নিমতলী, চকবাজার, বনানী, তারপর?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-29 04:29:34

একের পর এক দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। পুরনো বা নতুন ঢাকা বলে আলাদা করা যাচ্ছে না। জীর্ণ বাড়ি কিংবা অত্যাধুনিক বহুতলের বাছ-বিচার মানছে না। সাভারের পোশাক কারখানা, চুড়িহাট্টার বিপজ্জনক কেমিকেল ফ্যাক্টরি অথবা বনানীর ঝাঁ-চকচকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুরম্য-আকাশচুম্বী ভবন বলেও কোনও পার্থক্য থাকছে না।

সকল ক্ষেত্রেই হাঙরের মতো মুখ হা করে আছে ভয়াবহ আতঙ্ক। মারাত্মক বিপদ শত শত মানুষ পুড়িয়ে মারছে সুযোগ পেলেই। স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলছে নিরাপত্তাহীনতা।

সড়কের নিরাপত্তাহীনতা, খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতা, বসবাসের নিরাপত্তাহীনতা মিলেমিশে মানুষের সামনে  নিরাপত্তাহীনতার হিমালয়-সম বিপদের পাহাড় হাজির করেছে। প্রকাণ্ড বড় বিপদের পাহাড় ডিঙিয়ে মানুষকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত। কেউ জানে না, বিপদ কখন এসে কার উপর হামলে পড়বে। ঘরে-বাইরে-পথে তারপর কে আক্রান্ত হবে, সে ঠিক-ঠিকানা নেই।

সমস্যা বা বিঘ্নের কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে। স্বাভাবিক অবস্থায় ও নিয়মের মধ্যে দুর্ঘটনা হয় না। দুর্ঘটনা বা বিপদ হলে কান্না ও তামাশা দেখার লক্ষ লক্ষ লোক পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু বিপজ্জনক সমস্যাগুলো দেখার ও সমাধানের লোকগুলোকে সময় মতো পাওয়া যাচ্ছে না।

বনানীর ভবনটিকে বলা হলো নিয়মবহির্ভূত। প্ল্যানে যত তলা করার কথা ছিল, যেভাবে করার কথা ছিল, তা হয় নি। এসব কি দুর্ঘটনা হয়ে যাবার পরে খুঁজে বের করার বিষয় নাকি আগে? আগে রাজউক, গণপূর্ত, সিটি কর্পোরেশন, ভূমি ও গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ কোথায় ছিলেন?

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যদি দায়িত্বশীলতা থাকতো তবে, কী প্ল্যান দিচ্ছেন আর বাস্তবে কী বানানো হচ্ছে, তা দেখা হতো। বছর বছর যে ট্যাক্স নিচ্ছেন, তখনও দেখতে পারতেন কোন প্ল্যানের কেমন বাড়িতে কত ট্যাক্স নেওয়া হচ্ছে। রাজধানী শহরের সবচেয়ে অভিজাত ও স্পর্শকাতর নিরাপত্তা এলাকায় এত উঁচু ভবনে কারা আছে, কি করছে, সিঁড়ি, ইমার্জেন্সি একজিটের কি অবস্থা, সেটাও তলিয়ে দেখার কাজটি বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বশীলতার মধ্যেই বর্তায়।

সময় মতো সেসব কিছুই করা হয় নি। ভেতরে হাজার সমস্যা রেখে উপরে টিনটেড গ্লাস লাগিয়ে দিব্যি চলেছে বিপজ্জনক ভবন, যেমন চলে অতি নামধারী হোটেলে বাসি, পচা, বিষাক্ত খাবারের ব্যবসা কিংবা চমৎকার নামের বাসের আড়ালে আনফিট যান ও অদক্ষ চালকের দৌরাত্ম্য। এসব দেখার ও আটকানোর দায়িত্ব যার, তারা সময় মত কাজগুলো না করাতেই বিপদ কেয়ামতের বিভীষিকায় মানুষের উপর নাজিল হচ্ছে।

দায়িত্বশীলতার পাশাপাশি জবাবদিহিতারও বালাই নেই। এই যে বড় দুর্ঘটনা ঘটলো, কিন্তু কেন বা কাদের জন্য তা হলো, সে জবাব কেউ দেবে না। কার গাফিলতি বা উদাসীনতায় আবাসিক এলাকায় বিপজ্জনক রাসায়নিক কেমিকেল কারখানা এলো, খাদ্যে ফরমালিন বা পথে আনফিট বাস এলো, কাদের যোগসাজশে প্ল্যানের বাইরে নিম্নমানের ভবন বানানো হলো, সে জবাবদিহিতাও নেই।

যেন সব কিছুর উত্তর দিতে হবে সরকারকে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তাহলে কি করবে? এদের যে মোটা বেতন দেওয়া হচ্ছে, সেটা কেন দেওয়া হচ্ছে? এসব সংস্থার পিয়ন, কেরানিও যে শত কোটি টাকা বানিয়ে ফেলছে বা ইউরোপ-আমেরিকায় বাড়ি কিনছে, তা তো এমনি এমনি হচ্ছে না। কাউকে কাউকে হত্যার লাইসেন্স দিয়ে এই অবৈধ টাকা কামানো হচ্ছে।

সরকার এই অসৎ, অদক্ষ, লুটেরা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পোষণ করে মানুষ মারার মাধ্যমে ব্যক্তিগত আখের গোছানোর সুযোগ আর কতদিন দেবে? আর কতদিন বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার দুর্নীতি ও অনিয়মের ফলে চরম মানবিক বিপর্যয় ও বিপদ তৈরির পথ খোলা রাখবে? এবং এদের কারণে ভয়াবহ দুর্ঘটনার মাধ্যমে সৃষ্ট অসন্তোষের ফলে নিজের শাসনকে কলুষিত করবে? 

রুখে দাঁড়ানোর সর্বশেষ সময়টিও মনে হয় পেরিয়ে যাচ্ছে। আরও বিলম্ব করা হলে বিপদ ও দুর্ঘটনা তারপর আপনাকে, আমাকে গ্রাস করবে। সমাজ, সংসার, শাসন, প্রশাসন তছনছ করে ফেলবে। সামাজিক অসন্তোষের মাধ্যমে সবাইকে নাড়িয়ে দেবে।

ফলে বিপদ ও দুর্ঘটনায় হাহাকার, দোষারোপ করার বাইরে এসে বিপদের আগেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পথে যেতে হবে। সড়ক, খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বসবাসের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সর্বশক্তি নিয়ে কোনও পক্ষপাত ও অনুকম্পা ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে বা যাদের ত্রুটি, অনিয়ম, অবহেলা দেখতে পাওয়া যাবে, সেসব অনিয়ম ও অনিয়মকারীদের কঠোর হস্তে নিয়মের মধ্যে আনতে হবে।

কতিপয় মানুষের ব্যক্তিগত লাভ ও লোভের কারণে সমাজের বৃহত্তর অংশের বিপদ কোনও অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। একজন বাস মালিক বা চালকের চেয়ে সড়কের হাজার হাজার যাত্রী ও পথচারী গুরুত্বপূর্ণ। একজন হোটেলওয়ালার মুনাফার চেয়ে হাজার হাজার গ্রাহকের জীবন মূল্যবান। একজন স্বার্থবাদী ব্যক্তির ত্রুটিপূর্ণ ভবনের চেয়ে এলাকার বাসিন্দা ও জনগণের জান-মালের দাম বেশি।

কতিপয় অসৎ আরও কতিপয় অসতকে ঘুষ দিয়ে হাজার অনিয়ম লুকিয়ে রেখে মানুষের মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে ঘুরে বেড়াবে, সরকার কেন তা মেনে নেবে? এই কুচক্র নির্মূল করতে না পারলে আজকের বিপদ কালকে আপনার-আমার উপরে চেপে বসবে। তখন বৃহত্তর জনগণের কোনও একজনও নিরাপদ থাকতে পারবে না। গোপন ইঁদুরের মতো সামাজিক বিপদ ঘটিয়ে জনসমর্থনের শেকড় কেটে নেবে এই চক্র। তখন সরকারও রেহাই পাবে না।

অতএব, মানবিক-সামাজিক বিপদ সৃষ্টিকারীদেরকেই উৎপাটিত করে সকলের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। এ কাজে কঠোরতা, নৈর্ব্যক্তিকতা, দৃঢ়তার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হলে বিপদ সরকারি-বেসরকারি কাউকেই ছাড়বে না।   

ড. মাহফুজ পারভেজ: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর