শ্রীলঙ্কার জন্য বিশ্ব কাঁদছে!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-26 01:45:14

মাত্র ৩৫ দিন আগে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুইটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় প্রায় ৫০জন মুসল্লির মৃত্যুর ঘটনায় গোটা বিশ্ব কেঁদেছিল। সেই রক্ত আর অশ্রু শুকাতে না শুকাতেই রোববার (২১ এপ্রিল) অন্তত ৮টি শক্তিশালী বোমা হামলায় রক্তাক্ত হয়েছে শ্রীলঙ্কা। এসব হামলায় নিহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। আহত হয়েছেন আরও কয়েকশ জন।

পুরো শ্রীলঙ্কায় জুড়ে নেমে এসেছে শোক আর আতঙ্ক! এই শত শত নিরীহ মানুষের জন্য এখন বিশ্ব আবারও কাঁদছে। আজ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কেবলই মনে হচ্ছে, মানুষের জীবন এত সস্তা? কেন, কার পাপে আজ এভাবে নিরীহ মানুষকে বার বার আত্মাহুতি দিতে হবে? আর কতবার পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিভিন্ন দেশকে ভাসতে হবে রক্ত-গঙ্গায়?

শ্রীলঙ্কায় যা ঘটেছে, তা সত্যিই অকল্পনীয়। ইস্টারের সকালে গির্জাগুলোতে প্রার্থনার জন্য ভিড় জমিয়েছিলেন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানরা। সকাল ৮.‌৪৫ মিনিট নাগাদ কলম্বোর সেন্ট অ্যান্টনিস গির্জায় প্রথম বিস্ফোরণ হয়। আতঙ্কিত মানুষজনের আর্তনাদ এবং পুলিশের হতচকিত অবস্থার মধ্যেই পরপর বিস্ফোরণ হয় কলম্বোর উত্তরাংশে নেগোম্বো শহরতলির কাটুওয়াপিটিয়ায় সেন্ট সেবাস্টিন গির্জা, বাট্টিকালোয়ার গির্জায়। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল সেন্ট সেবাস্টিন গির্জার ছাদ সম্পূর্ণ উড়ে যায়।

গির্জায় হামলার পর একে একে কলম্বোর শাঙ্গরি-লা, কিংসবারি, সিনেমন গ্র্যান্ড এবং দেহিওয়ালা চিড়িয়াখানার সামনে আর একটি বিলাসবহুল হোটেলে বিস্ফোরণ ঘটে। তাতে কমপক্ষে ৩৫ জন বিদেশি নাগরিকের মৃত্যু হয়। নিহতরা জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন, আমেরিকা,পর্তুগাল, চীন এবং তুরস্ক থেকে আসা পর্যটক বলে জানা গিয়েছে।

ডেমাটা গোড়ার মহাবিলা গার্ডেন্সের একটি বাড়িতে অষ্টম বিস্ফোরণটি ঘটে। বিস্ফোরণের সময় সেখানে তল্লাশি চালাতে গিয়েছিল স্থানীয় পুলিশ। বিস্ফোরণের তীব্রতায় বাড়িটির একটি অংশ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লে তার নিচে চাপা পড়ে তিন পুলিশ কর্মীর মৃত্যু হয়।

এই ধারাবাহিক হামলায় পুরো শ্রীলঙ্কা এক আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কান সরকার বেশ কিছু জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশ জুড়ে কার্ফু জারি করা হয়েছে। ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়া রুখতে সাময়িক ভাবে ব্লক করে দেওয়া হয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে। নিরাপত্তা আঁটসাঁট করা হয় বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরেও। সেনা ও আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী সংস্থাগুলিকে পরিস্থিতি বুঝে উপযুক্ত পদক্ষেপ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল টাইগারদের দমনের পর অনেকটা শান্তির জনপদ হয়ে ওঠা শ্রীলঙ্কা এই বোমা বিস্ফোরণে যেন স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। ১৯৮৩ সালের ২৩ জুলাই শ্রীলঙ্কার তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীরা উত্তরাঞ্চলে ১৩ জন সৈন্যকে হত্যার মাধ্যমে শুরু করে দেশটির রক্তাক্ত ইতিহাস। দীর্ঘ ২৬ বছর চলে এই গৃহযুদ্ধ। যার অবসান ঘটে ২০০৯ সালে। এই দীর্ঘ সময় জুড়ে চলা গৃহযুদ্ধ শুধু শ্রীলঙ্কাতেই নয়, এর প্রভাব পড়েছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। একসময় সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন বিশ্বনেতারাও। বিদ্রোহী তামিল টাইগার নেতা প্রভাকরণের মৃত্যু যবনিকা টানে এই গৃহযুদ্ধের।

এরপর এই দ্বীপ-রাষ্ট্রটি শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলছিল। শিক্ষা, প্রযুক্তি, জাতীয় মাথা পিছু আয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। এই দেশটিতে এমন নারকীয় হামলা গোটা বিশ্ব বিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এই ভয়াবহ আক্রমণের পেছনে কারা রয়েছে, তাদের উদ্দেশ্যই বা কী? এত বড় একটি নারকীয় ঘটনার পেছনের সন্ত্রাসীরা কীভাবে অধরা থেকে গেল-এসব প্রশ্ন উঠছে।

আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপির এক খবর শ্রীলঙ্কা সরকারের ভূমিকাকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রোববার সকালে শ্রীলংকার বিভিন্ন গির্জা ও হোটেলে ধারাবাহিক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠার ঠিক দশ দিন আগে এই হামলা নিয়ে দেশকে সতর্ক করেছিলেন সে দেশের পুলিশ প্রধান। এমনটাই জানাচ্ছে সংবাদ সংস্থা এএফপি। দশ দিন আগের সেই সতর্কবার্তা তাদের হাতেও নাকি এসেছিল।

এএফপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১১ এপ্রিল এই ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ষড়যন্ত্রের খবর এসে পৌঁছেছিল শ্রীলঙ্কার গোয়েন্দাদের হাতে। সেই মতো দেশের শীর্ষ পুলিশ কর্তাদের কাছে সতর্কবার্তাও পাঠিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কা পুলিশের প্রধান পুজুথ জয়সুন্দর। পুলিশ প্রধানের পাঠানো সেই সতর্কবার্তায় বলা হয়েছিল, 'একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, ন্যাশনাল তৌহিদ জামাত নামের একটি সংগঠন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার ষড়যন্ত্র করছে। হামলা চালানো হতে পারে কলম্বোর ভারতীয় হাইকমিশনেও।'

শ্রীলঙ্কার কট্টরপন্থী মুসলিম মৌলবাদীদের সংগঠন হল এই ন্যাশনাল তৌহিদ জামাত। গত বছর বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ মূর্তিতে ভাঙচুর করার পর প্রথম নজরে আসে এই সংগঠন। এএফপির এই প্রতিবেদন যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে শ্রীলঙ্কার পুলিশ এবং প্রশাসন কেন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, সে প্রশ্ন উঠছে। এমন একটি জনবহুল এবং বিশ্বমানের সামরিক বাহিনীর দেশে একের পর এক আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটল, অথচ পুলিশ-গোয়েন্দারা কোনো কিছুই টের পেল না, কাউকে ধরতে পারল না-এটা দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ। গোটা বিশ্বই যেখানে সন্ত্রাসবাদী হামলার ঝুঁকিতে রয়েছে, সেখানে শ্রীলঙ্কার মতো একটি আধুনিক দেশের নিরাপত্তা নিয়ে এমন উদাসীনতা বিস্ময়কর বইকি!

কারা হামলা করেছে তা এখনো স্পষ্ট না হলেও, শ্রীলঙ্কা প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলছেন, একটি ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠী এ হামলা চালিয়েছে। ইতিমধ্যে এই ভয়াবহ হামলায় জড়িত সন্দেহে ২৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, শ্রীলঙ্কান সরকার সংকট মোকাবেলায় কতটা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে?

রোববার ঘটনাটির পেছনে যে কোনো সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন যুক্ত আছে, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। হয়তো তাদের চোখেও কোনো আদর্শের ঠুলি পরানো হয়ে গেছে, করা হয়েছে মগজ ধোলাই। হতে পারে, এর পেছনে আছে রাজনৈতিক কোনো স্বার্থ হাসিলের অভিপ্রায়ও।

কারণটা যা-ই হোক না কেন, এর বলি হলো শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষই। খুব সাধারণ একজন গৃহবধূ, একজন বাবা কিংবা মা, একজন ভাই কিংবা বোন; রাজনীতি শব্দের মানে না বোঝা শিশু। শ্রীলঙ্কাকে যারাই রক্তাক্ত করুক না কেন, একে হালকা করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। ধর্মীয় মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের শিকড় উপড়ে ফেলতে সবাইকে, সব দেশকে একাট্টা হতে হবে।

শ্রীলঙ্কার হামলা শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, বিশ্ববাসীর জন্যই বিপদ-সংকেত। মৌলবাদ নিয়ে অনেকেই খেলতে পছন্দ করেন। কিন্তু কাল সাপ কারও পোষ মানে না। তালেবানদের এক সময় সিআইএ ও পেন্টাগন সাহায্য-সহযোগিতা ও অস্ত্র-প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছিল। সেই তালেবানরা সুযোগ বুঝে ঠিকই আমেরিকার ওপর মরণ-কামড় বসিয়েছে। আইএস জঙ্গিদের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, তা যে নামে, যে পরিচয়ে, যে দেশেই থাকুক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই রুখে দাঁড়াতে হবে। মৌলবাদীদের ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা ও কার্যকর করতে হবে আমাদের অস্তিত্বের স্বার্থেই। তা না হলে সবাইকেই মূল্য দিতে হবে।

মৌলবাদী সন্ত্রাস নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক উদ্যোগ-আয়োজন ও গবেষণার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ধর্মীয় মৌলবাদ সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত বিশ্বাস, ডিসকোর্স, রাষ্ট্রীয় নীতি সব কিছু নিয়ে নতুন করে ভেবে দেখার সময় এসেছে।

শ্রীলঙ্কার জন্য আজ বিশ্ব কাঁদছে। আমরাও কাঁদছি। একই সঙ্গে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নির্মূল করণের পথ পদ্ধতি অনুসন্ধানের বিশ্ব বিবেকর কাছে জোর দাবি তুলছি। ধর্মের নামে নিরীহ মানুষকে খুন করা বন্ধ হোক, বন্ধ হোক রক্তের হোলি-খেলা!

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর