ঢাকার পার্ক সংস্কারে গুরুত্বহীন উদ্ভিদ

, যুক্তিতর্ক

মোকারম হোসেন | 2023-09-01 05:02:02

কয়েক মাস আগেই বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জেনেছি, ঢাকার পার্ক ও খেলারমাঠ উন্নয়নের জন্য বিশাল কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শেষ হলে নগরবাসী নতুন করে আধুনিক মানের পার্ক ও খেলার মাঠ পাবে। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ।

দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকার অধিকাংশ পার্ক বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। সেগুলো পার্ক না ময়লার ভাগাড়, না ভবঘুরেদের আস্তানা তা বুঝে ওঠা মুশকিল। এ কারণেই পার্ক ও খেলার মাঠসহ সব বিনোদন কেন্দ্রেরই আধুনিকায়ন জরুরি। এটা নগরবাসীর প্রাণের দাবি। পাশাপাশি মূল শহরের বিভিন্ন প্রান্তে আরও বেশ কিছু পার্ক নির্মাণ করাও অত্যাবশ্যক। বিশেষত, উত্তরা ও পূর্বাচলে বড় আয়তনের কয়েকটি সুদৃশ্য পার্ক থাকা দরকার। কারণ ঢাকার ভবিষ্যতের আবাসনগুলো উত্তরা এবং পূর্বাচলমুখী। এখনই যদি এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা না হয় তাহলে ভবিষ্যতে সেটা অসম্ভব হয়ে উঠবে।

দুই কোটি মানুষের এই শহরে উল্লেখ করার মতো পার্ক নেই বললেই চলে। এ কারণে পার্কের প্রসঙ্গ এলেই আমরা শুধুমাত্র রমনা পার্কের কথা স্মরণ করতে পারি। শুধুমাত্র রমনা পার্কে তুষ্ট থাকার মনোভাব থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। নিতে হবে নতুন কর্মোদ্যোগ। আশা করি নগর কর্তৃপক্ষ সহসাই এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কিন্তু তার আগে চলমান সংস্কার কার্যক্রমেরও কিছু জরুরি সংস্কার প্রয়োজন।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন শতাধিক পার্ক ও খেলার মাঠ আধুনিকায়নে যে কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছে তা আংশিক ত্রুটিপূর্ণ ও বাস্তবতা বিবর্জিত মনে করি। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, আধুনিকায়নের এ কর্মযজ্ঞে শতাধিক স্থপতি একযোগে কাজ করছেন। কাজটি সমন্বয় করছেন কয়েকজন স্বনামধন্য স্থপতিও। এটুকু পর্যন্ত বিষয়টি সঠিক পথেই আছে। বিপত্তি তারপর থেকে। এ ধরনের কাজে স্থপতিরা অবশ্যই নকশা তৈরি করে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবেন। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবতা কখনোই এক নয়। নকশা তৈরির মাধ্যমে একটি স্বপ্ন তৈরি হয় মাত্র। এই স্বপ্নের ভেতর যদি সকল উপাদান সঠিকভাবে মেশানো না থাকে তাহলে তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে বাধ্য।

জানামতে, নকশা তৈরির সঙ্গে পার্কের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গগুলোর কোনো বিষয়-বিশেষজ্ঞ সম্পৃক্ত নেই। এ ক্ষেত্রে পার্কের মূল পরিকল্পনায় অসঙ্গতি থাকাটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এই পার্ক বা খেলার মাঠগুলোয় কি শুধু নতুন নতুন স্থাপনাই হচ্ছে? নাকি সেখানে গাছপালাসহ অন্যান্য অনুষঙ্গও যুক্ত হবে। যদি তা-ই হবে তাহলে এই কর্মকাণ্ডে কোনো উদ্ভিদবিদ, পরিবেশবিদ বা প্রাণিবিশেষজ্ঞ সম্পৃক্ত নেই কেন?

এমতাবস্থায় কিছু মৌলিক প্রশ্ন আমাদের সামনে চলে আসে। পার্কের জন্য সম্ভাব্য গাছগুলো নির্বাচন করছে কারা? কারা এর পরিবেশগত দিকগুলো দেখছেন? কারা প্রাণিবিশেষজ্ঞের কাজ করছেন? সবকিছুই কি স্থপতিদের দায়িত্ব? বই পড়ে পড়ে কি এসব করা যায়? তাহলে তো বাস্তব অভিজ্ঞতার কোনো দরকারই নেই। দেশে উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা বা পরিবেশবিদ্যারও কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে হয় না। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব বিভাগ খুলে অপচয় করছে নিশ্চয়ই!

বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমানে শুধু পার্কই নয়, যেকোনো বিনোদন কেন্দ্রের সঙ্গে পরিবেশের দিকগুলোও গভীরভাবে সম্পৃক্ত। পরিবেশগত দিকগুলো অগ্রাহ্য করে কোনো কিছু নির্মাণ বা সংস্কার অবশ্যই ত্রুটিপূর্ণ। তা ছাড়া এখন আর কোনো অবস্থাতেই নগরে অপেশাদার বা উটকো কাউকে দিয়ে এলোমেলো বা বিশৃঙ্খলভাবে বৃক্ষ নৈরাজ্য তৈরি করা যাবে না। এখন থেকে বৃক্ষায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিষয়-বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। তার কথা মানতে হবে, তার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। নগরের সমস্ত সেবামূলক কাজই নাগরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। নাগরিকদের স্বার্থ নিয়ে তামাশা করার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি।

যে কোনো পার্কের প্রধান অনুষঙ্গ বৃক্ষ। উদ্ভিদ বৈচিত্র্য বাদ দিয়ে পার্ক বানানো যায়? যদি যায়, তাহলে পার্কের সংজ্ঞা বদলাতে হবে। এখন ইচ্ছেমতো এলোপাতাড়ি কিছু গাছ লাগিয়ে দেবার দিন শেষ। পার্কগুলো কীভাবে দেশিয় উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সুসজ্জিত করতে হয় সে জ্ঞান না থাকলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পার্কগুলো দেখা উচিত। আমাদের স্থান ও সম্পদ দুটোই সীমিত। সুতরাং তা মাথায় রেখেই কাজটি করা উচিত।

সারাদেশে অনেক বিপন্ন প্রজাতির সুদর্শন উদ্ভিদ রয়েছে। সম্ভব মতো সেগুলো পার্কে রাখা প্রয়োজন। দেশের কোথায় কোন গাছটির ন্যাশনাল স্ট্যাটাস কী, আদতে কোন গাছটি পার্কে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন সেটি বৃক্ষ সংশ্লিষ্ট ব্যতীত অন্যদের জানার কথা নয়। তা ছাড়া পার্কে বৃক্ষায়ন অস্থায়ী বা ঠুনকো কোনো কাজ নয়। সরকার বদলের সঙ্গে পার্ক বদলে যাবে এমনও নয়। গাছ তো নির্দলীয় উপকারী বন্ধু। এ বিষয়ে নিশ্চয়ই কারো কোনো দ্বিমত নেই। পার্ক, উদ্যান বা খেলার মাঠ-সবই আমাদের জাতীয় সম্পদ। জাতীয় সম্পদের স্থান সকল ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে।

আরেকটি বিষয় স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন। পরিকল্পনামতো পার্কে লাগানো উদ্ভিদরাজির ভবিষ্যৎ পরিচর্যা কীভাবে হবে? এ ক্ষেত্রে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতাও আছে। আমরা দেখেছি, সাধারণত প্রকল্প চলাকালীন সময়ের পর রোপণকৃত উদ্ভিদের কোনো অস্তিত্বই থাকে না। এ ক্ষেত্রে যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। পরিপূর্ণ পেশাদারিত্ব নিয়েই পার্কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

উন্নত দেশে নগরবৃক্ষের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একটি আলাদা সংস্থা রয়েছে। ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতেও নগর কর্তৃপক্ষের অধীনে এমন একটি সংস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। যারা একাধারে পরিবেশ সংরক্ষণ, গাছ লাগানো, পরিচর্যা, পরিসংখ্যান তৈরি, নকশা প্রণয়নসহ যাবতীয় কাজের তদারকি করবে। কারণ বৃক্ষরোপণ এখন একটি বিশেষায়িত শিল্প। যা নগরের সৌন্দর্যকে নানাভাবে বাঁচিয়ে রাখে। পাশাপাশি নগরকে বাসযোগ্য রাখতেও সহায়তা করে।

গাছ লাগানোর পর আমরা পরিচর্যা করতে ভুলে যাই। কিন্তু গাছের পরিচর্যা অত্যন্ত জরুরি। বড় গাছগুলোর শিকড়, কাণ্ড ও ডালপালা নিয়মিত দেখাশোনা করতে হয়। মরে যাওয়া গাছ বা এর ডালপালা ও দুর্বল কাণ্ডের গাছগুলোর পরিচর্যা করা জরুরি। প্রয়োজনে ছেঁটে ফেলতে হবে। এগুলো পথতরু হিসেবে অনুপযুক্ত। কখনো কখনো এগুলো পথচারীদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

এমন বৃহৎ একটি পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে স্থাপত্যবিদ্যার সঙ্গে ব্যবহারিক উদ্ভিদবিদ্যার প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটাতে হবে। কারণ কাজটি মোটেও একতরফা কিছু নয়। নান্দনিক নিসর্গ নির্মাণের ক্ষেত্রে একাধিক বিশেষজ্ঞ মতামতের সমন্বয় আমাদের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে। এধরনের কাজে নিসর্গীদের প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটলে ঢাকার বৃক্ষবৈচিত্র ও ঋতুভিত্তিক পুষ্পসমারোহ বৃদ্ধি পাবে। আমরা চাই না, ঢাকায় আর অপরিকল্পিত, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও বিশৃঙ্খলভাবে বৃক্ষায়ন হোক, অথবা অবিবেচকের মতো মেহগনি গাছের জঞ্জালে ভরে উঠুক নগর উদ্যানগুলো। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যথাযথ নগর বিনোদন স্থাপনা তৈরিতে বিষয়-বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে বহুমুখী ও স্থায়ী ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। যা সবার জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে।

মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব।

এ সম্পর্কিত আরও খবর