গাইড বাণিজ্য: দেখার কেউ নেই

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

আলম শাইন | 2023-09-01 15:24:30

সত্যি কথা বলতে কি, গাইড বই হচ্ছে এখন এক আতঙ্কের নাম। যার নাম শুনলেই অভিভাবকরা চরম অস্বস্তিতে পড়েন। অনেকেই সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।

গাইড বাণিজ্যের আর্তি তৃণমূল পর্যায় থেকেই এসেছে। বলা যায় দরিদ্র অভিভাবকের এই আর্তি। যা প্রতি বছরই শুনতে হচ্ছে আমাদেরকে। এবার যেন একটু বেশি শোনা যাচ্ছে শিক্ষামন্ত্রী রদবদলের কারণে। অভিভাবকদের বিশ্বাস, লেখকরা বিষয়টি তুলে ধরতে পারলেই শিক্ষামন্ত্রী নেক নজরে নিবেন গাইড বাণিজ্যের দিকটি।

জানা যায়, দেশের প্রতিটি স্কুলেই গাইড বই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের তা কিনতে বাধ্যও করা হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো বিদ্যালয়ের শ্রেণি শিক্ষকদের গাইড বই কিনে দেখাতে হচ্ছে পর্যন্ত। শুধু এখানেই শেষ নয়; একেক স্কুলে একেক প্রকাশনীর গাইড বই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শ্রেণি শিক্ষকদের নির্দিষ্ট প্রকাশনীর গাইড বই দেখাতে না পারলে শিক্ষার্থীদের তিরস্কার করা হচ্ছে। অথচ আমরা জানি গাইড বই নিষিদ্ধ! যা আগে নোট বই নামে পরিচিত ছিল, তা-ই এখন গাইড বই হয়ে বাজারে আসছে।

সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত এ গাইড বইয়ের সঙ্গে নোট বইয়ের পার্থক্যটা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আগের নোট বই ছিল হালকা পাতলা চটি ধরনের আর এখনকার গাইড বই খানিকটা মোটা-তাজা। তাই এটি দামেও চড়া। যে চড়া দামের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছে দরিদ্র অভিভাবকরা। চরমভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে সেই দরিদ্র লোকটি যার একাধিক সন্তান স্কুল-কলেজে পড়ছে।

আমরা জানি এবং নি:সন্দেহে বলতে পারি বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব সরকার। শিক্ষার্থীদের যেমন উপবৃত্তি দিচ্ছে সরকার তেমনি প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদেরকে বিনামূল্যে বই বিতরণ করছে। যেই বইগুলো আমাদের কাছে বোর্ড বই নামে পরিচিত। আমরা যারা একসময় বোর্ড বই কিনে পড়ালেখা করেছি, তারা এ সম্পর্কে খুব ভালোই করেই জানি। তখন আমাদের বোর্ড বইয়ের পাশাপাশি নোট বইও কিনে পড়তে হতো। সমস্যা খুব বেশি হতো না তখন। কারণ মোটামুটি সাধ্যের মধ্যেই ছিল নোট বইয়ের দাম। শিক্ষার্থীরা এই বইগুলো সেকেন্ডহ্যান্ড কেনার সুযোগ পেত। সুযোগ পেত সেকেন্ডহ্যান্ড বোর্ড বই কেনারও। তাতে করে একজন দরিদ্র শিক্ষার্থীর কোনমতে চলে যেত। হালে সে সুযোগ নেই।

বোর্ড বই ফ্রি হলেও গাইড বইয়ের যন্ত্রণায় অস্থির থাকে শিক্ষার্থীরা, যা কিনতে হচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে। সবচেয়ে হতবাক করা বিষয়টি হচ্ছে এই গাইড বই সেকেন্ডহ্যান্ড কেনার কোনো ধরনের সুযোগ নেই। কারণ প্রতি বছরই বিদ্যালয় থেকে প্রকাশনী সংস্থার পরিবর্তন করা হচ্ছে। অর্থাৎ এটাও এক ধরনের কৌশল। যাতে করে পুরনো গাইড বই বেচাকেনার সুযোগ না থাকে।

সূত্রমতে জানা যায়, গাইড বইয়ের ব্যাপক বাণিজ্যের পেছনে রয়েছে কৌশলী অবৈধ লেনদেন। বলা যায়, শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কবলে রয়েছে গাইড বাণিজ্য। প্রকাশনী সংস্থাগুলো বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রথমে ডোনেশনের নামে লগ্নি করে থাকে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের ম্যানেজ করেই তারা এ কাজটি করে। শুধু প্রধান শিক্ষকই নয়, বিদ্যালয়ের যৎসামান্য উন্নয়ন কিংবা খেলাধুলার জন্য কিছু বরাদ্দ দেন তারা। কিংবা মেধা তালিকার ভিত্তিতে অর্থাৎ ভালো ছাত্রদেরকে কিছু উপহার সামগ্রী প্রদান করে। যা সর্ব সাধারণের কাছে তখন বৈধ হিসেবে ধরা হয়। গণমাধ্যমে তখন আর বিষয়টি আসার সুযোগ থাকে না। কারণ বিদ্যালয়ের উন্নয়ন বলে কথা! ফলে সেই বিষয়ে সাধারণত আর কেউ মুখ খোলে না, বা খোলার প্রয়োজন বোধ করে না। এভাবেই প্রকাশনী সংস্থাগুলো বছর বছর ধরেই এমন সুশৃঙ্খল নিয়মের মধ্যে অসাধু বাণিজ্যের বিস্তার ঘটাচ্ছে।

সোজা কথা, বিপুল অংকের ডোনেশন নিয়ে পরিশেষে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্দিষ্ট প্রকাশনীর গাইড বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয় বিদ্যালয়। প্রকাশনী সংস্থাগুলো শুধু বিদ্যালয়েই নয় ছোট-বড় লাইব্রেরিগুলোকেও ম্যানেজ করে। সেক্ষেত্রে প্রচুর সৌজন্য কপিও সরবরাহ করে। এতে করে লাইব্রেরির মালিকদের সন্তান কিংবা আত্মীয়স্বজনের সন্তানদের গাইড বইয়ের চাহিদাও পূরণ হয়ে যায়। তখন লাইব্রেরির মালিকরা উক্ত প্রকাশনীর পক্ষে সাফাই গেয়ে অভিভাবকদের নিন্মমানের গাইড বই গছিয়ে দেয়। অথবা অন্যসব প্রকাশনীর বই বিক্রয় করা থেকে বিরত থাকেন।

এভাবে একটা সমন্বিত নিয়মের মাধ্যমে গাইড বাণিজ্য দেশব্যাপী প্রসারিত হচ্ছে। এটি অনেকটাই অঘোষিত নিয়ম নীতিতে পরিণত হয়েছে। এতে করে অভিভাবকদের যেমন গাইড বই কিনতে নাভিশ্বাস ওঠে, তেমনি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান হয় নিন্মগামী। গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তারা মূল পাঠ্যবইটি হাতে নিতে চায় না।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে কোনো রকম পাঠ চুকিয়ে দিতে পারলেও শিক্ষাদীক্ষায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে, যা পরবর্তীতে বিষফোঁড়ায় পরিণত হচ্ছে। ভূরি ভূরি শিক্ষার্থী পাশ করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে কিংবা চাকরি-বাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে। তার প্রমাণ আমরা বহুবার বিভিন্নভাবে পেয়েছি।

আরেকটি বিষয় আমরা লক্ষ করছি। সেটি হচ্ছে গাইড বইগুলোর কাগজও খুব একটা মানসম্মত নয়। কাগজের এপিঠের লেখা ওপিঠে দেখা যায় অনায়াসেই। পড়তে ভীষণ বিরক্তি লাগে; আঙ্গুলের ডগায় কালিতে মাখামাখি হয়ে যায়। বারবার আঙ্গুল মুছে শিক্ষার্থীদের কষ্টেসৃষ্টে পড়তে হচ্ছে তা। অথচ এসব নিন্মমানের বইয়ের দাম বেশ চড়া। ভুলভ্রান্তির কথা আর নাই বা বললাম। যার প্রমাণ মিলে যাবে গাইড বইয়ের পাতা উল্টালেই। এতসব অনিয়মের ফলেও গাইডের বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না। জানি না আর কী কী অনিয়ম হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসবে, তা আমাদের কারোই জানা নেই। সহায়ক বইয়ের নামে গাইড বইয়ের অবাধ বাণিজ্যের ব্যাপারে কেন কারও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, তা-ও আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তবে কি আমরা ধরে নিতে পারি কর্তৃপক্ষের যোগসাজশেই দেশে গাইড বইয়ের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে, যা থেকে পরিত্রাণের আর কোনো উপায় নেই? বিষয়টি নিয়ে কি আমাদের ভাবার সময় আসেনি এখনও?

বিগত দিনের কথা বাদ দিলাম আমরা। নতুন করে সবকিছু ভাবতে চাই এখন। নতুন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আমাদের ভাবনা নতুনভাবে পৌঁছাতে চাই। তিনি যেন শিক্ষা সহায়ক বইয়ের মান ও দাম যাচাই-বাছাই করে এবং গাইড বাণিজ্যের অবসান ঘটিয়ে দ্রুত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান, সেই আর্জি রাখলাম তাই। তিনি যদি বিষয়টায় হস্তক্ষেপ করেন তবে সফলতা বয়ে আসবে বোধকরি। কারণ তার মেধা-দক্ষাতয় মোহিত হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তার ওপরে আরোপ করেছেন। তিনি একটু সোচ্চার হলেই দরিদ্র অভিভাবক স্বস্তি পাবেন; শিক্ষার্থীরাও মেধা বিকাশের সুযোগ পাবেন। তাতে করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ যেমন উজ্জ্বল হবেন তেমনি অভিভাবকদেরও অর্থ সাশ্রয় হবে।

আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর