পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করতে হবে

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

বাশার খান | 2023-08-26 16:09:51

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী মানব ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালায়। প্রায় দুই লাখ নারীর ওপর চালায় পাশবিক নির্যাতন। এই বর্বর গণহত্যা ও পাশবিকতার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বাংলাদেশ চাপ দিয়ে আসলেও শুধু দুঃখ প্রকাশ করেই বারবার এড়িয়ে গেছে ক্ষমা চাওয়ার ইস্যুটি। পাকিস্তানিরা সত্যকে সহজে মেনে নিতে চায় না, এটা তাদের ঐতিহ্যগত স্বভাব। কিন্তু চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত সত্য মেনে নিতে বাধ্য হয়, দেশটির ইতিহাসে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে বারবার।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলা হলেও তারা এই সত্যকে এড়িয়ে গিয়েছিল। অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম এবং প্রাণ উৎসর্গের পর ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। এরপর আগড়তলা মামলাসহ বহু ঘটনায় সত্য ও ন্যায়সঙ্গত দাবিকে অগ্রাহ্য করে নির্বুদ্ধিতার পরিচায় দেয় পাকিস্তান। ফলে প্রতিটি ঘটনায় হেরেছেও নির্লজ্জভাবে, কিন্তু শিক্ষা হয়নি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরও আবারও স্বভাবজাত নির্বোধের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তারা। বাঙালিদের ওপর চালায় বর্বর গণহত্যা।

২.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের সেনাবাহিনী কোরিয়ান নারীদেরকে বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন চালায়। অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক এ ঘটনায় জাপান সরকার কোরিয়ার কাছে ক্ষমা চাইতে রাজি হচ্ছিল না পরবর্তী ৭০ বছর ধরে। অবশেষে ২০১৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর জাপান চাপে পড়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়। দেশটিকে দিতে হয়েছে আর্থিক জরিমানাও। জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পর দেশটির প্রধানমন্ত্রীও কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা চান। শুধু তাই নয়, জাপান সরকারি তহবিল থেকে ৮৩ লাখ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়। সেই টাকায় বেঁচে থাকা পাশবিক নির্যাতনের শিকার ৪৬ জন নারীকে (কমফর্ট উইমেন) সাহায্য করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সেনাদের কমফর্ট (আরামের জন্য) লাখ লাখ কোরিয়ান মেয়েকে জোর করে যৌনদাসী করে নিয়ে গিয়েছিল। সে সময় ধরে নিয়ে যাওয়া নারীদের বলা হতো কমফর্ট উইমেন বা আরামের জন্য নারী।

ঘৃণ্য এই অপরাধের জন্য জাপানের নতি স্বীকার সোজা আঙুলে আসেনি। বহু বছর যাবৎ জাপানকে কোরিয়া বলে আসছিল, নিঃশর্ত ক্ষমা চাও। এবং বলো, অন্যায় করেছ, বহু নারীর জীবন ধ্বংস করার দায়ে তোমরা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য।

অবশ্য জাপান ১৯৬৫ সালে কোরিয়াকে ক্ষতিপূরণবাবদ অর্থ দেয়। কিন্তু সেই অর্থ নির্যাতিত নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে ব্যয় হয়নি। ব্যয় করা হয় কোরিয়ার অবকাঠামো উন্নয়নে।

জাপানি সেনাদের নির্যাতনের শিকার বেঁচে থাকা হতভাগ্য নারীরা নব্বইয়ের দশকে মুখ খুলতে শুরু করেন। গণমাধ্যমে প্রচার হতে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিদের যৌন নির্যাতনের বর্বর ইতিহাস। নির্যাতিতাদের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে এক এক করে প্রকাশ করতে থাকেন মানব সভ্যতার ইতিহাসে চরম যৌনসন্ত্রাসের নিষ্ঠুরতার সত্য কাহিনী। এরপর টনক নড়ে কোরিয়ান তরুণ প্রজন্মের। জাপানকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করতে কোরিয়ানরা লাগাতার বিক্ষোভ-আন্দোলন করতে থাকে। ফলে আন্তর্জাতিক মহলে জাপানের ভাবমূর্তি খারাপ হতে শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে জাপান সরকার সে দেশের বেসরকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যৌথভাবে এশিয়ান উইমেনস ফান্ড তৈরি করে। সেই তহবিল থেকে দক্ষিণ কোরিয়াসহ কয়েকটি দেশে জাপানিদের দ্বারা অত্যাচারিত মানুষদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু কোরিয়ার বহু নির্যাতিত নারী সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন, কারণ তাদের বক্তব্য ছিল- এই ক্ষতিপূরণ জাপানের সরকার দিচ্ছে না, দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। তার মানে রাষ্ট্র হিসেবে জাপান তার দায় স্বীকার করছে না, বরং কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে।

১৯৯২ সাল থেকেই বারবার নানা উপলক্ষে অনানুষ্ঠানিকভাবে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও ন্যাশনাল পার্লামেন্ট দোষ স্বীকার করে, কিন্তু জাপানের কট্টরপন্থীরা, যারা মনে করে তাদের দেশ কখনও কোনও ভুল করতে পারে না, তারা ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারে সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

এরপর ২০০৭ সালে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বলেন, জাপানি সেনারা যে আদৌ কোনো যৌন ক্রীতদাসী রেখেছিল, তার প্রমাণ নেই। এ বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে দাবি আদায়ে কোরিয়ানদের আন্দোলন আরও জোড়ালো হতে থাকে। সিউলের পিস মনুমেন্ট ঘিরে বাড়তে থাকে প্রতিবাদি কর্মসূচি। তরুণ-তরুণীরা ঘেরাও করতে থাকেন সিউলে জাপানি দূতাবাস। ২০১৪ সালে জাপান সরকারের এক প্রতিনিধি ঘোষণা দেন, তার দেশের সরকার এই মার্জনা ভিক্ষার ব্যাপারটা ফের খতিয়ে দেখবে। কিন্তু বাস্তবে কোনো প্রতিফল দেখতে না পেয়ে কোরিয়ানদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই ঘোষণা ছিল আন্দোলন প্রশমনের অপচেষ্টা।

২০১৫ সালজুড়েই আন্দোলনে সরব থাকে কোরিয়ান তরুণ সমাজ। সে বছরের আগস্টের দিকে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।

অবশেষে ২০১৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর, জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে এ নিয়ে একটি চুক্তি হয়। প্রথমে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এরপর প্রধানমন্ত্রী কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা চান। শুধু তাই নয়, জাপান সরকারি তহবিল থেকে ৮৩ লাখ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়। সেই টাকায় বেঁচে থাকা ৪৬ জন কমফর্ট উইমেনকে সাহায্য করা হয়। বিনিময়ে অবশ্য, দক্ষিণ কোরিয়া এই কমফর্ট উইমেনদের ইস্যুতে কথা দেয় যে, এ বিষয়ে আর তারা জাপানের কোনও সমালোচনা করবে না। এভাবেই ধারাবাহিক আন্দোলন ও চাপ দিয়ে জাপানকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে কোরিয়া। আদায় করে ক্ষতিপূরণ।

৩.
একাত্তরে বাংলাদেশিদের ওপর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতন চালানোর বিষয়টি এখন বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত সত্য। তার ভুরি ভুরি তথ্য, দালিলিক উপাদান ও তখনকার বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর এখনো সংরক্ষিত আছে।

একাত্তরে বাংলাদেশে চালানো হত্যা ও নারী ধর্ষণ যে পৃথিবীর অন্যতম কুৎসিত, বীভৎসতম বর্বরতা- লক্ষ লক্ষ শহীদের সহস্রাধিক গণকবর, জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের শিউরে ওঠা জবানবন্দী এবং বীরাঙ্গনা মায়েদের ভাষ্য তার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে আজও। এত এত দালিলিক প্রমাণের পরও পাকিস্তান কীভাবে অস্বীকার করে যে, একাত্তরে তাদের দ্বারা বাংলাদেশে কোনো হত্যাযজ্ঞ হয়নি? হয়নি কোনো নারীকে ধর্ষণ! বরং যা হয়েছে তা ছিল ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নিজেদের বোঝাপড়া, ইন্দো-পাক জং!

বাংলাদেশ এত দিন পাকিস্তানকে চাপ দিয়ে আসলেও নতি স্বীকার করেনি রাষ্ট্রটি। এখন সময় এসেছে কোরিয়ানদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার। আর এই দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী সম্মিলিত সবার, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের। দরকার এ বিষয়ে ক্রমাগত প্রচারণা।

এগিয়ে আসতে হবে প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণদেরকেও। বিভিন্ন দেশে সভা-সেমিনার করে একাত্তরে গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের দালিলিক উপাদান ও গবেষণা তুলে ধরতে হবে। সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর। পাশপাশি বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো নিজ নিজ মিশনেও পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কর্মসূচি করতে পারে।

এই প্রচারণা ও প্রতিবাদকে কাভারেজের ব্যবস্থা করতে হবে আন্তজার্তিক মিডিয়ায়। প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে পাকিস্তানের ওপর নিশ্চয়ই চাপ তৈরি হবে। ক্ষুণ্ন হবে তাদের ভাবমূর্তি। যাতে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হবে পাকিস্তান। দিবে ক্ষতিপূরণও, এমন আশা করাই যায়।

বাশার খান: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও সাংবাদিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর