অনলাইন সাংবাদিকতার জন্য আশা জাগানিয়া এক সংবাদ সম্মেলন

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মাহমুদ মেনন | 2023-08-23 20:35:43

গত প্রায় ছ’মাস হবে, পরিচিতজন যেখানেই যার সঙ্গে সংবাদমাধ্যম নিয়ে কথা হয়, খুব হতাশা ব্যক্ত করছিলাম। বার্তা২৪.কমের এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেনের সঙ্গে একদিন দেখা হলো তার নতুন অফিসে; একই হতাশার কথা বললাম। নিজের অফিসে সারাবাংলা.নেটে এডিটর ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার সঙ্গে যখনই কথা হয়, একই কথা বলি... যা কিছুই হোক সমাজে মিডিয়া লিটরেসি এত কম যে এই যুগে সংবাদমাধ্যম টিকিয়ে রাখা খুব দায়।

মিডিয়া হাইকের এই যুগে কোনটা সত্যিকারের মিডিয়া, কোনটা নয় তা বোঝা দুষ্কর হয়ে উঠেছে। হতাশাটা তৈরি হয়েছিল গত নির্বাচনের ঠিক আগে আগে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সারাবাংলা.নেট কার্যালয় পরিদর্শনে এসে একটি তথ্য দেওয়ার পর। তার কথায় তখন জানতে পেরেছিলাম সরকার যে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের জন্য নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে তাতে প্রায় পাঁচ হাজার আবেদন পড়েছে। আর তার মধ্য থেকে প্রায় তেইশ শ’র মতো আবেদনকে প্রাথমিক বাছাইয়ে আলাদা করা হয়েছে।

হতাশার কারণও ঠিক সেটাই। কারা এই সংবাদমাধ্যমের আবেদনকারী? কারা এইসব সম্পাদক যারা তাদের নিজেদের জন্য অনলাইন নিউজ পোর্টালের আবেদন করলেন। আলমগীর হোসেন, যাকে বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবেই মানা হয়, যিনি ২০০৪ সালে দেশে প্রথম বিডিনিউজ২৪.কমের মাধ্যমে অনলাইন সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু করেন, তার একটি কথা হচ্ছে- শত ফুল ফুটতে দাও। মানে তিনি চান বেশি বেশি অনলাইন সংবাদপত্র আসুক। তাতে সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটবে। কিন্তু সে যদি হয়ও, সেতো শত ফুল। হাজার ফুলতো নয়!

আড়াই হাজার অনলাইন মিডিয়ার দেশে আড়াই হাজার সম্পাদক। তাদের অধীনে কম করে ১২ জন (শ্রম আইনের বিধান মতে একটি কারখানা হতে হলেও ১২ জন কর্মী প্রয়োজন) কর্মী থাকলে স্রেফ অনলাইনেই মিডিয়া কর্মী ৩০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। সারা দেশে বর্তমান সংবাদকর্মী কত তার সঠিক হিসাব নেই বটে, তবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বর্তমান সদস্য ৪ হাজার ৩০০ জন। তাহলে এতগুলো অনলাইন নিবন্ধন পেলে সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে যাবে অন্তত আরও ছয়গুণ। নাহ! আর হিসাব কষতে পারছি না!

অবশ্য সে হিসাব তুলে ধরাও এই লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়। এই লেখার উদ্দেশ্য একটাই- গত ২৬ এপ্রিল (শুক্রবার) গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস কনফারেন্স নিয়ে দুটো কথা বলা। আমি বলবো মাথায় যে হতাশার ভার বহন করে চলছিলাম, তার কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে সেদিন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিডিয়া সংক্রান্ত যে স্পষ্ট ধারণা তিনি সাংবাদিকদের সামনে শেয়ার করলেন, আমি হলফ করে বলতে পারি দেশের অধিকাংশ সংবাদকর্মীই সেটুকু ধারণা রেখে তার সাংবাদিকতার চর্চা করেন না। ভার লাঘব হলো এই কারণে যে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একটি আশার আলো দেখা গেলো। সুরঙ্গের ওপারে হলেও সে আলোটিই হয়তো পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতার বিকাশটি সঠিকভাবে ঘটতে পারবে।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ছিলো- যুগের প্রয়োজনে অনলাইন সাংবাদিকতা। এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে।

দেশে সংবাদপত্র শিল্প নানামুখী সংকটে পড়েছে সংবাদ সম্মেলেন এমন প্রসঙ্গের অবতারণা করে একটি প্রশ্ন করা হলে তার উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা হচ্ছে একটা যুগের অথবা প্রযুক্তির প্রভাব। প্রযুক্তি ও আধুনিকতার প্রভাবে এভাবে বিবর্তন আসতেই থাকবে।’

প্রযুক্তির উন্নতির ফলে আধুনিক যুগে পৃথিবীর বহু দেশে অনেক নামিদামি পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। ছাপা কাগজের পরিবর্তে সেখানে অনলাইন সংস্করণগুলো চলছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বললেন, অনেক নামিদামি পত্রিকা শুধু অনলাইনেই চলে; ছাপানোটা আর হয় না, একদম নাই। এ রকম বহু নামকরা পত্রিকা এখন চলে গেছে অনলাইনে। কাগজ আর ব্যবহারই হয় না।

গোটা বিশ্বে সংবাদমাধ্যমের গতিপ্রকৃতি প্রধানমন্ত্রীর নখদর্পনে। হওয়ারই কথা। তবে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানটি ছিলো সবচেয়ে বেশি আশা জাগানিয়া। তিনি বলেন, প্রযুক্তির উন্নতির ফলে বিবর্তন আসতেই থাকবে। তবে এই বিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে এটাই হলো বড় কথা।

আরও ভালো লাগলো যখন তিনি এই কথাটি যোগ করলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, প্রযুক্তির এই ব্যবহারে সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। প্রযুক্তি মানুষকে সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়, আরও আধুনিকতা এনে দেয় এ কথা ঠিক, প্রযুক্তি আবার সমস্যাও সৃষ্টি করে। আমরা যদি একই ধারাবাহিকতায় চলতে থাকি, তাহলে কিন্তু হবে না।

ওই যে মিডিয়া লিটরেসি, বাংলা করলে যা দাঁড়ায় গণমাধ্যম সাক্ষরতা, সেটুকু যে দেশের অধিকাংশ মানুষেরই নেই, সে কথা পই পই করে গত কিছু দিন ধরে শুধু বলেই চলেছি। আর সংবাদ সম্মেলনে সে কথাটাই বললেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

হাতে একটা কম্পিউটার পেয়ে, ইন্টারনেট কানেকশন পেয়ে অমনি একটি অনলাইন সংবাদপত্র বানিয়ে ফেললাম (ডমেইন কেনার জন্য মোটে ১৫০০ টাকা খরচ করে) আর রীতিমতো সম্পাদক বনে গেলাম, সেটাতো হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে সেটাই হচ্ছে। যার সংখ্যা হাজার হাজার।

এ দিকটাতেও আলোকপাত করলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি অবশ্য সেটা বলতে গিয়ে সংবাদপত্রের উদাহরণটি দিলেন বড় করে। বললেন, সংবাদপত্রের এই বেহাল অবস্থার কারণ রয়েছে। আমাদের দেশের মতো এত পত্রিকা পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। তথ্যও দিলেন, ৭০০ সংবাদপত্র রয়েছে এই দেশে। সিঙ্গাপুরের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, দেশটি মাত্র একটা পত্রিকা। সেটাও সরকার স্পনসর্ড। আমাদের মতো এত পত্রিকা কিন্তু কোনো দেশে নেই।

এখন প্রত্যাশা একটাই, প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তব্য থেকে শিক্ষা নিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় যেনো অনলাইন সংবাদমাধ্যমের জন্য নিবন্ধনের আবেদনগুলোকে একটি যথার্থ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচন করে। তাদের সিলেকশন প্রক্রিয়া যেনো স্বচ্ছ থাকে। দেশে যদি ২৩০০ অনলাইন মিডিয়া করার জন্য যোগ্য লোক থাকেন তাহলে আপত্তি নেই। কিন্তু অযোগ্যর হাতে যেনো আর না যায় দেশের একটি মিডিয়াও। যে জন্য ক্রাইটেরিয়া কী হবে তা মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই জানে। তার পরেও এই সুযোগে একটু উল্লেখ করে রাখতে চাই। সেটিই হবে একটি নতুন অনলাইন মিডিয়া যার শতভাগ নিজস্ব কনটেন্ট থাকবে। তা কম কিংবা বেশি। অন্যের কনটেন্ট চুরি করে যারা অনলাইন করবে, বা করছে তাদের ছাঁকনি দিয়ে বাদ দিতে হবে। এগুলো ধরার জন্য নানা ধরনের সফটওয়্যার রয়েছে। একটু চেষ্টা করলেই এইসব তথাকথিত সাংবাদিকদের ধরে ফেলা সম্ভব। চৌর্যবৃত্তিই যারা তাদের সাংবাদিকতার ব্রত হিসেবে ধরে নিয়েছে। এছাড়া যাদের নিজেদের অফিস রয়েছে, যারা ব্যাংক হিসাবে কর্মীদের বেতন দেয়। যারা ওয়েজ বোর্ড ফলো করে তাদেরও সহজেই আলাদা করা সম্ভব।

আর এসব করা হলে দেশে গোটা দশেক কিংবা তার কম বেশি অনলাইন মিডিয়াই টিকে থাকবে। আর সেটাই দরকার।

প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্স সে আশা জাগিয়ে তুলেছে বৈকি।

লেখক: মাহমুদ মেনন, নির্বাহী সম্পাদক, সারাবাংলা.নেট

এ সম্পর্কিত আরও খবর