এ কেমন কৌশল

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-30 20:08:12

অনেক জল ঘোলা করে অবশেষে বিএনপি থেকে নির্বাচিত পাঁচজন শপথ গ্রহণ করে সংসদ অধিবেশনে যোগ দিলেন। অধিবেশনে যোগ দিয়েই বিএনপি সাংসদ হারুনুর রশীদ তার প্রথম বক্তব্যে, দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির ব্যাপারে সরকারের আইন কর্মকর্তারা যেন বাধা না দেন, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার বক্তব্য থেকে এমনটা মনে হতে পারে যে, বেগম জিয়ার দ্রুত মুক্তির তাগিদ থেকেই দলের নির্বাচিতরা কৌশলগত কারণে সংসদে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বলে ভিন্ন কথা। বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি এটাও বলে ফেললেন যে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দলকে রাজি করিয়ে তাদের সংসদে আসতে হয়েছে।

বিএনপি যে সংসদে যোগ দেবে না, এই বিষয়টি দলের চারজন সাংসদ গত ২৯ এপ্রিল শপথ গ্রহণের আগের দিনও দৃঢ়তার সাথে ব্যক্ত করা হয় এবং দলের নির্বাচিতদের সংসদে অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত রাখতে ইতোপূর্বে গত ২৫ এপ্রিল শপথ নেওয়া জাহিদুর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার কর হয়। বাকিরা যেন শপথ না নেন সেজন্য দলের প্ক্ষ থেকে চাপ দেওয়া হতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে দলের নেতা রুহুল কবির রিজভী আগাম জানিয়ে দেন যে সরকারের পক্ষ থেকে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে নির্বাচিতদের শপথ নেওয়ার ব্যাপারে। এটাও জানা যায় যে, লন্ডন প্রবাসী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাদের প্রত্যেকের সাথে আলাদাভাবে কথা বলে তাদের নিবৃত রাখার চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হলেন, তখন তাদের সংসদে যোগদানের বিষয়ে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়। যেদিন তারা শপথ নিলেন সেদিন রাতে মহাসচিব মির্জা ফখরুল আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দেন যে, কৌশলগত কারণে তাদের দলের নির্বাচিতদের শপথ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

তিনি নিজে কেন শপথ নিলেন না, এই প্রশ্নের জবাবে পরদিন সাংবাদিকদের মির্জা ফখরুল জানান, এটাও একটা কৌশল। তবে কী ধরণের কৌশল, সেটা তিনি ব্যাখ্যা করলেন না। তিনি ব্যাখ্যা না করলেও রাজনীতি সচেতন মানুষের বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হবার কথ নয় যে, তাদের কৌশলের ধরনটা আসলে কী। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলকে বর্জন করে বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে যখন সংসদে না যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়, বিপত্তির শুরু আসলে তখন থেকেই। বিভিন্ন মাধ্যমে একথা চাউর হতে থাকে যে, নির্বাচিতরা অনেক কষ্টে নির্বাচিত হয়েছেন সংসদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন অথচ দলের এই সিদ্ধান্ত তাদের ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার সাথে সাংঘার্ষিক, বিধায় এই সিদ্ধান্ত নাও টিকতে পারে।

এর আগে যখন ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক গণফোরাম থেকে নির্বাচিত দু’জন সাংসদ মোকাব্বির খান এবং সুলতান মোহাম্মদ মনসুর যথাক্রমে ২ মার্চ এবং ২ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করেন, তখন তারা দলের অনুমতি নিয়ে শপথ নিয়েছেন জানালেও পরবর্তিতে গণফোরামের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানানো হয়। অথচ সর্বশেষ সপ্তাহখানেক আগেও তাদের কাউন্সিলে দলের সাংসদ মোকাব্বির খানকে ড. কামাল হোসেনের পাশে বসতে দেখে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হয়। গণফোরামের সাংসদরা যে শপথ নেবেন, তা নির্বাচনের পরপরই দলের সাংসদদের প্রতিক্রিয়ায় বোঝা গিয়েছিল। দলের পক্ষ থেকে এটাও জানানো হয়েছিল যে, এ বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পরে এতে বাধ সাধে বিএনপি। আমরা একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাব যে, সেসময় সংসদে না যাওয়ার দাবিতে অনড় বিএনপির চাপেই গণফোরাম নেতা ঐক্যফ্রন্টে তার নেতৃত্ব বহাল রাখতে তারা কেউই সংসদে যাচ্ছেন না বলে ঘোষণা দেন।

ইতোপূর্বে বিএনপি’র শীর্ষস্থানীয় নেতারা সকলেই বলে আসছিলেন যে, কোনও অবস্থাতেই তারা সংসদে যোগ দেবেন না। তাদের সকলের বক্তব্যে এবং দলের নির্বাচিতদের অবস্থানের সার্বিক বিশ্লেষণে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে- দলের নেতৃত্ব চরমভাবে ভেঙে পড়েছে এবং সর্বত্রই এক ধরনের সমন্বয়হীনতা বিরাজ করছে। দল আসলে কে চালাচ্ছেন, কোথা থেকে পরিচালিত হচ্ছে, এটা আসলে কেউই জানেন না। কিছুদিন আগ পর্যন্ত সকলেই জানত, লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় দল পরিচালিত হচ্ছে। মির্জা ফখরুল এটা সংশোধন করে জানিয়ে দেন, যৌথ নেতৃত্বে দল পরিচালিত হচ্ছে। এই যৌথ নেতৃত্ব বলতে বোঝায় দলের স্থায়ী কমিটি। অথচ স্থায়ী কমিটি দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নেওয়ায় জাহিদুর রহমানকে বহিষ্কারের দুই দিনের মধ্যে অপর চারজন সংসদে যোগ দিয়েই জানান যে, তারা তারেক রহমানের নির্দেশে শপথ নিয়েছেন; যা পরবর্তীতে মির্জা ফখরুল নিজেও সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন।

এখন মির্জা ফখরুল যে কৌশলের অংশ হিসেবে এই সিদ্ধান্তের কথা জানালেন, দলের স্থায়ী কমিটির নেতারা যদি সেই কৌশলের অংশ না হন, তাহলে দল কীভাবে পরিচালিত হবে, তা পরিষ্কার নয়। এটা এখন জলের মত পরিষ্কার যে, দলের সাংসদদের শপথ নেওয়ার বিষয়ে স্থায়ী কমিটিতে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এমনকি স্থায়ী কমিটির অনেক সদস্যও এ বিষয়ে জানতেন না। সেই সাথে মির্জা ফখরুল নিজে শপথ না নিয়ে কি এটা প্রমাণ করলেন না যে- তিনি স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য হয়ে অপরাপর সদস্যদের মত সংসদে না যাওয়ার বিষয়ে একমত এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তকে তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন?

মির্জা ফখরুল শপথ না নেওয়াতে স্বাভাবিকভাবেই সংসদের প্রথম কার্যদিবস থেকে ৯০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ায় তার আসন শূন্য ঘোষিত হয়ে গেল। এই আসনটি পেতে ইতোমধ্যে সরকারি দলের একাধিক নেতা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তিনি (মির্জা ফখরুল) নিজে শপথ বর্জন করার অর্থ হচ্ছে তিনি উপ-নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন না। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি’র ভেতর আবারও নির্বাচন বর্জনের সংস্কৃতি চালু হওয়াতে আসন্ন উপ-নির্বাচনে কোনো প্রার্থী মনোনয়ন দেবে না, এটা ধরেই নেওয়া যায়। সুতরাং বিগত একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে বর্জন করে এবং এই সরকারের অধীনে পরবর্তী যেকোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণার পর তাদের দলের সাংসদদের শপথ নেওয়া এবং এটিকে কৌশল হিসেবে (অব্যাখ্যাত) চালিয়ে দেওয়া আসলে দলের বর্তমান রুগ্ন দশাকে চেপে রাখার কৌশল ভিন্ন আর কিছু না।

কিছুটা ব্যাখ্যা অবশ্য দিয়েছেন মির্জা ফখরুল। তার নিজের শপথ না নেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছেন, দলের মহাসচিব হিসেবে দলকে সংগঠিত করতে এবং দলের চেয়ারপারসনকে মুক্ত করতে তাকে বাইরে থেকে কাজ করতে হবে বিধায় তিনি সংসদে যাননি এবং যারা গিয়েছেন তারা সংসদে থেকে দলের পক্ষে কাজ করবেন। তিনি এটিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, “গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সীমিত সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্যই বিএনপি সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

আবার ফিরে আসি তাদের কৌশলের বিষয়ে। যে কৌশলটি তিনি মুখে ব্যাখ্যা না করলেও এখন সকলের মুখে মুখে তা হচ্ছে বিএনপি না চাইলেও তাদের নির্বাচিতদের সংসদে যাওয়া ঠেকানো যেতো না বলেই বাধ্য হয়ে তারেক রহমান এই সিদ্ধান্ত দিলেন। এখানে এই সিদ্ধান্তের ফলে শেষ সময়ে শপথ নেওয়া চারজন দলের সমর্থন পেলেও প্রথম শপথ নেওয়া জাহিদুর রহমান যেহেতু দলের সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করেছেন, তাই তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তটি বহাল রয়েছে। আবার মির্জা ফখরুল দলের সিদ্ধান্ত (যদিও তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্ত) অনুযায়ী শপথ না নিলেও সেটিকেও দল মেনে নিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা যত কৌশল অবলম্বনের কথাই জানান দিক না কেন, এটা বরং আরও স্পষ্ট হল যে, দলের ভেতর চরম নেতৃত্ব সংকট বিরাট করছে।

আসলে বিএনপির এই সংসদে যোগদানটি আরও সম্মানজনক হতে পারত যদি তাদের নেতৃত্বের মধ্যে সামান্যতম দূরদর্শিতা থাকত। তাদের এটা আগেই বোঝা উচিৎ ছিল যে, সংসদে না যাওয়ার ব্যাপারে দলীয় সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সাংসদরা মানবেন না। এটা আগে বুঝলে তারা দলগতভাবে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সংসদে গিয়ে তাদের সমর্থকদের মধ্যে দলের প্রতি আস্থাহীনতার সংকটকে অনেকটা দূর করতে পারতেন। সেই সাথে এই ইস্যুটিকে নিয়ে পরবর্তী সব নির্বাচন (সাম্প্রতিক উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ) বর্জন না করে এগুলোতে অংশ নিয়ে তারা রাজপথে থেকে তাদের কৌশলকে আরও শাণিত করতে পারত। সর্বশেষ শপথ নিয়ে যা হলো, এর মাধ্যমে তারা তাদের দেউলিয়াত্বকেই আরও বেশি করে সবার সামনে উন্মোচন করে দিল।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর