ্তানি বাজারে উপর থেকে ধীরে ধীরে চাপ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক্স, জাহাজ নির্মাণ এবং গাড়ি নির্মাণের মত ইন্ডাস্ট্রিতে মনোযোগ দিতে থাকে। এই পরিবর্তনের ফলেই দেশটিতে গড়ে উঠে স্যামসাং, এলজি ও হিউন্ডায়ে এর মতো সুপরিচিত কোম্পানি। শুরুর দিকে এই কোম্পানিগুলো বৈদেশিক আর্থিক সহায়তার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।

আশি এবং নব্বই এর দশকে এই কোম্পানিগুলো গড়ে উঠছিল। সেই সময়ে কোরিয়ান সরকার এইসকল হাই টেকনোলজি ইন্ডাস্ট্রির পাশাপাশি জ্ঞান নির্ভর ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার জন্য বিনিয়োগ করতে থাকে। এই সময়ে কোরিয়ান সরকার বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল শহর গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে থাকে, সেই সাথে গড়ে তুলতে থাকে বিভিন্ন টেকনোলজি ও সাইন্স পার্ক। একটি রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (R&D) চালু করা হয়েছিল যার অন্যতম মূল লক্ষ্য ছিল প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে হাই টেকনোলজি প্রস্তুত করতে সহায়তা করা। এই বিনিয়োগের ফলাফল হিসাবে ২০০৭ সালে দেখা যায় যে দেশের ৮০% রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট এর ব্যয় বহন করছে প্রাইভেট খাত। (সুত্রঃ https://bit.ly/2U0CyI1https://bit.ly/2TTyKYR)

প্রযুক্তিখাতে কোরিয়ার সফলতায় বড় অবদান রেখেছে কোরিয়ান সরকার। দেশের জিডিপির প্রায় ৩% ব্যয় করা হয় রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট খাতে। সেই সাথে বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানির এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করে দিয়েছে দেশের নীতিনির্ধারকরা। কোরিয়ার সেরা কোম্পানিরা এখন আর শুধুমাত্র “সেফ টেকনোলজি” বা লাভজনক প্রোডাক্ট তৈরি করায় বিনিয়োগ করে না, বরং অত্যাধুনিক সকল প্রযুক্তি নিয়েও গবেষণা করছে।

চীন
পণ্য উৎপাদন বা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের জন্য গোটা বিশ্ব জুড়ে চীনের পরিচিতি থাকলেও অনেকেই জানেন না যে তাঁরা বিগত বছরগুলোতে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি উৎপাদন থেকে সরে এসে বরং আধুনিক প্রযুক্তি আবিষ্কার করার দিকে অধিক মনোযোগ দিচ্ছে। মূলত বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানির এগিয়ে আসার ফলেই চীনে এই প্রযুক্তি বিপ্লব শুরু হয়েছে, এবং বর্তমানে চীন সরকারও দেশের উন্নয়নের জন্য নতুন হাই টেক প্রযুক্তি আবিষ্কারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চীনের “মেড ইন চায়না ২০২৫” ভিসন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এগিয়ে চলছে, যার অন্যতম লক্ষ্য হলো চীনে নিজস্ব প্রযুক্তি আবিষ্কারের দিকে মনোযোগ দেওয়া এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে ২০৩০ সালের মাঝে বিশ্বের অন্যতম অগ্রসর দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা।

রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট খাতে সবচেয়ে ব্যয় করা দেশগুলোর মাঝে অন্যতম শীর্ষ স্থানে রয়েছে চায়না। চায়নার ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিক এর তথ্য অনুযায়ী ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট খাতে ব্যয় প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২০% করে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সালে তাদের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট খাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৫৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার, যা ১৯৯১ সালের চেয়ে প্রায় ১২৩ গুণ বেশি। এই হারে রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্টে ব্যয় করতে থাকলে চায়না আগামী ১০ বছর পর এই খাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও বেশি ব্যয় করবে।

বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে চীনে শিক্ষার্থীদের অভাব নেই। ইতোমধ্যে উন্নত দেশগুলো থেকে চীনে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল ডিগ্রীধারীদের সংখ্যা বেশি। চীনের বিশাল জনসংখ্যা এর অন্যতম কারণ, তবে চীনাদের মাঝে এই বিষয়ে আগ্রহ অনেক দ্রুত বাড়ছে। ২০১৫ সালে চীনে সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে স্নাতকদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৬ লক্ষ, এবং এই সংখ্যা প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাজুয়েটরা চীনের বিভিন্ন প্রাইভেট হাই টেক কোম্পানির মেধার চাহিদা পূরণ করছে। চীনে লাভজনক টেকনোলজি কোম্পানির সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেসকল স্টার্টআপ কোম্পানির মূল্য ১ বিলিয়ন ডলারের অধিক, তাদেরকে ব্যবসায়িক ভাষায় “ইউনিকর্ন” বলা হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বাদে বিশ্বের সকল দেশ থেকে ইউনিকর্নের সংখ্যা বেশি। সোশ্যাল সাইট বা রাইড শেয়ারিং থেকে শুরু করে স্পিচ ইন্টার‍্যাকশন, কম্পিউটার ভিসন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং ডিপ লার্নিং এর মত প্রযুক্তি নিয়েও কাজ করছে অনেক কোম্পানি।

প্রফেসর ড. সাজ্জাদ হোসেন: ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ

এ সম্পর্কিত আরও খবর