রোহিঙ্গা সমস্যা: কূটনৈতিক পন্থাই একমাত্র সমাধান

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-29 19:58:05

রোহিঙ্গা সংকট শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিশ্লেষণ করলে এ কথা বলা মোটেও অত্যুক্তি হবে না যে বাংলাদেশ অনেকটা যেচেই এই সমস্যাকে নিজের কাঁধে নিয়েছে। এ কথা বললাম এ কারণে যে এই সংকটের উৎস কিন্তু অনেক পুরনো। বাংলাদেশে প্রথমবারের মত ব্যাপক আকারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৭৮ সালে। সেই সময়ে মিয়ানমার সরকারের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে দুই বছর সময়ের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হলেও সংকটের সূচনা উপনিবেশিক শাসনামল থেকেই। সেই সময় থেকেই বা তার আগে থেকেই আরাকানের সাথে বাংলার ভৌগলিক নৈকট্য, বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যের কারণে রোহিঙ্গা মুসলমানরা এদেশে আসতে থেকে, যাদের অনেকেই এদেশে থেকে যান।

এখানে ১৯৭৮ সালে প্রথম বড় আকারের রোহিঙ্গার ঢল আসা ছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে এ দেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদের আগমন ঘটতে থাকে। মিয়ানমারের সাথে আমাদের সামান্য স্থল সীমান্ত ছাড়া মূল সীমানা নির্দেশক হচ্ছে নাফ নদী। আমাদের সীমান্ত রক্ষীদের অসতর্কতা, ক্ষেত্র বিশেষে অসততা এবং এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা, এই সবকিছুই নব্বইয়ের দশকের গোড়া পর্যন্ত এদেশে ৩ লক্ষাধিক অবৈধভাবে প্রবেশকারী রোহিঙ্গার অভয়ারণ্য করে তোলে আমাদের কক্সবাজার এবং বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের অনেক এলাকাকে।

১৯৯০ এর দশকের শুরুতে দ্বিতীয়বারের মত যে ব্যাপক রোহিঙ্গার ঢল নামে, বলা যায় আজ প্রায় ২৮ বছর ধরে সেই সমস্যাকে বহন করে চলছে বাংলাদেশ সরকার। যে সমস্যা অন্তহীন, সমস্যার শুরু যেখান থেকে, অর্থাৎ যখন এটা স্পষ্ট যে মিয়ানমার সরকার এই সমস্যা সমাধানে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না, উপরন্তু ১৯৮২ সালের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন মোতাবেক রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন হিসেবে অভিহিত করেছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে নিরাপত্তার শঙ্কায় আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের আবার মিয়ানমার সরকার ফেরত নেবে সেটা অনুমান করা নিরর্থক।

গোটা দেশের অপরাপর জাতিগোষ্ঠী, বিশেষত সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সম্প্রদায় সরকারের প্রচ্ছন্ন মদদে যেভাবে রোহিঙ্গা নিধনে মেতে উঠেছে, এমন পরিস্থিতিতে এদের প্রতি মানবিক সমর্থন প্রদান করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রধানতম কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। এই মানবিক সমর্থনেরও একটা যৌক্তিক ভিত্তি থাকতে হবে। যখন একটি সরকার ক্রমাগতভাবে একটি নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর ওপর চড়াও হয় তখন সেই সরকারকে নিবৃত করার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন তার দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। এর অর্থ এই নয় যে নিকটবর্তী দেশ হিসেবে এদের আশ্রয়ের মূল ঠিকানা হবে কেবল বাংলাদেশ।

২০১২ সালেও একবার রাখাইন রাজ্যে বৌদ্ধদের সাথে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যাপক দাঙ্গায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনুরোধ উপেক্ষা করে নতুন করে রোহিঙ্গাদের এদেশে মানবিক আশ্রয় না দেয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেও ২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর চৌকিতে রোহিঙ্গাদের হামলাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সেনা অভিযান থেকে তাদের রক্ষায় সরকার এগিয়ে আসে। ফলশ্রুতিতে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গার ঢল নামে আবার।

বর্তমানে কক্সবাজার জেলার উখিয়া এবং টেকনাফের ৩২টি রোহিঙ্গা শিবিরে ৭ লক্ষ ২০ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা অবস্থান করলেও অবৈধভাবে অবস্থান করা রোহিঙ্গাসহ এদেশে বসবাসরত মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লক্ষের অধিক। যেখানে এই দুটি উপজেলার মোট জনসংখ্যা সাড়ে ৫ লক্ষ সেখানে স্পষ্টতই নিজ দেশে এদেশের নাগরিকদের রোহিঙ্গাদের তুলনায় সংখ্যালঘু হয়ে থাকতে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইন অনুযায়ী শরণার্থীদের নির্দিষ্ট শিবিরের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ থাকলেও এখানে চরমভাবে এর ব্যত্যয় ঘটে চলছে। রোহিঙ্গাদের অবস্থানের সুযোগে এদেশে দেশি-বিদেশি এনজিওসহ অনেক দাতা গোষ্ঠীর আগমন ঘটেছে। শরণার্থীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক তাদের প্রত্যাবাসনে আইনগত বাধার সুযোগ নিয়ে এইসব সংস্থাগুলোর সাহায্যের সুযোগে তারা নিজ দেশে ফেরত যেতে অনীহা জানিয়ে আসছে। কথিত আছে এর পেছনেও রয়েছে এই সংস্থাগুলোর প্রচ্ছন্ন ভূমিকা। অনেক বিদেশি সরকার এই সমস্যায় বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে আসলেও সমস্যা সমাধানের বিকল্প উপায় এদের তৃতীয় দেশে স্থানান্তরের বিষয়ে কোন দেশই আগ্রহ দেখায়নি।

বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজার এলাকা থেকে ব্যাপক রোহিঙ্গার ঢল কমাতে সম্প্রতি এক লক্ষ শরণার্থীকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও বিদেশি সংস্থাগুলো, এমনকি সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ভাসানচর বসবাসের উপযোগী নয় বলে মন্তব্য করে কার্যত রোহিঙ্গাদের সেখানে যেতে নিরুৎসাহিত করছে। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ কর্তৃক প্রদত্ত মানবিক আশ্রয় এখন আমাদের নিজেদের জন্যই বুমেরাং হয়ে গেছে।

মূলত: রোহিঙ্গাদের সহায়তাকারী সংস্থাগুলোর থাকা খাওয়া এবং যাতায়াতের সুবিধার জন্য তারা এদের অন্যত্র স্থানান্তরের বিরোধিতা করে আসছে। কিছুদিন আগে জানা গেছে এই সংস্থাগুলো গত ৬ মাসে কেবল কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেলে অবস্থানকালীন বিল পরিশোধ করেছে ১৫০ কোটি টাকা, অথচ এই সময়ের মধ্যে এর অর্ধেক পরিমাণ অর্থ রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যয় করা হয়নি। এ থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হচ্ছে ‘রোহিঙ্গা’ এখন এক শ্রেণির ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবসায় পরিণত হয়ে গেছে, আর প্রতিনিয়ত এর ভুক্তভোগী হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার এবং সাধারণ মানুষ।

শুধু তাই নয়, চাকরি ক্ষেত্রেও এইসকল রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের তুলনায় অধিক সুবিধা লাভ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলো তাদের মানবিক সহায়তার জন্য সেখানে অবস্থান করলেও অভিযোগ রয়েছে যে তারা রোহিঙ্গাদের মোটা অংকের বেতনে চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে তাদের দ্বারা অবস্থানরত অন্য রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে রাজি না হতে প্রণোদনা যোগাচ্ছে। বিষয়টি শুধু উদ্বেগের। সরকারের বিভিন্ন সংস্থাগুলো যদি সত্যিকার অর্থে তাদের যথোচিত দায়িত্ব পালন করে তবে এমনটা হবার কথা নয়। কখনোকখনো তাই মনে হয় সর্ষের ভেতর ভূত রয়েছে, যার ফায়দা লুটছে কিছু সংখ্যক দেশীয় ব্যক্তি, আর এর বিনিময়ে আমাদের রাষ্ট্র ক্রমশই অনিরাপদ হয়ে উঠছে।

কেবল বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাপ নয়, এ কথা এখন সর্বজনবিদিত যে রোহিঙ্গাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এখন ভয়াবহ সন্ত্রাসের সাথে জড়িত, যা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়। ছিনতাই, মাদক পাচার, কালোবাজারি ছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে হত্যা ধর্ষণসহ নানাবিধ অপরাধ সংগঠনের অভিযোগ রয়েছে। এমন অভিযোগও রয়েছে যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর আর্থিক সহায়তাও রয়েছে এসব কিছুতে। আমরা সকলে জানি রোহিঙ্গা নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অভিযোগ অনেক পুরানো। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গৃহীত না হওয়ার মূল কারণ চীন। বিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গা নির্যাতনে মিয়ানমারের প্রতি নিন্দা এবং ঘৃণা উচ্চারিত হলেও তারা নির্বিকার, কারণ তাদের পেছনে রয়েছে চীন।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশের জন্য আশু করণীয় হচ্ছে ক্রমাগতভাবে এটিকে এক নম্বর বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে তুলে ধরতে জোর কূটনৈতিক সক্ষমতা দেখানো। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় একথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে চীনকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ দিয়ে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র এই সমস্যায় উদ্বিগ্ন থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যকার যে বাণিজ্যিক দ্বৈরথ রয়েছে সেটাও দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক স্বার্থের চার দেয়ালে আবদ্ধ।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত এই সমস্যায় সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করলেও ২০১৬ সালে যখন এটি প্রকট হতে শুরু করে তখন ভারতকে মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করতে দেখা গেছে। এখানে যতক্ষণ ভারতের কাছে চীন এবং মিয়ানমারের সাথে বাণিজ্যিক সুসম্পর্কের পথ খোলা থাকবে ততক্ষণ তারা বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়ে তৎপরতা প্রদর্শন করবে না।

মোদি সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন চীনের সাথে তাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে এবং চীনের শি সরকারের সাথে ভারতের শীতল সম্পর্কের দৃশ্যমান কিছু অগ্রগতিও সাধিত হয়েছে। পরিস্থিতি যখন এমন, তখন এটা স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে এই সমস্যা এককভাবে বাংলাদেশকেই সমাধান করতে হবে এবং তা কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন যে আর নতুন করে কোনো রোহিঙ্গাকে এদেশে আশ্রয় দেয়া হবে না। এটা কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান নয়। বিদ্যমান সমস্যাকে সমাধান করাই মুখ্য বিষয়। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়েছে সেটাও প্রতিপালিত হচ্ছে না। এই চুক্তি যেন প্রতিপালিত হয় সেজন্য বাংলাদেশের উচিত হবে জাতিসংঘসহ অপরাপর উন্নত দেশগুলোকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে কূটনৈতিক প্রজ্ঞা প্রদর্শন। সর্বোপরি সফল কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর