ভারতের নির্বাচন এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-31 12:02:50

ইতোমধ্যে ভারতের প্রায় দেড় মাসব্যাপী ৭ দফা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। ৫৪৩ আসনবিশিষ্ট লোকসভায় সরকার গঠনের জন্য কোনো দল বা জোটের ২৭২টি আসন পেতে হবে। দেশটির প্রায় ৯০ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৯ কোটি ভোটার এবারের নির্বাচনে প্রথমবারের মত ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন।

প্রধান দুই দল বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ নাকি কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ কারা এবার সরকার গঠন করছে তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২৩ মে পর্যন্ত, যেদিন ভোট গণনা শুরু হবে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের চেয়ে এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন বিজেপি সুস্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস যে কারণে পরাজিত হয়েছিল, এবারের নির্বাচনে শাসকদল বিজেপির বিরুদ্ধে সেসব অভিযোগ এমনকি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মত কিছু গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের জোটসঙ্গীদের সাথে তাদের সম্পর্কের তেমন ছেদ পড়েনি, যেমনটা কংগ্রেসের ক্ষেত্রে হয়েছে।

কংগ্রেস ২৯ রাজ্যের মধ্যে মাত্র ১২টিতে জোটগতভাবে লড়াই করছে। এই নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে উত্তর প্রদেশ (লোকসভায় তাদের আসন সংখ্যা ৮০), মহারাষ্ট্র (৪৮), পশ্চিমবঙ্গ (৪২), বিহার (৪০), তামিলনাড়ু (৩৯), মধ্যপ্রদেশ (২৯) কর্ণাটক (২৮), গুজরাট (২৬), রাজস্থান (২৫), উড়িষ্যা (২১), কেরালা (২০)।

এই রাজ্যগুলোর আসনসংখ্যার নিরিখে এবার উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং তামিলনাড়ুতে কোন দল কতো বেশি আসন লাভ করতে পারবে সেটার ওপরই ভারতের আগামী সরকারে কারা আসছে সেটা নির্ধারিত হয়ে যাবে বলে অনুমান করা যায়। অপরাপর রাজ্যগুলোতে প্রধান প্রতিপক্ষের অর্জিত আসন এবং সেই সাথে আঞ্চলিক দলগুলো সরকার গঠনের সময় প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন নিশ্চিতে ব্যাপক দরকষাকষির চেষ্টা করবে।

তবে বিজেপির ৫ বছরের শাসনামলের নিরিখে এবং বেকারত্ব, আর্থিক টানাপড়েন, জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধি, গ্রামীণ জনগণের প্রতিশ্রুত উন্নয়ন না হওয়ার কারণে গতবারের মত ব্যাপক ব্যবধানে তারা বিজয়ী হবে এমন ধারণা করা যাচ্ছে না।

২০১৪ সালের নির্বাচনে দিল্লি (০৭), রাজস্থান (২৫), গোয়া (০২), গুজরাট (২৬) এবং হিমাচল প্রদেশের (০৪) সবগুলো আসন ছিল বিজেপির দখলে। এবার এর ব্যতিক্রম হওয়ার যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি গত নির্বাচনে যেসকল রাজ্যে তারা কম আসন পেয়েছিল এমন কোনো কোনো জায়গায় তাদের আসন বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে এবার তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস, সিপিএম এবং বিজেপির মধ্যে চতুর্মুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে এবং এর মধ্যে দিয়ে ভোট ভাগাভাগিতে সেখানে বিজেপির আসন বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রধান এই রাজ্যগুলোর মধ্যে বিজেপি গত নির্বাচনে উত্তর প্রদেশের ৮০টি আসনের মধ্যে ৭৩টি আসন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ২টি আসন। পশ্চিমবঙ্গের চিত্র ছিল একেবারে বিপরীত সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস ৪২টি আসনের ৩৪টি দখল করে নেয়। বিজেপি এবং কংগ্রেস পায় যথাক্রমে ০২ এবং ০৪টি আসন।

একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ককে ভারতের কোন রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে সেদিক দিয়ে বিবেচনা করা হত। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় সেসময় ভারতের কংগ্রেস দল সরকারে ছিল এবং সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত দৃঢ়তা এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাথে কংগ্রেস দলের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কার্যত: তাই ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের শীতলতা কাজ করে, আবার অন্যভাবে বলতে গেলে সে সময় থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষমতাসীন দলগুলো ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের পরিবর্তে নিজেদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার দিকেই অধিক মনযোগী ছিল। এই সুযোগে বাংলাদেশ থেকে ভারত একতরফাভাবে অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সুবিধা নিতে থাকে এবং ভারতের সাথে বিদ্যমান চুক্তি এবং বিবাদমান ইস্যুগুলোতে দরকষাকষির ক্ষমতা না থাকার ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সরকার ব্যবস্থা ভারত যেমন চায় তেমনই হবে বলে একধরণের ‘মিথ’ জনমনে কাজ করতে থাকে।

এমন অবস্থা চলতে থাকে ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত। এর আগের সময়গুলোতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পারষ্পরিক বোঝাপড়ার জায়গাটি এতটাই অস্পষ্ট ছিল যে ২৫ বছর মেয়াদী ‘মৈত্রী চুক্তি’, যেখানে অন্যতম অঙ্গীকার ছিল বাংলাদেশের জন্য গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদান, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তির মেয়াদ সমাপনান্তে এই বিষয়টি নিয়ে নতুন কোনো চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করা হয়। এর মূল কারণ ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর থেকে এদেশের রাজনীতি ভারতের পক্ষ বিপক্ষ শক্তিতে বিভাজিত হয়ে পড়ে।

এই বিভাজন এমনই এক ধরনের ধারণার জন্ম দেয় যে যারা ভারত বিরোধী, তারা আসলে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই দ্বারা পরিচালিত। এই দলগুলো বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে এদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলগুলোর প্রচ্ছন্ন সমর্থনে সরকারে আসীন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঘোরতর বিরোধী।

এদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানের দীর্ঘমেয়াদী ভূমিকা সঙ্গত কারণেই রাজনীতি তথা জনগণের একটা অংশকে ভারত বিদ্বেষী করে তোলে। আর ভারত এদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি ছিল বিধায় এদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির উত্থানকে ভালভাবে নিতে পারেনি। ফলে এই দুই দেশের মধ্যে একটা কার্যকর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনর্গঠনে ২১ বছর অপেক্ষার পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নতুন করে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

সকলকে অবাক করে দিয়ে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের জুন মাসে দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৬ মাসের কম সময়ের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি নতুন করে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পন্ন করেন, যা বাংলাদেশকে আগের চেয়েও অধিক পরিমাণে পানি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেয়। এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, যখন এই চুক্তি হয় তখন কিন্তু কংগ্রেস দল সরকারে ছিল না; বরং সে সময় ভারতের সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সমঝোতার মাধ্যমে এইচ ডি দেবগৌড়ার নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকার বাংলাদেশের সাথে এই চুক্তি করে, যার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হয় যে ভারতের রাজনৈতিক মহলের পক্ষ থেকেও একটি কার্যকর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার তাগিদ ছিল, যা বাংলাদেশের অতীত সরকারগুলো করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

এই চুক্তির ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে শেখ হাসিনার সরকার প্রায় দুই যুগের পার্বত্য সমস্যার সমাধানে জনসংহতি সমিতির সাথে চুক্তিতে উপনীত হতে সক্ষম হন, যেখানে ভারতের এই মর্মে ভূমিকা ছিল যে এদেশের শান্তিবাহিনীর কোনো সদস্য এবং তৎপরতাকে তারা প্রশ্রয় দেবে না, যা শান্তি বাহিনীকে অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করে।

২০০১ সালে বাংলাদেশের রাজনীতির পট পরিবর্তনের সাথে সাথে ভারতের সাথে সম্পর্কের পটও পরিবর্তন হয়ে যায়। অমীমাংসিত অনেক ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা এবং সমাধানের জন্য অপেক্ষা বাড়ে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। আবারও শেখ হাসিনার সরকার গঠনের পর আলোচনা নতুন গতি লাভ করে। সে সময় ভারতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ ক্ষমতাসীন থাকার ফলে আওয়ামী লীগের জন্যও বিষয়টি স্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়।

তিন বিঘা করিডোর দিয়ে সার্বক্ষণিক ভারতীয় অংশে বাংলাদেশের ছিটমহলে প্রবেশের পথে সকল বাঁধা অপসারিত হয়। বাকি থাকে তিস্তার পানি বণ্টন এবং দুই দেশের মধ্যকার ছিটমহল এবং অপদখলীয় ভূমিগুলো মীমাংসার বিষয়টি।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের নাজুক অবস্থা এবং ওই নির্বাচনে তাদের ভরাডুবিতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ভারতের শাসন ক্ষমতায় এলে এদেশের অনেকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে এই ভেবে যে মৌলবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী দলটি সরকারে থাকার ফলে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে। সকল আশংকাকে মিথ্যা প্রমাণ করে মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বের এক বছর সময়ের মধ্যে ৬৮ বছর ধরে জিইয়ে রাখা ছিটমহল সমস্যার সমাধান করে দুই দেশ সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। তবে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিটি এখন পর্যন্ত অমীমাংসিত রয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা সম্মত না হওয়ায়।

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিশেষ গুরুত্বের দাবীদার। দুটি দেশেই বর্তমানে রাজনৈতিক সুস্থির অবস্থা বিরাজ করায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক পারষ্পরিক বাণিজ্য বৃদ্ধি হচ্ছে এবং বিগত ১০ বছর সময়ে এই সম্পর্ক একটি শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেদিক বিবেচনায় ভারতের নির্বাচনে কোনো দল জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসল তার চেয়ে বড় কথা গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের একটাই প্রত্যাশা থাকবে দিনশেষে গণতন্ত্রের জয় হোক।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর