স্বাধীনতা, গণহত্যা ও ‍মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-09-01 10:02:08

আর মাত্র দুই বছর পর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করব। ৫০ বছর পূর্তির এই সময়ের আগে আমাদের মধ্যে উদযাপনের চাইতে উপলব্ধিবোধ অনেক বেশি জরুরি বলে আমার কাছে মনে হয়। এই মনে হওয়ার মূল কারণ ব্যাখ্যা করলে অনেকে হয়ত আমার বক্তব্যে হতাশ এমনকি কেউ কেউ আহত বোধ করতে পারেন। তারপরও আমার এই উপলব্ধি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অনেকের উপলব্ধিবোধের সাথে হয়ত কোথাও একবিন্দুতে গিয়ে মিলবে এমন বিবেচনায় আজকের উপস্থাপন।

“সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি” কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ত খুব আক্ষেপ করেই কথাগুলো বলেছিলেন, যার মূল কারণ হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেদ করতে না পারা। কবি নজরুলের ভেতর সর্বক্ষণই কাজ করত এক বিদ্রোহী চেতনা। আর তাই তো তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, “আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত, সেইদিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়নের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাশে ধ্বনিবে না” অথবা “এ শিকল পরার ছল, এই শিকল পড়েই শিকল তোদের করবোরে বিকল।”

আজ স্বাধীনতা ঘোষণার ৪৮ তম বর্ষ পূর্তি। একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে সশস্ত্র সংগ্রাম যখন শুরু হয় তখন বাংলার আপামর জনগণের প্রাণের দাবী ছিল একটি নিজস্ব ভূখণ্ড অর্জন করা, যেখানে আমরা নিজেরাই নিজেদের পরিচালনা করব। এর পেছনের সবচেয়ে বড় কারণ সুদীর্ঘ সময়ের অত্যাচার, নিপীড়ন আর বঞ্চনা। ২শ বছরের বৃটিশ শাসনাবসনের পর ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত হল তখনকার পূর্ব পাকিস্তান এবং আজকের বাংলাদেশ, তখনকার সময়ের বিবেচনায় ধর্মকেই প্রধান রক্ষাকবচ হিসেবে ধরে নিয়ে একটি স্বাধীন পাকিস্তান হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর বাঙালী জাতির মোহভঙ্গ হতে সময় লাগল না একটি বছরও।

আমাদের জাতিসত্ত্বার শেকড়ে গিয়ে আঘাত হানল পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। উর্দুকেই একমাত্র ভাষা হিসেবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিরোধীতায় তখন বাংলার সাধারন মানুষ পথে নেমে পড়ে। ভাষার অধিকার আদায়ের পরও তখনকার পূর্ববাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের, যেখান থেকে রাষ্ট্র পরিচালিত হত, তাদের উন্নয়নের মূল উৎস হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে। বাঙ্গালীর আর বুঝতে বাকী থাকেনা যে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় আবারও সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাভিত্তিক একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। আর প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৯৫৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর যৌথ নেতৃত্বে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট, যা ওই বছরের নির্বাচনে জয়লাভ করে পাকিস্তানের সরকার গঠন করে।

তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সেই সরকারের একজন মন্ত্রী। যুক্তফ্রন্টের আবির্ভাবই তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মূল রোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেনাগোষ্ঠী সেই সরকারকে বাতিল করে এবং ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারী করে দেশ শাসন করতে থাকেন। বাড়তে থাকে বাঙ্গালীদের উপর অত্যাচারের মাত্রা। এতদিনে তরুণ থেকে অনেকটা পরিণত বয়সের শেখ মুজিব চলে আসেন বাঙ্গালীর স্বাধীকার আন্দোলনের অগ্রভাগে। এর মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জন করা।

নানাভাবে আন্দোলন সংগঠনের উদ্যোগ নেয়া হলেও মূলত শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৬৬ সালের জুন মাসে লাহোরে পেশকৃত ৬ দফা প্রস্তাবই আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তিমূল, যেখানে ৬ দফার একটি দফা মেনে নিলেও পাকিস্তানের অখন্ডতা থাকেনা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কি ছিল এই ৬ দফায়, যা আমাদের স্বাধীনতার আন্দলনকে পরবর্তীতে সংগঠিত করে দেয়? এর মূলে ছিল একটি ফেডারেল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দাবী, যা ১৯৪০ সালে লাহোরে উত্থাপন করেছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। যেখানে একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অধীনে একাধিক রাষ্ট্র থাকবে, যেখানে শেখ মুজিব পরবর্তীতে সংযোজন করে ৬টি প্রস্তাব আকারে পেশ করেন যেখানে উল্লেখ করা হয় যে দেশরক্ষা এবং পররাষ্ট্রনীতি ব্যতিরেকে সকল বিষয় প্রাদেশিক সরকারের অধীনে ন্যস্ত থাকবে, কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থা থাকবে, প্রাদেশিক সরকারের নিজেদের মত করে কর ধার্য্যের ক্ষমতা, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষমতা এবং নিজস্ব আধাসামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা।

আর এজন্যই বলা হয় যে এই দফাগুলোর একটিও মেনে নিলে পাকিস্তানের অখন্ডতা থাকেনা।এমন পরিস্থিতিতে তৎকালীন সামরিক সরকার অস্ত্রের ভাষায় ৬ দফার জবাব দেয়ার অংশ হিসেবে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাকেসহ ৩৪ জনকে আসামী করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। শুরু হয়ে যায় ছাত্র আন্দোলন। বাধ্য হয়ে সামরিক সরকার শেখ মুজিবসহ নেতাদের মুক্তি দেয়।

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক বিশাল সমাবেশে ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ বাঙালী জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিজের জীবনকে বারবার তুচ্ছ করে কারাবরণের জন্য শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং তৎপরবর্তীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামীলীগের কাছে ক্ষমতা অর্পনে অনীহার প্রকাশ হিসেবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দফায় দফায় পেছানো হতে থাকে।

এই সময়ের মধ্যে ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরের ঘটনা সবারই জানা, সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই উদাত্ত আহবান, “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” মূলত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরার ফায়সালে হয়ে গিয়েছিল সেদিনই। তারপরও আলোচনার নামে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান এদেশে কৌশলে সেনাবাহিনী এবং অস্ত্রের সরবরাহ করতে থাকে।

তাদের বিশ্বাস ছিল বাঙালী জাতিকে শায়েস্তা করার সকল আয়োজন সম্পন্ন করে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করতে পারলেই স্বাধীনতার আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে। অথচ বঙ্গবন্ধু সবকিছু আগে থেকেই আঁচ করতে পেরে গ্রেপ্তারের পূর্বেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে যান, যা পরবর্তীতে ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম থেকে তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতা এমএ হান্নান বেতারে ঘোষণা করেন। ২৭ মার্চ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ্যে ঘোষণা করেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। শুরু হয়ে যায় সশস্ত্র সংগ্রাম, যার জন্য প্রতীক্ষিত ছিল লাখো বাঙালী জনতা।

তবে এরই মধ্যে ঘটে যায় নারকীয় ঘটনা। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের সাথে সাথেই নীরিহ বাঙালী জাতির উপর দানবের মত ঝাপিয়ে পড়ে ইয়াহিয়া খানের সেনারা। নারী পুরুষ, ছাত্র, জনতা নির্বিশেষে হত্যাযজ্ঞ সাধিত হয় সেই কালোরাত্রিতে, যার নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

 বিভিন্ন সূত্রের দাবী অনুযায়ী ওই একরাতেই ৫০ হাজার বাঙ্গালীকে হত্যা করা হয়। উদ্দেশ্য বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধুলিস্মাত করে দেয়া। সেটা কোনভাবেই সম্ভব হয়নি বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষন নেতৃত্বগুণে। তিনি জানতেন এই সংগ্রামের অগ্রভাগে তাকে কোনভাবেই থাকার সুযোগ দেয়া হবেনা, বরং তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়া হবে। সে চেষ্টাও করা হল।

 বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন বাঁচাতে কোন আপোষে সম্মত হননি, বরং তার নির্দেশিত পথে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকার (যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে) মুক্তিযুদ্ধকে সূচারুরুপে পরিচালনা করল, যার ফলশ্রুতিতে মাত্র ৯ মাসের সংগ্রাম অথচ ৩০ লক্ষ প্রাণ এবং ২ লক্ষাধিক নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হল স্বাধীনতার লাল সবুজ পতাকা, যার জন্যই হয়ত সুকান্ত আগেভাগেই বলে রেখেছিলেন, “সাবাস বাংলাদেশ, পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখাড় তবু মাথা নোয়াবার নয়।”

আমরা মাথা নোয়াইনি এবং ঠিকই আমরা স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে ছিনিয়ে এনেছি। কিন্তু আজ স্বাধীনতা অর্জনের ৪৮ বছর পর প্রশ্ন আসে সত্যিই কি আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আমাদের অন্তরে ধারণ করতে পেরেছি, দেশের মানুষ কি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আদর্শের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির স্বাদ পেয়েছে অথবা আমরা কি পেরেছি একটি বৈষম্যহীন সমাজকাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে? আজ এত বছর পরও আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে জাতির বিভ্রান্তি আমাদের অর্জনকে ভীষণ ঠুনকো করে ফেলে।

আর সেজন্যই ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে ৫০ হাজার মানুষের হত্যাযজ্ঞকে আমরা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল থেকে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে নাৎসি কর্তৃক পূর্ব ইউরোপের ইহুদি নিধন, রুয়ান্ডার গণহত্যা, আর্মেনীয়ার গণহত্যা এর সবগুলোর স্বীকৃতি মিলেছে, যার চেয়ে আরও অনেক গুণে ঘৃণ্য ছিল ১৯৭১ সালের কালোরাত্রির গণহত্যা। মুক্তিযুদ্ধকে আমরা কেবল দলীয় ফ্রেমের ভেতর আবদ্ধ করে রেখেছি বলে হয়ত সমাজের একটা বৃহত্তর অংশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিস্মৃত। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর আগে এই ক্ষণে তাই এই উপলব্ধি ভীষণভাবে দাগ কেটে যায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যেন আমরা সবাই উজ্জীবিত হই।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর