আগুনে পুড়ে মরার 'লাইভ' ও কিছু কথা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-28 04:12:29

আগুনে পুড়ে যাচ্ছে এফআর ভবন, দাউ দাউ আগুন, কেউ বাঁচার আশায় ভবনের উঁচু তলা থেকে লাফ দিচ্ছে, কেউ কাতরাচ্ছে, কেউ চিৎকার করছে, কেউ লাশ হয়ে পড়ে আছে, কিছু মানুষ অকারণ ভিড় করছে- এসব দৃশ্য গণমাধ্যমে লাইভ দেখানো কি খুব জরুরি? ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইভ চলছে, ধারা-বর্ণনাকারী যা খুশি তাই বলে যাচ্ছেন, যে দেখছে, সেও ক্লান্তি অনুভব করছেন। তাপরও 'লাইভ' চলছে। কেন এই 'লাইভ'? আগুনে বাড়িঘর-মানুষ পোড়ার 'লাইভ' দেখিয়ে আসলে আমরা কী হাসিল করতে চাই? বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটলে গণমাধ্যমগুলো এমন আবেগ আর মাতম সৃষ্টি করে যে মনে হয়, এসব ছেড়ে-ছুঁড়ে থাকলে অনেক বেশি মানসিক শান্তি পাওয়া যাবে!

তিন দশক আগে, ১৯৯০-র দশকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকা বিটিভিই ছিল একমাত্র ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যম। সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বাধীন নিউজ ক্যাপসুলের স্বাদ আমরা পেতে শুরু করি ২০০০ সালে, ‘একুশে টেলিভিশন’-এর মাধ্যমে। সেই সংবাদ দেখে আমরা উল্লসিত হয়ে উঠি সরকারি স্বরের বাইরের বিশ্বের খোঁজ পাওয়ায়। তার পর কেটে গিয়েছে তিন দশক। আমাদের গণমাধ্যম জগতে বিচ্ছুরণ ঘটেছে একটার পর একটা বেসরকারি নিউজ চ্যানেলের। তথ্যভিত্তিক যুক্তির সাহায্যে যে বহুস্বর, অভিমত ও প্রশ্ন উদযাপনের আশা ছিল, সে সবের বদলে এসেছে পর্যায়ক্রমে সাজানো ‘ব্রেকিং নিউজ়’-এ ঘটনার অবিরাম স্রোত। ভোক্তা দর্শকের কোণঠাসা অবস্থা। আর এই পরিস্থিতিকে দেখতে হবে রাষ্ট্র-গণমাধ্যম-সমাজের জটিল পরিপ্রেক্ষিতে।

আধুনিক সমাজে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সক্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হল গণমাধ্যম। তথ্য-যুক্তির বিন্যাসে সমাজের পক্ষে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনই গণমাধ্যমের প্রাথমিক কাজ। রাষ্ট্র কী ও কেন, এ নিয়ে নানা ধারার বিতর্ক আছে। একতা বা অবিচ্ছিন্নতার প্রতীক হিসেবে কল্পিত হলেও রাষ্ট্রের একটা কাঠামোগত দিক আছে। রাষ্ট্র আর সমাজের মধ্যে বিভাজন কাম্য হলেও বাস্তবে এই বিভাজিকা বেশ ঘোলাটে। তবুও দৈনন্দিন সমাজের নানা খুঁটিনাটি ব্যবস্থাপনায় বা ব্যবহারিক চর্চায় আমরা একটা কাল্পনিক রাষ্ট্র-সমাজ বিভাজন বাঁচিয়ে রাখতে চাই।

এখন চব্বিশ-সাত টেলিভাইজড নিউজ গণমাধ্যমের অগ্রণী স্বর হিসেবে সমাজ আর রাষ্ট্রের যোগসূত্রের কাজ করে। বিভাজনটা কাম্য, তাই এই যোগসূত্রের প্রস্তাবনা। দৃশ্য সহযোগে খবর পরিবেশন ধ্রুপদী গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের অঙ্গ। সমাজের নানা সম্ভাবনা আর প্রত্যাশা রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরবে সে। সরকার-পরিপন্থী কোনও দায়িত্ব পালন তার কাজ না হলেও সময় বিশেষে কঠিন প্রশ্নও তুলে ধরতে হয় রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহী সরকারের কাছে। আবার সরকারি পরিকল্পনা, কর্মকাণ্ডের বয়ানও সর্বজনের কাছে নিয়ে যাওয়া এই গণমাধ্যমের দায়। কতকটা গেটকিপার-এর কাজ করার কথা তার।

কীভাবে সংবাদমাধ্যম যোগসূত্রের কাজ করছে, তার ওপরই নির্ভর করে জনমানসে রাষ্ট্র-ধারণার গঠন। প্রাক-উপনিবেশ যুগে সমাজ পরিচালনায় আপেক্ষিকভাবে অনেকটাই প্রান্তিক ছিল রাষ্ট্রনীতি বা রাষ্ট্রব্যবস্থা। স্বাধীনতা-উত্তর আধুনিক রাষ্ট্র সরাসরি ভারতীয় সমাজে দণ্ডমুণ্ডের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। বলা চলে, জনমানসে এক সদর্থক জায়গা করে নিয়েছে রাষ্ট্র-ধারণা। কিন্তু রাষ্ট্রই যে সমাজ গঠন আর উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা নেবে, সেটা আমাদের ভাবনায় পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে।

যে সব শ্রেণির হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা, তারা ভরসা করেছে এক ‌আধুনিকপন্থী ‘এলিট’-এর উপর। সমাজ গঠনের পরিকল্পনা এদের মাথা আর হাতের ওপর ছেড়ে দেওয়া গিয়েছিল। আলগা এক আদর্শগত কাঠামো এই রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেও সাবেক সম্প্রদায়যুক্ত দেশবাসীর কাছে এই এলিট শ্রেণির ভাষা অচেনাই থেকে গিয়েছে। ঠিক এখানেই গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

পুরানো দিনের সাংবাদিক-সম্পাদকদের ঐতিহাসিক অবস্থান ছিল ঈর্ষণীয়। সমীহ জাগানো বুদ্ধিবৃত্তির ফলে এঁরা এক আধিপত্য কায়েম করতে পেরেছিলেন। অনুভূতিজাত ন্যায়পরায়ণতা আর ঋজুতা অবলম্বন করে এঁরা বক্তৃতাবাগীশ নেতা আর রাজনৈতিক শ্রেণির কাছে আদায় করে নিয়েছিলেন সম্ভ্রম। জনহিতকে সামনে রেখে গণমাধ্যমের পথচলা। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় রাজনৈতিক শ্রেণিও বাধ্য হয় সেই বলিষ্ঠ স্বরকে কদর করতে।

কিন্তু আমাদের দেশে ক্রমেই গণমাধ্যম জগতে প্রাধান্য পেয়ে গেল আনুগত্য তথা বশ্যতা। জনহিতের বদলে আনুগত্য, পাশাপাশি রাষ্ট্র আর সরকার সমার্থক হয়ে উঠতে থাকল। স্বাধীন দেশে প্রথম পর্বের ইউটোপিয়া ‘উন্নয়নের বাহক রাষ্ট্র’, আরও দেড় দশক বাদে নতুন বাঁকে এসে পড়ে। ইউটোপিয়ার নতুন মোড় ‘উন্মুক্ত বাজার নির্ভর’ সমাজ।

নব্বইয়ের দশকে অর্থনৈতিক ময়দান থেকে রাষ্ট্রের পিছু হটার বিউগল বাজার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক শ্রেণিও বকলমে বাজারের মালিকের বশ্যতা মেনে নেয়। মার্কেট ম্যানেজারের উত্থান একতরফা ভাবে বদলে দিতে থাকে গণমাধ্যমের প্রভাবশালী অংশকে। রাজনৈতিক শ্রেণি এ দেশে সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব অনেকটাই ছেড়ে রেখেছিল আলোকপ্রাপ্ত এলিট শ্রেণির হাতে। সেই স্বতন্ত্র এলিট-স্বরও এ বার কোণঠাসা হতে থাকে। জাতীয় পরিসরে বদলে যেতে থাকে গণমাধ্যমের পেশাদারি মূল্যবোধ। ব্যবসায়িক শ্রেণি বাজারের ব্যাকরণমতো তথ্য-যুক্তি-খবরের চেয়ে সামনের সারিতে নিয়ে আসে জনপ্রিয় অনুভব। মার্কেট রিসার্চের মূল উদ্দেশ্য জনপ্রিয় তথ্য সংগ্রহের থেকে অনেক বেশি জনপ্রিয় রুচি আর সেই মতো চাহিদা তৈরি করা। মুনাফা-রাজনীতি-প্রচার— ত্রিকোণ আঁতাতের এই হল আদর্শ সময়।

নিজেকে অন্য ভাবে দেখছে নয়া সমাজ। দীর্ঘমেয়াদি ঘটনার পরম্পরা আর সম্পর্কের নিরিখে উপলব্ধিতে আসার চেয়ে দৃষ্টি-আকর্ষক ঘটনা বিচ্ছিন্ন ভাবে মানুষকে টানছে যোগাযোগ মাধ্যমের পর্দার সামনে। অর্থাৎ খবর হয়ে উঠতে হবে দৃশ্যমান। তাই আজ জনপ্রিয়তার শিখরে টেলিভিশন নিউজ়। নয়া মিডিয়া চাইছে ইভেন্টস, ‘স্পেকটাকুলার’ নাটকীয়তা। তাই সরকার পরিচালনা, শাসন পদ্ধতিও হয়ে উঠতে চাইছে দৃশ্যমান ঘটনার ঘটক।

জনজীবনে সংকট বা অনিশ্চয়তা থেকেই মানুষ তার পরিপূরক খোঁজে কল্পজগতে। সমাজ বা ব্যক্তিজীবনে অক্ষমতা আর দুর্বলতা ঢেকে দিতে পারে ইমেজ দুনিয়া। সেই ইমেজ দুনিয়ার দখল নিয়েছে নিউজ চ্যানেল। সেখানেই জনতা খুঁজছে অদম্য, সফল বা মারমুখী প্রতিনিধিকে। রাষ্ট্র ও সমাজের যে নয়া সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তার নিরিখেই দেখতে পাচ্ছি এই আগ্রাসী জনপ্রতিনিধির উত্থান। নিউজের পর্দায় আগ্রাসী ইমেজের সাহায্যে ছদ্মবেশে একই সঙ্গে পরিবেশিত হচ্ছে আর গড়ে তোলাও হচ্ছে যৌথ নাগরিক আত্মসমর্পণ। আগুনে পোড়ার ‘লাইভ’ প্রচার আর রাষ্ট্রীয় ইমেজ প্রচারের যৌথ অভিযানে গুলিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্র-সমাজ বিভাজনরেখা। মনের ওপর চাপ সৃষ্টি হতে হতে এমনকি মানবিক অনুভূতিগুলিও ক্রমে ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। এটাও কী বাজার নির্ভর গণমাধ্যমগুলোর অন্যতম উদ্দেশ্য?

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।

এ সম্পর্কিত আরও খবর