একটি উৎসবমুখর পরিবার দিবস চাই

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান | 2023-08-30 10:40:30

সম্প্রতি চৈনিক নববর্ষ এবং চীনা জনগোষ্ঠীর বাঁধভাঙা আনন্দ উৎসবের আমেজ ও আয়োজন জীবনে প্রথম কাছ থেকে দেখার সুযোগ ঘটেছে। সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হওয়ায় বলা যায়, একটি নতুন সংস্কৃতির সাথে পরিচিতি ঘটলো। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম পনের দিন ছিল চৈনিক নববর্ষ উৎসব। তাদের নিজস্ব ‘লুনার কালেন্ডার’ অনুযায়ী নতুন চাঁদের সাথে এই নববর্ষের সম্পৃক্ততা রয়েছে যার উৎসব-আয়োজন পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।

পূর্ণিমা রাতের আগমনের জন্যই প্রায় মাসের অর্ধেক সময় ধরে সমগ্র চীনা জনগোষ্ঠী বাঁধভাঙা আনন্দে মেতে থাকেন। ধর্মীয় অনুশাসন যার যার হলেও নববর্ষ এখানে সার্বজনীন রূপ নিয়েছে। বিশেষ খাবার, নতুন পোষাকের পাশাপাশি সকলের মধ্যে উপহার বিনিময় করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আঞ্চলিক মেলা আয়োজনসহ বন্ধুত্বের বন্ধন নতুন করে সুদৃঢ় করে নেওয়ার জন্য সব প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে সবার মধ্যে।

ধর্মীয়ভাবে পূর্বপুরুষের মঙ্গল কামনাসহ স্বর্গ ও পৃথিবীর দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য বিশেষ প্রার্থনা, ভোজন এবং উপাচারের আয়োজন থাকে।

বিস্ময়ের সাথে দেখলাম, তারা পারিবারিক ও আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় করার জন্য নববর্ষের দিনগুলোতে ‘পারিবারিক দিবস’ হিসাবে পুনর্মিলনীর আয়োজন করে থাকে যা সবচেয়ে ভালো অনুভূতি যুগিয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল শুধু চীন নয়, বরং এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ যেমন জাপান, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামসহ প্রভৃতি দেশে একইভাবে এই আয়োজন করা হয়।

পারিবারিক বন্ধন ও পরিবারের বয়োজৈষ্ঠ্যদের মর্যাদা ও সম্মান প্রদানে চীন ও জাপান অত্যন্ত তৎপর। জাপানের জনগণ বয়োজৈষ্ঠ্যদের (যাদের পরিবার ও পরিবারের সদস্য আছে) সম্মান ও মর্যাদা প্রদানে পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। তারা মনে করেন, পিতা-মাতা এবং বয়োজৈষ্ঠ্যদের মর্যাদাহানি ঘটলে সমাজে তারা মুখ দেখাতে পারবেন না। উপার্জনের জন্য বছরের বেশির ভাগ সময় যারা পরিবারের বাইরে থাকেন, তারাও নববর্ষের এই দিনগুলোতে মা-বাবা, পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে বরাদ্দ করে রাখেন। নববর্ষ উদযাপনের পনের দিন তাই তাদের কাছে একটি স্বর্গীয় উৎসবের মত।

দুই.

এ কথা সত্যি যে, মা-বাবা ও পরিবারের প্রতি সন্তানের অকৃত্রিম ও বিনম্র শ্রদ্ধা, সম্মান এবং ভালোবাসা প্রকাশের বিষয়টি চিরন্তন ও সার্বজনীন বলে পৃথিবীর অনেক দেশে আন্তর্জাতিক ‘মা দিবস’, ‘বাবা দিবস’ ও ‘পরিবার দিবস’ পালন করা হয়। নিজের মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে (মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার, ১৮৭২ সাল) জুলিয়া ওয়ার্ড কর্তৃক ‘মা দিবস’ পালন করার রীতিকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ১৯১৪ সালে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মায়েদের জন্য উৎসর্গ করে ‘মা দিবস’ হিসাবে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন। দিনটি এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘আন্তর্জাতিক মা দিবস’ হিসাবে পালিত হচ্ছে।

অন্যদিকে, অনেকে মনে করেন, ১৯০৮ সালে আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার এক গীর্জায় প্রথম বাবা দিবস পালিত হয়। ১৯১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সনোরা স্মার্ট ডোড নামের এক তরুণী সর্বপ্রথম ‘বাবা দিবস’ আয়োজনের চিন্তা করেন। ১৯১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভায় বাবা দিবসে সরকারি ছুটি ঘোষণার বিল উত্থাপন করা হলেও ১৯২৪ সালে প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ বিলটিতে পূর্ণ সমর্থন দেন। আবার ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন ছুটি ঘোষণা করলেও প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ১৯৭২ সালে বাবা দিবসে সরকারি ছুটির বিষয়টির আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেন। পাশাপাশি, পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ ও সহমর্মিতার বন্ধন সুদৃঢ় করার জন্য জাতিসংঘ ১৫ মে ‘বিশ্ব পরিবার দিবস’ হিসাবে ঘোষনা করে (২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৩) এবং ১৯৯৪ সাল ‘বিশ্ব পরিবার বর্ষ’ হিসাবে পালিত হয়।

তিন.

গ্রামের কথা মনে পড়লে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমার/হেরিনু পল্লী জননী’ কবিতার কথা মনে পড়ে। বাংলাদেশের প্রায় সকল মানুষের সাথে গ্রামের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। গ্রামের পরিবেশে পরিবার নিয়ে বেড়ে উঠেছেন এমন মানুষের সংখ্যা তাৎপর্যপূর্ণভাবে অনেক বেশি। তাই, শিমুল-পলাশ-হিজলের বনবিথি ছায়া, কোকিল ডাকা মন মাতানো পরিবেশ, পাখির কিচির মিচির স্নিগ্ধ সকাল, দিগন্ত জোড়া ফসলের ক্ষেত, ধানের ক্ষেতের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদুমন্দ বাতাসে দুলে উঠা সবুজের ঢেউ, কিংবা নদীর বয়ে চলা জলের ছলাৎ শব্দ কি অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা করে। দোয়েল, ঘুঘু, বৌ কথা কউ, শালিখ, চড়ুই, শ্যামা, পাপিয়া, কাঠঠোকরা, মাছরাঙ্গাসহ কত পাখির কলরব গ্রামের পরিবেশকে মন মাতিয়ে মোহিত করে। পাকা আম-কাঁঠালের মৌ মৌ গন্ধ, ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর সুখ, কিংবা পাট পঁচা পানির ‘নস্টালজিক’ মোহনীয় গন্ধ গ্রামের পরতে পরতে।

বড় দুঃখের বিষয় হলো- বর্তমান প্রজন্ম যারা শহরে বেড়ে উঠছে, তারা অনেকেই গ্রাম ও তার বংশ কিংবা পরিবার, আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যাপারে উদাসীন। অনেক পরিবার আত্মীয়-স্বজনের সাথে সন্তানের মেলামেশা ও যোগাযোগ পছন্দ করেন না বরং সমাবস্থাসম্পন্ন না হওয়ায় মর্যাদাহানি মনে করেন। সন্তানের ‘পরীক্ষা ও পড়াশোনার ব্যাঘাত হয়’, এই অজুহাতে পরিবারের সদস্যদের শহরে বেড়াতে আসাকে নিরুৎসাহিত করেন কিংবা গ্রামে বেড়াতে যাওয়াকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন। তাই, নতুন করে ‘পারিবারিক বন্ধন’ সুদৃঢ় করার বিষয়টি রাষ্ট্রীয়ভাবে ভেবে দেখা যেতে পারে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে একটি ‘জাতীয় পরিবার দিবস’ উদযাপনের দাবি যৌক্তিক ও মানবিক।

চার.

বিজ্ঞান, পুঁজিবাদ ও বিশ্বায়ন গ্রাম-বাংলার গৌরবের ‘যৌথ পরিবার’ ভেঙেছে অনেক আগেই। আর সাম্প্রতিক সময়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ‘ভার্চুয়াল’ জগৎ মানুষকে অতি নিকটে এনেছে সত্যি কিন্তু আবেগের জায়গাটুকু নিঃশেষ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মানুষের মন আছে আবেগ নেই; পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থা-বিশ্বাস ও ভালোবাসা আছে কিন্তু কোথায় যেন গভীর এক সংহতিহীন শূন্যতা ভর করেছে। বিশ্বায়নের প্রভাবের জন্য হোক আর সমাজ পরিবর্তনের যে কোন কারণে হোক সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একমাত্র ধারক ও বাহক মানুষের আচরণ আজ আর আগের মত নেই। সামাজিকীকরণ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও আদর্শ পরিচর্যার মূল সূতিকাগার হচ্ছে পরিবার। প্রত্যেক পরিবার তার স্ব স্ব সদস্যদের অন্তরে আলোকর্তিকা হিসাবে কাজ করে। ‘পারিবারিক বন্ধন’ সুদৃঢ় করার জন্য সত্যিকার অর্থে পুনর্মিলনীর একটি বিশেষ দিনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ কথা সত্যি, ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেকেই পরিবারের সাথে সময় কাটান। তবে সেটার তাৎপর্য ‘ধর্মীয়ভাবে’ যতটা গুরুত্বপূর্ণ, স্বতন্ত্রভাবে ‘পারিবারিক’ পুনর্মিলনীর জন্য ততটা নয়।

একটি বিশেষ ‘পরিবার দিবস’ আয়োজন করতে পারলে বর্তমান প্রজন্ম নিজ পরিবার, বংশ ও আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কে পর্যাপ্ত আবেগ পরিচর্যার একটি জায়গা পেত এবং পারিবাবরিক ও সামাজিক মূল্যবোধ পরিচর্যার মহৎ একটি ক্ষেত্র তৈরি হত। শীত কিংবা হেমন্তে নবান্নের কোনো একটা সময় (বৃহস্পতিবার) বেছে নেওয়া যেতে পারে। যখন গ্রামগুলো সুন্দর করে সাজে, নতুন ধান ওঠে, ঘরে ঘরে পিঠা-পুলির আয়োজন চলতে থাকে। ঠিক সেই সময়ের সাথে বর্তমান প্রজন্মকে যদি পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়; পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য তা হত এক আশীর্বাদের মত। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় প্রত্যেক ইউনিয়নে ওই সময়ে একটি মেলার আয়োজন করতে হবে। তাতে দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, রীতিনীতি, প্রথা ও সমাজকাঠামোর সাথে বর্তমান প্রজন্মের পরিচয় ঘটবে।

একটি সত্য ঘটনা দিয়ে শেষ করতে চাই। শীতের কোনো এক সকালে শহরে বড় হওয়া একটি ছেলে বাসায় ফিরে বলছে, ‘গতকাল খুব ঝড় হয়েছে মনে হয়, বাজারে শুধু পেয়াজ আর পেয়াজ’। তার ধারণা পেয়াজ গাছে ধরে। সত্যিকার অর্থে শহরে জন্ম নেওয়া, বেড়ে ওঠা অনেকেই বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যবস্থা এবং গ্রামীণ জনজীবনের সাথে পরিচিত নয়। বাংলাদেশের সব মানুষের মধ্যে তার পরিবার ও গ্রামের প্রতি নাড়ির টানের গভীর এক সংযোগ ও সম্পর্ক সৃষ্টি করার মহৎ উদ্যোগ নিতে পারে রাষ্ট্র।

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান: পি.এইচ.ডি. গবেষক, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক ও সাবেক চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর