সড়কে অনিয়ম দেখলেই ‘উম’ পদ্ধতি প্রয়োগ করবেন

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোকাম্মেল হোসেন | 2023-08-26 02:27:34

মেট্রোরেল আসছে; তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ওয়াসা-ফু’য়াসা জাতীয় সেবাপ্রদানকারী সংস্থার কর্মতৎপরতা। ফলে সড়কে ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। যেসব নারী বোরকা পরে বাসে উঠেছেন, তারা ধুলাবালি থেকে কিছুটা সুরক্ষিত। বোরকা সুবিধা না থাকায় বাসের জানালা বন্ধ করে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছি; খুব একটা লাভ হচ্ছে না। যাত্রীদের ওঠানামার জন্য বাসের কন্ডাক্টর দরজা খোলা রেখেছে। খোলা দরজা দিয়ে বাতাসের সঙ্গে বাসের ভেতর হু হু করে ধুলাবালি ঢুকছে ।

আগে এ সড়কে প্রায় প্রতিদিনই নাক-মুখ আবৃত করার সাজ-সরঞ্জাম বিক্রেতাদের দেখা মিলত। সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি শুরুর পর হারিকেন জ্বালিয়ে তাদের খুঁজছি, পাচ্ছি না। যখন দরকার ছিল না, তখন তারা ‘মাস্ক মাস্ক’ সুর তুলে মাছির মতো নাকের সামনে ভনভন করেছে। এখন দরকার অথচ তারা লাপাত্তা; এর কোনো মানে হয়? ফুটপাতে এক লোক গামছা বিক্রি করছেন। গামছা মাস্কের বিকল্প হতে পারে কিনা ভাবছি; হঠাৎ একটা বিষয় খুঁজে পেলাম। কন্ডাক্টর ভাড়া চাইতেই বকের বাচ্চার মতো নিরীহ ভঙ্গিতে বললাম-

: স্টুডেন্ট।

বর্ষকালের ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙর ব্যাঙের মতো চোয়াল ফুলিয়ে কন্ডাক্টর বলল-

: এই গাড়িতে হাফপাস নাই। ওই যে দেখেন, লেখা আছে।

কন্ডাক্টর নির্দেশিত স্থানের দিকে তাকালাম। সেখানে একটা স্টিকার শোভা পাচ্ছে। তাতে লেখা ‘হাফ পাস নাই’।

কন্ডাক্টর টাকার জন্য হাত পেতে আছে। বললাম-

: আরে! তুমি আছো হাফপাস লইয়া; আমি তো ফুলপাস স্টুডেন্ট।

কন্ডাক্টরের চেহারা দেখে মনে হলো, এমন কথা সে বাপের জন্মে শোনেনি। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠে বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-

: ভাই! পুরা গাড়ির ভাড়া কাটন লাগবে; বিটলামি না কইরা জলদি ভাড়া দেন।

নিরীহ বকের বাচ্চা থেকে কাঁটাসজ্জিত সজারু হলাম। বললাম-

: অই মিয়া! তুমি কিন্তু আমারে ডাইকা আইন্যা অপমান করতেছো!

বাসের ড্রাইভার একটু পর পর লুকিং গ্লাসে দৃষ্টি নিক্ষেপ বরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। এবার সে মুখ খুলল। কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করল-

: ওই হুরমুইজ্যা, কী হইছে?

হুরমুইজ্যা মানে হুরমুজ। হুরমুজ মুখ খোলার আগেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বললাম-

: ভাই, এই বাসের গায়ে লেখা আছে- কাম টু লার্ন, গো টু হেল্প। এই বাণী পইড়া আমি অনুপ্রাণিত হইছি এবং কিছু শিখনের আশায় এই বাসে উঠছি। এখন আপনেই বলেন- কোনো কিছু শিখতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরে স্টুডেন্ট বলা যায় কিনা?

লুকিং গ্লাসে ড্রাইভার আমার চেহারা মাপলো। মাপামাপি শেষে বলল-

: কী শিখবার চান?

: প্রথমেই ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স সম্পন্ন করতে চাই। আপনেরা যে ভাষা ব্যবহার করেন, বর্তমান যুগে তা আয়ত্ত্ব করা অতি জরুরি। আমার আব্বা বলেন, সত্যযুগ গেছে, কলিযুগ গেছে; এখন হইল দাপটের যুগ। এই যুগে ‘অই পুঙ্গির পুত, কী কস?’ বইলা আওয়াজ তুললে সব ঠাণ্ডা। আপনেরা হইলেন দাপইট্যা যুগের হেডমাস্টার; গরু ও ছাগল ছাড়া আর কোনো কিছুরে হিসাবের মধ্যে আনেন না। কথা সত্য কিনা?

ড্রাইভার কোনো কিছু বলল না। আগের সূত্র ধরে আমি এবার বললাম-

: ভাষাশিক্ষা শেষ করে শিখব ঘষা মারার কলাকৌশল। আপনেরা যেভাবে ঘষা মাইরা অন্য যানবাহনের শরীরের ছাল তুইলা ফেলেন, সেই বিদ্যা আমারও জানা দরকার। কেউ তেড়িবেড়ি করতে আইলে আমিও ঘষা মাইরা তার ছাল তুইলা নিমু। পাশাপাশি চাপ দেওয়ার কায়দা-কানুনও শিইখা নেব। আপনেরা যেভাবে চাপ দিয়া অন্য গাড়ির ড্রাইভারদের টাইট দেন, আমিও সেইভাবে চাপ দিয়া আমার প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাড্ডিগুড্ডি ছাতু বানাইয়া ফেলমু। ছাতুবিদ্যায় কামিয়াব হওয়ার পর আমি আপনের কাছ থেইকা ওভারটেকিংয়ের সাহস ও দক্ষতা অর্জনের দিকে মনোযোগ দিমু। ওভারটেকিং বিদ্যা জানা না থাকার কারণে আমারে সাইডে রাইখা সবাই আগাইয়া যাইতেছে। আমি পিছনে পইড়া যাইতেছি, এইটা ঠিক না; আমারও আগাইয়া যাওয়া দরকার...

আমার কথা শুনে ড্রাইভার বাদে বাসের অন্য সবার মুখে হাসি ফুটল। কন্ডাক্টরের মুখেও গুয়ামুড়ি টাইপের হাসি ঝলক দিল। যাক, প্রায় সবাই আমার কথা শুনে খুশি হয়েছে- এটাই বড় প্রাপ্তি। টাকা বের করার জন্য পকেটে হাত দিয়েছি, এসময় ড্রাইভার কন্ডাকটরের উদ্দেশে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল,

: অই হুরমুইজ্যা, পাগল-ছাগল বাদ দিয়া অন্য প্যাসেঞ্জারের ভাড়া কাট।

কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। কী ব্যাপার! আমাকে ঘাড় ধরে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হবে নাকি? দেখলাম, অনুমান সত্য নয়। বাসে দু’জন যাত্রী উঠলেন; একজন বয়স্ক পুরুষ, সঙ্গে মধ্যবয়সী এক নারী। নারী আমার পাশের খালি সিটটায় বসলেন। কন্ডাক্টর পেছন থেকে বয়ষ্ক লোকটার উদ্দেশ্যে বলল-

: চাচা, পিছনে সিট আছে; সিটে আইসা বসেন।

ভদ্রলোক অগ্রসর হলেন না, দাঁড়িয়ে রইলেন। ভদ্রমহিলার দিকে তাকালাম। তিনি মাথা নিচু করে বসে আছেন। হঠাৎ ভদ্রলোক গলাখাঁকারি দিলেন। আজকাল যাত্রীবাহী যানবাহনে হকাররা বিভিন্ন পণ্যের ফেরি করে থাকে। এছাড়া নানা কিসিমের সাহায্যপ্রার্থীর দেখাও মেলে। কারও জটিল রোগ, কারও চোখে আলো নেই, কারও শরীরের অঙ্গহানি ঘটেছে, আবার কেউ আসেন মসজিদ-মাদ্রাসায় দান-খয়রাতের আবেদন নিয়ে। ভদ্রলোকের বেশভূষা দেখে সাহায্যপ্রার্থী বলে মনে হচ্ছে না। এ সময় সালাম নিবেদন করে যাত্রীদের উদ্দেশ্যে ভদ্রলোক বললেন-

: উপস্থিত সুধীজন, কথায় কথায় আমরা আইনের কথা বলি; আইনের শাসনের কথা বলি। কিন্তু কোথায় আইন, কোথায় আইনের শাসন? এই দেশে সড়কপথে যাতায়াতের সময় প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২০০ মানুষ আহত ও নিহত হন। কিন্তু আইজ পর্যন্ত তাদের কয়জন ন্যায়বিচার পাইছে- এই তথ্য কি আপনাদের কারও জানা আছে? যাত্রী ভাইবোনেরা, আইন-বিচার ও শাসনের পরিবর্তে যেহেতু সবক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রদর্শনের চর্চা চলতেছে; তাই আমিও ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি।

বাসের একজন যাত্রী জানতে চাইলেন-

: কী পদ্ধতি?

: এইটার নাম হইল ‘উম’ পদ্ধতি।

‘উম’ দেওয়া বলতে বোঝায় উষ্ণ বা গরম করা। এ শব্দটি মুরগির ডিমে ‘তা’ দেওয়ার সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। বোধহয় এ চিন্তা থেকে অন্য একজন যাত্রী বলে উঠলেন-

: উম দেওয়া তো মুরগির কাজ ভাইসাহেব!

: হইতে পারে মুগরির কাজ। তবে ভয় নাই, এইজন্য মুরগির মতো ঠ্যাং ভাঁজ কইরা আপনাদেরও কুট-কুট শব্দ করা লাগবে না।

: তাহলে কী করতে হবে?

: যখন দেখবেন, সড়কে অনিয়ম হইতেছে, আপনারা দাঁড়াইয়া যাবেন। বাসযাত্রীদের সালাম দিয়ে বলবেন, সম্মানিত যাত্রী ভাইয়েরা, ‘উম’ মানে ডিমে ‘তা’ দেওয়া নয়। ‘উম’ মানে হইল- উ-তে ‘উত্তম’ এবং ম-তে ‘মধ্যম’ অর্থাৎ উত্তম-মধ্যম। ‘উম’ সম্পর্কে যাত্রী ভাইদের পরিষ্কার ধারণা দেওয়ার সবাই মিইলা বাসটাকে সড়কের একপাশে থামাইতে বাধ্য করবেন। সাবধান! এ সময় ড্রাইভার পালানোর চেষ্টা করতে পারে। কাজেই সতর্ক থাকতে হবে।

এছাড়া পালানোর কৌশল হিসেবে ড্রাইভার এবং কন্ডাক্টর-হেলপার কান্নাকাটি কইরা মাফ চাইতে পারে। তাদের মায়াকান্নায় ভুললে চলবে না; মন শক্ত রাখতে হবে। এরপর কন্ডাক্টর, হেলপার ও ড্রাইভারকে কড়া ডোজের ‘উম’ উপহার দিয়া তাদের থুতনির রেলিং, যেটাকে দাঁতের পাটি বলা হয়; সেইটা ভাইঙ্গা দিতে হবে। এর ফলে খানা-খাইদ্য খাইতে খুবই অসুবিধা হবে এবং ‘উম’ কী জিনিস, এইটা তারা মরার আগমুহূর্ত পর্যন্ত মনে রাখবে।

বন্ধুরা, ‘উম’ প্রদানকালে ঘটনাস্থলে যদি পুলিশ উপস্থিত হয়, তাইলে এই কাজে শরিক হওয়ার জন্য তাদেরও আমন্ত্রণ জানাইতে হবে। যদি তারা আমন্ত্রণ গ্রহণ না কইরা বরং বাধা দেয়, তাইলে তাদের উদ্দেশ্যে জোরে জোরে বলতে হবে- ‘পুলিশ ভাইয়েরা, আপনারা জনগণের বন্ধু। ‘উম’-এ বাধা দিলে প্রমাণ হইয়া যাবে, আপনারা মোটেই জনগণের বন্ধু নন; বরং চোর-বাটপার ও আইন অমাইন্যকারীদের সাহায্য-সহযোগিতাকারী...

ভদ্রলোকের কথা তখনও শেষ হয়নি; পাশের ভদ্রমহিলার চোখে আমার চোখ পড়ল। জিজ্ঞেস করলাম- উনি আপনার কী হন?

অস্ফুট গলায় ভদ্রমহিলা বললেন- শ্বশুর।

: ওনার বিষয়টা একটু খুলে বলেন তো!

ভদ্রমহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-

: কয়েক বছর আগে আমার স্বামী কর্মস্থল থেকে বাসে বাড়ি ফিরছিলেন। পথিমধ্যে বাসটি দুর্ঘটনার শিকার হন। ওই দুর্ঘটনায় আমার স্বামীসহ অনেক মানুষ মারা যান। পুত্রশোকে আমার শ্বশুর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক চিকিৎসা করিয়েছি; কোনো লাভ হয়নি। এখন দিনে অন্তত একবার তাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হতে হয়। তিনি একেকদিন একেক বাসে উঠে যেসব কথা বলেন, তা তো আপনি নিজের কানেই এতক্ষণ শুনলেন।

পরের স্টপেজে ভদ্রমহিলা ও তার শ্বশুর নেমে গেলেন। বাসের ড্রাইভার মহাবিরক্ত। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল-

: ইঃ; কী আমার জ্ঞানী লোকরে! আর কোনো কামকাজ নাই, পাবলিকরে জ্ঞান দিতে আইছে।

ড্রাইভারের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাইরে তাকালাম। দেখলাম- স্বামীহারা এক স্ত্রী এবং সন্তানহারা এক বাবা পরম মমতায় পরস্পরের হাত আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।

মোকাম্মেল হোসেন: সাংবাদিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর