রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তাবান্ধব নীতি চাই

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এস এম নাজের হোসাইন | 2023-08-22 11:13:12

পবিত্র রমজান মাস সমাগত। ইতোমধ্যেই সারা দেশে রমজানে ব্যবহার্য নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যর দাম বাড়তে শুরু করেছে। গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্য-সন্ত্রাসী ও অসাধু ব্যবসায়ী-সিন্ডিকেট এখন আর রমজানের অপেক্ষায় থাকছে না। রমজান শুরুর দুই মাস আগেই পরিকল্পিতভাবে রমজান নির্ভর নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে রমজানে পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে এমন অভিযোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে বাজারে প্রচলিত জেলা প্রশাসন, ডিএমপি, র‌্যাব এর ভ্রাম্যমাণ আদালত ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের বাজার অভিযান পরিচালিত হলেও এর সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। উল্টো বেড়েই চলেছে নিত্যপণ্যের মূল্য।

সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যাচ্ছে, সব ধরনের সবজি ও মাছ-মাংস-ডালসহ সব ধরনের পণ্যের দাম এখন আকাশছোঁয়া। এ মূল্যবৃদ্ধির জন্য পাইকাররা খুচরা ব্যবসায়ীদের এবং খুচরা বিক্রেতারা পাইকারদের দায়ী করছেন। তবে বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ী নির্ভরতা এবং আসন্ন রমজান মাস সামনে রেখে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মজুতদারি বৃদ্ধির কারণেই বেশিরভাগ পণ্যের দাম বাড়ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে- মূল্য সন্ত্রাসী, মুনাফাখোর, মজুতদারি, সিন্ডিকেট ও অসাধু-ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, নকল ভেজাল ও মানহীন পণ্যের দৌরাত্মের কারণে আজ নাগরিক জীবন অতিষ্ঠ, মানুষের স্বাভাবিক জীবন-জীবিকা মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। একশ্রেণির নীতি আদর্শহীন, অতি মুনাফা লোভীদের কোটিপতি হবার বাসনায়, তাদের ইচ্ছামতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ সংকট সৃষ্টি করে ও দাম বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা প্রায় অচল করে দিয়েছে।

ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ালেও ঐ পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্য কমলেও তারা আর কমায় না। সরকারের নীতি নির্ধারণী মহলে গুটি কয়েক অসৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণে যাবতীয় রীতিনীতি প্রণয়ন করার কারণে সাধারণ জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। ফলে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম ইচ্ছামতো বাড়ায়, কমায়, সরবরাহসহ বাজার নিয়ন্ত্রণ করে জনগণকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা নিজেদের পকেটস্থ করেন। যার কারণে রিকসা, সিএনজি, বাড়ি ভাড়া, বাস ভাড়া থেকে আরম্ভ করে নগরীর সেলুন, ফটোস্ট্যাট, বিস্কুট, পাউরুটি, কাঁচাবাজার, ফলমূলের ব্যবসায়ী, ফার্মেসীসহ সকলেই নিজেরাই তাদের ইচ্ছামতো পণ্য ও সেবার মূল্য নির্ধারণ করছে, সেখানে সরকারি কোনো সমন্বয় সাধন তো দুরের কথা সরকারের সংশ্লিষ্ট লোকজন এর খবরই রাখছে না।

উপরন্তু পবিত্র রমজান মাস আসলে তাদের এ কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়া, সরকারের ভুর্তকি লাভের আশায় ও কর ফাঁকির কুমতলবে এ সমস্ত ব্যবসায়ীরা সুদৃশ্য মোড়কে 'ন্যায্য মূল্যের দোকান' খুলে সাধারণ জনগণের সাথে ছল-চাতুরী করছে। কিন্তু পাইকারি ও খুচরা বাজারের মাঝে সমন্বয় করলে, মজুতদারি ও একচেটিয়া আমদানির দৌরাত্ব্য কমাতে পারলে দ্রব্যমূল্য অনেকাংশে কমনো যেত।

পবিত্র রজমান, ঈদ ও পূজাকে সামনে রেখে একশ্রেণির মুজতদারি, সিন্ডিকেট চক্র প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের নাকের ডগায় তাদেরকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ, গম, মসলা ও সয়াবিন সংকট তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ সমস্ত মজুতদারি, অসাধু-ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটকারীদের সাথে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু লোকের অবৈধ আঁতাতের কারণে তারা জনগণের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছে।

আরও লক্ষণীয় যে, কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর কারসাজিতে সমগ্র দেশ বর্তমানে অন্য দেশের বাজারে পরিণত হয়েছে। পাউরুটি, বিস্কুট পরাটা থেকে শুরু করে আমদানি করা হয় না এমন পণ্যের তালিকা সম্ভবত দেশে নেই। সম্প্রতি মাছও এখন আমদানির তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সরকারের কিছু কর্তা তাদের নিজেদের আখের গোছাতে আমদানিকৃত পণ্যে শুল্ক হ্রাস ও ভুর্তকি প্রথা চালু করে দেশীয় উৎপাদক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায় পথে বসিয়েছে। তাই এখন প্রয়োজন অবিলম্বে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যের আমদানি নির্ভরশীলতা হ্রাস করে দেশীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। এতে দেশের সমৃদ্ধি ও জাতি উপকৃত হবে।

বাংলাদেশে ভোক্তা আন্দোলন শুধুমাত্র স্থানীয় জনগণের দান, অনুদান, মুষ্টিমেয় বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে। এটি অনেকটা এখনও স্থানীয় জনগণের চাহিদার কারণে চ্যারিটি আকারে জনকল্যাণে পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের জানা মতে ভোক্তা সংগঠনগুলো সমগ্র জেলা ও উপজেলা, মহানগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে, পৌর সভাসমূহে শাখা কমিটি গঠন করে ভোক্তাদের সংগঠিত ও ভোক্তাদের সচেতনতা বিস্তারে কাজ করছে। এ জন্য সদস্যদের চাঁদা, স্থানীয় জনগণের অনুদান, সদস্যদের স্বেচ্ছাশ্রম নিয়েই যাবতীয় কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে হয়।

আর্থিক সংকট, প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল, লজিস্টিক ও অন্যান্য সুবিধাদির অভাবে ভোক্তা সংগঠনগুলি জনগণের বিপুল চাহিদা মেটাতে পুরোপুরি সক্ষম হয়ে উঠতে পারছে না। ফলে বাংলাদেশে ব্যবসায়ী সংগঠন ও ভোক্তা সংগঠন সমূহের মাঝে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা, কারিগরি সক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ে বিশাল আকারের পার্থক্য রয়ে গেছে যেটি বাংলাদেশ ব্যবসা বাণিজ্যে সুস্থ ধারার বিকাশে বড় প্রতিবন্ধক।

উন্নত বিশ্বে ভোক্তারা পণ্যের নিয়ামক হলেও বাংলাদেশে তার পরিস্থিতি উল্টো। এখানে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরাই পণ্যের মূল নিয়ামক। তারা যা বাজারজাত করবে, ভোক্তারা তা-ই হজম করতে বাধ্য। কারণ এখানে ভোক্তাদের পছন্দ-অপছন্দের কোনো সুযোগ নেই।

সরকার ও বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাংলাদেশে ভোক্তা আন্দোলন গতি পায়নি। ফলে ভোক্তারা প্রতি পদে পদে ঠকছে। তাদের সে অপবাসনার বলি হচ্ছেন সাধারণ ভোক্তারা। যার পরিণতি পবিত্র রমজান, ঈদ, পূজো পার্বণে বাজারে চিনি, ছোলা, সয়াবিন, পেঁয়াজ উদাও হয়ে যায়।

ভোক্তাদের আরেকটি অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে তাহলো ভোক্তাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্বের অধিকার হরণ। বাংলাদেশে ব্যবসা বাণিজ্য সংক্রান্ত যে কোনো নীতিনির্ধারণী কথা আসলেই সব জায়গায় অসম-অংশগ্রহণ এবং সব ক্ষেত্রেই যাদের জন্য নীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে তাদের অংশগ্রহণ থাকে নামমাত্র। যেমন; আঞ্চলিক সড়ক পরিবহণ কমিটি, বাস ভাড়া নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নে যাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব নেই, এখানে বাস মালিক, শ্রমিক ছাড়া কিছু সরকারি কর্মকর্তারা প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। সে কারণে যাত্রীদের প্রকৃত সমস্যা উদঘাটনের পরিবর্তে এখানে বাস মালিকদেরই স্বার্থই রক্ষা করা হয়।

ঠিক একই ভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ, মূল্য নির্ধারণ বিষয়ক যে কোনো সভায় শুধুমাত্র ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট সেক্টরের সরকারি কর্মকর্তারাই অংশ নিয়ে থাকেন। অথচ ভোক্তা সংরক্ষণ আইন ২০০৯ অনুযায়ী এফবিসিসিআই ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং ক্যাব ভোক্তাদের প্রতিনিধি হলেও সরকারের অধিকাংশ নীতি নির্ধারণী ফোরামে ক্যাবকে সে সুযোগ দেয়া হচ্ছে না যা ভোক্তা অধিকার আইনের চরম লঙ্ঘন।

তাই এখন প্রয়োজন সরকারের একচেটিয়া ব্যবসায়ী তোষণ নীতি পরিহার করে ভোক্তাদের সত্যিকার অর্থে ক্ষমতায়ন। ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে নিজেদের ইচ্ছামতো, আসল-নকল পরখ করে পণ্য ক্রয়ের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা বাড়ানো গেলে, ভোক্তা হিসেবে তাদের সচেতনতা ও পণ্যের মান সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান করা গেলে এ ভোগান্তির মাত্রা অনেকাংশেই লাঘব সম্ভব।

কাজেই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মাঝে বৈষম্য দূর করতে ভোক্তা সংগঠনগুলোর প্রতি সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো জরুরি। সরকার ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর ন্যায় ভোক্তা সংগঠন, বিশেষ করে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও শাখা গুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সাথে প্রতিনিধিত্ব ও সমন্বয় সাধনে সক্ষমতা বাড়ানো, ভোক্তাদের মাঝে সচেতনতা ও শিক্ষা প্রদান করে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মাঝে ব্যবধান হ্রাস, নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্য, সেবা সার্ভিসসহ ব্যবসা বাণিজ্য ও ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ বিষয়ে সরকারী নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংগঠনের সম অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলেই ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া আধিপত্য ও প্রভাব খর্ব হবে। তখন জনগণ আর মূল্য সন্ত্রাসীদের দ্বারা সর্বস্বান্ত হবে না। মনে রাখতে হবে জনগণ তথা সাধারণ ভোক্তারাই অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি।

এস এম নাজের হোসাইন: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর