ছাত্রলীগের মাথায় বাড়ি দেবেন না

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-08-31 02:11:51

গত বছরের ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তিন বছর পর ওই সম্মেলন হয়েছিল। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দুই বছর পরপর ছাত্রলীগের সম্মেলন হওয়ার কথা। কিন্তু শুধু ছাত্রলীগ কেন, কোনো ছাত্র সংগঠনের সম্মেলনই নিয়মিত হয় না।

সম্মেলন হওয়ার এক বছর পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হল। কমিটি গঠন নিয়ে ১৩ মে যে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ছাত্রলীগের মতো বড় একটি সংগঠনে পদ-পদবির জন্য প্রতিযোগিতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনে পদের জন্য দৌড়ঝাঁপ আরও বেশি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। পদের সংখ্যা সীমিত। তাই সবাই পদ পাবে, সেটি সম্ভব না।

পদ না পেয়ে বঞ্চিতরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ করেছেন। পদ না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু পদবঞ্চিতদের ওপর পদপ্রাপ্তরা হামলা চালিয়েছেন, চেয়ার টেবিল ছুড়ে মেরেছেন, মারধর করেছেন, মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন। ঘটনার পর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আহতদের দেখতে হাসপাতালে গিয়েছেন। সেখানে আরেক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পদবঞ্চিতরা নতুন পূর্ণাঙ্গ কমিটিকে বিতর্কিত ও অবৈধ আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছেন। তারা বিতর্কিত এই কমিটির বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে শোভন-রাব্বানী সমর্থকরা তাদের ওপর হামলা চালায়। হামলায় আহতদের মধ্যে আগের কমিটির অনেক নেতাও আছেন, আছেন ডাকসুর নির্বাচিত নেতারাও। পুরো ঘটনাটাই আমাদের ব্যথিত করে।

বর্তমান কমিটিতে ৩০১ জনকে পদ দেওয়া হয়েছে। তারপরও অনেকে এখনও পদের দাবি করে যাচ্ছেন। বর্তমান কমিটিতে সহ-সভাপতি পদে আছেন ৬১ জন ও সাংগঠনিক পদে আছেন ১১ জন। এছাড়া অন্য সব পদেই বহু সংখ্যক সদস্য রাখা হয়েছে। নেতাকর্মীদের খুশি করতে পদের সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে, নতুন পদও সৃষ্টি করা হয়েছে, যা আগে ছাত্রলীগে ছিল না। যেমন- এবার সিনিয়র সহ-সভাপতি ও যুগ্ম সচিবের পদ বানানো হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইনের সঙ্গে সমন্বয় করে কমিটি গঠনের। তিনি কমিটি গঠনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকে। প্রধানমন্ত্রী শোভন ও রাব্বানীকেও একই নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, আগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের তালিকা থেকে কাউকেই রাখা হয়নি।

অভিযোগ আছে, এবার নাকি কমিটিতে রেকর্ড সংখ্যক বিবাহিতদের রাখা হয়েছে। বান্ধবীসহ ছবি ভাইরাল হয়েছে সভাপতি শোভনের। বান্ধবী থাকা গঠনতন্ত্রবিরোধী না। কিন্তু বিবাহিতরা ছাত্রলীগের কমিটিতে থাকতে পারেন না। এক সহ-সভাপতি নাকি দুই বিয়ে করেছেন। জানা যায়, নতুন কমিটিতে মোট ছয়জন বিবাহিত। রাব্বানী তার নিজ জেলার ২২ জনকে বিভিন্ন পদ দিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। এছাড়া অস্ত্র নিয়ে সংবাদের শিরোনাম হওয়া ব্যক্তিও পদ পেয়েছেন। পহেলা বৈশাখের কনসার্টে আগুন দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত অন্তত ২০ জন গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। নতুন কমিটিতে অছাত্র, বিবাহিত, মাদক ও হত্যা মামলার আসামিরাও আছেন। এছাড়া আরো নানা অভিযোগ আছে পদপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে।

শোভন-রাব্বাবী ছাত্রলীগের ক্লিন ইমেজ অনেকটাই পুনরুদ্ধার করতে পেরেছেন। নব্বই দশক থেকে ছাত্র রাজনীতি ও ডাকসুতে খড়া চলছে। ছাত্র সংগঠনগুলোর যখন বেহাল দশা এমনই এক সময়ে শোভন-রাব্বানীর হাতে ছাত্রলীগের দায়িত্ব দেওয়া নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সাহসী একটি পদক্ষেপ। প্রকৃত ছাত্র ও তরুণদের হাতে ছাত্রলীগের দায়িত্ব দিয়ে তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। ঢাবির আইন বিভাগের এই দুই শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন।

পদবঞ্চিতদের অভিযোগ যদি সত্য হয় তবে শোভন-রাব্বানীর ভূমিকা ও প্রধানমন্ত্রী যাদের কমিটি গঠনের দায়িত্ব দিয়েছেন, তাদের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তবে তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী সাহসী যে উদ্যোগ নিয়ে প্রকৃত ছাত্রদের হাতে ছাত্রলীগের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, এখন অছাত্র ও বিতর্কিতরা ছাত্রলীগে এলে ছাত্রলীগ আবার সেই পুরনো পথেই হাঁটবে।

পদপ্রাপ্তরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়েই এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। পদবঞ্চিতদের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বাইরে এ কমিটি করা হয়েছে। কোন পক্ষ ঠিক, তা হয়তো আমরা জানতে পারব না। জানা জরুরিও না। কিন্তু কার নির্দেশে পদবঞ্চিতদের ওপর হামলা করা হল, সেটি জানা জরুরি। দলের মাঝে অনেকের ক্ষোভ থাকতেই পারে, প্রতিবাদও করতে পারেন। আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সমস্যারই সমাধান হতে পারে। সংক্ষুব্ধদের ওপর হামলা চালিয়ে সমস্যার সমাধান কোনো কাজের কথা নয়। এতে সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হয় না। শুধু ছাই চাপা দেওয়া যায় মাত্র।

ছাত্র সংগঠনে কোন্দল নতুন কিছু নয়। রাজনীতির মধ্যেও রাজনীতি থাকে। অন্তর্কোন্দলের সেই রাজনীতির কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে কেউ পদ পায়, কেউ পায় না। কথায় আছে, অপর দলের বিরুদ্ধে রাজনীতির চেয়ে নিজ দলের ভেতরের রাজনীতি আরও কঠিন। এই আন্তঃকলহ ও অন্তর্কোন্দল অনেক সময় হিংসাত্মক রূপ ধারণ করে। সেটি কাম্য নয়। রাজনীতি বড় কঠিন। সত্তর দশকে বিরোধের জেরে ঢাবির মুহসীন হলে ছাত্রলীগের সাত কর্মী খুন হন। বিরোধের জেরে এক সময় ছাত্রলীগ কাদের-চুন্নু নামে দুই ভাগে ভাগ হয়েও যায়। এরও আগে আওয়ামী লীগ ও জাসদের উত্থানের কথাও আমাদের জানা আছে। বিরোধীতার শান্তিপূর্ণ সমাধান জরুরি। হিংসাত্মক ও রক্তাক্ত পথ কাম্য নয়।

আশার কথা, যে ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে তার সত্যতা যাচাই বাছাই করতে ২৪ ঘণ্টা সময় চেয়েছেন শোভন-রাব্বানী। হয়তো শুক্রবার (১৭ মে) নাগাদ আমরা এসব অভিযোগের একটি সুরাহা প্রত্যাশা করতে পারি।

মূল কথা হলো সংগঠনের গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কর্মকাণ্ডে কেউ জড়িত থাকলে তাকে কমিটিতে রাখা গঠনতন্ত্রবিরোধী। ছাত্রলীগ ঐতিহ্যবাহী একটি ছাত্র সংগঠন। প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য ছাত্র ও তরুণদের হাতে নেতৃত্ব দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। কাজেই কোনো অছাত্র, মাদকাসক্ত, হত্যামামলার আসামি, বিবাহিত, অস্ত্রমামলার আসামি বা বিতর্কিতকে নতুন কমিটিতে রাখা, ছাত্রলীগের জন্যই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। একবার নষ্টদের হাতে চলে গেলে তা থেকে বের হয়ে আসতে বহু বছর, এমনকি যুগও লেগে যেতে পারে। এমন নজির আমাদের দেশেই আছে। এজন্য ছাত্রলীগকেও কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। কাজেই, পদবঞ্চিতদের মাথা না ফাটিয়ে, পদবঞ্চিত ও পদপ্রাপ্তরা ঠাণ্ডা মাথায় বসে সমস্যার সমাধান করুন, যাতে ছাত্রলীগের মাথা উঁচু থাকে।

এরশাদুল আলম প্রিন্স: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর