বৈশাখের পদধ্বনি ও আশঙ্কার প্রতিবিধান

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 08:49:28

বাংলা নতুন বর্ষ বরণের জন্য আর মাত্র কয়েক দিনের অপেক্ষা। প্রকৃতিতে শোনা যাচ্ছে নতুন বছরের প্রথম মাস বৈশাখের পদধ্বনি। বৈশাখের উদ্দাম তারুণ্যে সমগ্র জাতিও বর্ষবরণে মাতোয়ারা হওয়ার অপেক্ষায়। নববর্ষ উদযাপনের নানা আয়োজনের প্রাক-প্রস্তুতিও চলছে নানা অঙ্গনে। সঙ্গে সঙ্গে জমেছে কিছু শঙ্কার মেঘও।

শঙ্কাটি প্রাকৃতিক এবং সামাজিক। প্রাকৃতিক দিক থেকে ঝড়-বাদলের বিপদ চৈত্র-বৈশাখের স্বাভাবিক প্রবণতা। সতর্কতা ও পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দিকগুলোর প্রতিও উৎসব আয়োজনের ক্ষণে আগাম নজর রাখতে হবে।

সামাজিকভাবে নানা অনুষ্ঠানে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা-দুর্ঘটনার খবর প্রায়শই চোখে পড়ে। অতীত অভিজ্ঞতায়ও অনেক বিরূপতার তথ্য রয়েছে, যে কারণে সর্বজনীন কল্যাণকর অনুষ্ঠান-উৎসব কলুষিত হয়েছে। বিশেষত সন্ত্রাস, জঙ্গি তৎপরতা, নারীর শ্লীলতাহানিসহ নানা অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের কথা বলা যায় অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে, যা নববর্ষ বরণের বৈশাখী আকাশে আশঙ্কার কালো মেঘের মতো বিরাজমান।

শঙ্কা ও বিপদের ভয় নিয়ে সর্বজনীন, সর্ব-অংশগ্রহণমূলক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া যায় না। শুভবোধ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার আগাম পদক্ষেপের মাধ্যমে সামাজিক শঙ্কা দূর করা বাঞ্ছনীয়।

প্রতিক্রিয়াশীল, সন্ত্রাসবাদী, জঙ্গিবাদী হীন মানসিকতাকে পরাজিত করেই মানুষ চেতনার আলোকে সকল অশুভ বিপদ ও সমস্যাকে পদদলিত করে সম্মিলিতভাবে উৎসবে যোগ দেন। প্রধানত মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই সব ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যাকে দূর করার মূল শক্তি।

পরবর্তী ধাপে প্রশাসনিক ও আইন-শৃঙ্খলাগত দিক থেকে দৃঢ় পদক্ষেপ সম্ভাব্য শঙ্কা ও সমস্যাগুলোকে নির্মূল ও প্রতিহত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঘটনা-দুর্ঘটনা হওয়ার পর নয়, নানাবিধ প্রশাসনিক পদক্ষেপ আগেভাগেই নিতে হয়। এক্ষেত্রে অতীতের অভিজ্ঞতায় আগাম প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও শৈথিল্য মোটেও কাম্য নয়।

আলোকিত উৎসবকে ক্ষূণ্ন ও বিপন্ন করার জন্য অন্ধকারের অপশক্তি সব সময়ই আস্তিনের লুকনো সাপের মতো বিপজ্জনক। সুযোগ পেলেই ছোবল দিতে উদ্যত হবে। আগাম ব্যবস্থায় এদের দমন করা না হলে বিপদের সুপ্ত শঙ্কা থেকেই যায়। এসব বিপদ উৎসব ও অনুষ্ঠানের কোনও ক্ষতি যেন না করতে পারে, তা দেখার ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

বাংলাদেশে যে কয়েকটি উৎসব ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বয়স নির্বিশেষে সকলের অংশ গ্রহণে উজ্জ্বল হয়, পহেলা বৈশাখের নববর্ষ বরণ তার মধ্যে প্রধান। বাঙালি জাতিসত্ত্বা সম্মিলিত অংশগ্রহণে দিনটিকে নানা আয়োজনে রঙিন করে। বর্ণময় হয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র। সমাজ ও ব্যক্তির জীবনে আলোকময় ছোঁয়া দিয়ে যায় নববর্ষের আবাহন।

শুধু উৎসব বা নানা আয়োজনই নয়, বাঙালি জাতিসত্ত্বার চেতনাগত নবায়নও ঘটে বৈশাখের প্রথম প্রহরে। আত্মপরিচিতির শেকড়ের সন্ধানে জাতিসত্তার প্রতিটি সদস্য নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতির মর্মমূল ছুঁয়ে ঋদ্ধ হতে চায়। এমন একটি সুগভীর তাৎপর্যময় উৎসবের ক্ষেত্র ও পরিধি তাই স্বাভাবিকভাবেই বহুমাত্রিক ও বহুবিস্তৃত।

ফলে কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত আঘাত, অশ্লীলতা, অনাচার, অভব্যতা মহৎ অনুষ্ঠানের শরীরে কালো ছায়া ফেললে তা মেনে নেওয়া যায় না। আবার কেউ যদি অনুষ্ঠানের এবং অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীর ব্যক্তিগত সম্ভ্রম ও নিরাপত্তা বিনষ্ট করতে চায়, সেটাও সহ্য করা যায় না। জাতীয় উৎসবের শরীরে কালিমা লেপনের অপতৎপরতাকে মোটেও বরদাস্ত করা উচিত নয়।

অতএব জাতীয় স্তরে সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে উদযাপিত অনুষ্ঠানের সামগ্রিক পবিত্রতা, নিরাপত্তা, ভাব-গাম্ভীর্য রক্ষা করা সকলেরই সম্মিলিত দায়িত্ব। সমাজ ও প্রশাসনকে তীব্র শক্তিতে এইসব অনাকাঙ্ক্ষিত অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দরকার আছে। আগাম প্রস্তুতি নিয়ে সর্বজনীন অনুষ্ঠানের সকল আয়োজনকে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন রাখার জন্য ‍সকলকেই সচেষ্ট হতে হবে।

নববর্ষের নব-কিরণে আলোকময় আয়োজনসমূহ বৈশাখের খেয়ালী মেঘের মতোই রঙের খেলায় মেতে উঠুক। মানুষ ও সমাজ প্রকৃতি, পরিবেশ, সংস্কৃতির খেয়ায় পৌঁছে যাক নিজের আত্মপরিচয়ের গভীরতম মর্মমূলে। কোনও শঙ্কা, নিরাপত্তাহীনতা ও বিপদ যেন মানুষের শাশ্বত আনন্দ ও উৎযাপনকে কলুষিত করতে না পারে, এটাই হোক সকলের ঐকান্তিক পূর্বপ্রস্তুতি।

ড. মাহফুজ পারভেজ: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর