সাগাই কিষেণ থেকে সাগাই ডিসি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ | 2023-08-30 22:30:40

উত্তরের আঞ্চলিক শব্দ সাগাই কিষেণ (কৃষাণ)। নব্বই দশকের দিকেও অনেক প্রচলন ছিলো। এরপর ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে গ্রামবাংলার এই সংস্কৃতি।

রংপুরের আঞ্চলিক শব্দ সাগাই অর্থ হচ্ছে আত্মীয়। আর কিষেণ অর্থ কৃষাণ (শ্রমিক অর্থে ব্যবহৃত)। অর্থাৎ বাবুদের ভাষায় আত্মীয় কৃষাণ বলা যেতে পারে। এখানে শুধু যে আত্মীয় থাকবে এমনটা কিন্তু নয়।

আত্মীয় এবং প্রতিবেশীদের দিয়ে সাগাই কিষেণ ডাকা হতো। কমপক্ষে ৫ থেকে শতাধিক কৃষাণও দেখার সুযোগ হয়েছে। এই শ্রেণির লোকেরা কাজের বিনিময়ে কোনো অর্থ পাবেন না। কাজের বিনিময়ে তাদের ভূড়িভোজের আয়োজন থাকবে। এখনকার দিনের কাবিখার মতো।

সেটা হতে পারে আখ মাড়াই, ধান রোপণ, ধান কাটা, পুকুর খনন। ধান রোপণ, ধান কাটা ও মাড়াইয়ের সময় এর প্রচলন বেশি দেখা যেতো। যেহেতু সময় কম পাওয়া যেতো সে কারণে অনেক লোক দিয়ে দ্রুত কাজ শেষ করা হতো।

আবার আষাড় মাসে যখন বৃষ্টি নামে দ্রুত জমি চাষের প্রয়োজন। পানি শুকিয়ে গেলে ধার রোপণ করা যাবে না। তাই দ্রুত সময়ে জমি চাষের জন্য সাগাই হালের ব্যাপক প্রচলন ছিলো। আশপাশের গ্রাম থেকে গরু মহিষের হাল নিয়ে ভোররাতে নেমে যাচ্ছে জমিতে।

সাগাই কিষেণ কিংবা সাগাই হাল মানেই গেরস্থের বাড়িতে সাজসাজ রব। মেয়ে-জামাই, বোন-ভগ্নিপতিকেও দাওয়াত করে আনা হতো এমন দিনে। কোনো কোনো পরিবারে এসব আত্মীয়রাও কাজে অংশ নিতেন। আবার কেতাদুরস্তদের শুধুই ভুড়িভোজের জন্য ডাকা হতো।

অর্থাৎ মাঠে যখন শতাধিক লোক ধান রোপণ করছে কিংবা হাল ঘুরছে তখন ওই গেরস্থের ঘরে গরু-খাসি জবাই ও পিঠা-ক্ষীর পাকানোর ধুম। সাগাই কিষেণরা দুপুর পর্যন্ত কাজ করে গোসল শেষে ভূড়িভোজে অংশ নিতেন। উঠানে লম্বা চট বিছিয়ে তাদের খাবার পরিবেশন করা হতো।

হাঁটুতে-হাঁটু লাগিয়ে বসার রীতি ছিলো জন্মের ভাব জাগানিয়া বসা। কাজ থেকে খাওয়া পুরোটাই তাদের কাছে একটা বিনোদনের বিষয় ছিলো। মাঠে যখন কাজ চলতো তখন ক্ষেতের আইলে উচ্চ ভলিয়মে টেপ রেকর্ডার বাজানো হতো। তখনকার দিনে জারি-সারি গান ও কেচ্ছা-কাহিনী বেশি স্থান পেতো।

আবার এমনও দেখা গেছে। মাঠে শতাধিক লোক কাজ করছে। আর তার পাশেই হয়তো কেউ দোতরা কিংবা একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে চলছেন। সেও কিন্তু কিষাণের পার্ট। অন্যদের সঙ্গে গোসল করে ভূড়িভোজে অংশ নিতেন। সব মিলিয়ে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ।

এই সাগাই কিষেণের আরেকটি ভার্সন ছিলো। সেটি হচ্ছে- ১০ থেকে ৫০ জনের গ্রুপ তৈরি হতো। তারা একে অপরের মধ্যে এমন গ্রুপ তৈরি করে সবাই মিলে একেকদিন একের জনের জমিতে কাজ করতো। দশ জনের গ্রুপ হলে দশম দিনের দশম ব্যক্তির জমিতে কাজ করতো সকলে মিলে।

এখানেও খাবারের আয়োজন থাকতো। তবে সেটা এলাহি আয়োজন হতো না। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো মিলে মিশে কাজ করা। তারা যেমন একসঙ্গে কাজ করতেন, একসঙ্গে বাজার যেতেন। তাদের মধ্যে ছিলো গলায় গলায় ভাব। অনেকে একই রঙের শার্ট-লুঙ্গি পরতেন।

সাগাই কিষেণের ক্ষেত্রে দেখা যেতো যে বাড়িতে খাবার ভালো হতো। সেসব গেরস্থ হয়তো পঞ্চাশজনকে ডেকেছেন। অনেকে ডাক না পেলেও লোকমুখে শুনেই হাজির।

আমার দেখা এক কৃষক এক’শ জনকে ডেকেছিলেন। সেখানে ছোট-বড় হাজির হয়েছিলেন আড়াই’শ জনের মতো। কৃষক তখন তার বয়সী গাভীটি জবাই দিয়ে ভূড়িভোজ সারেন। আবার যারা ‍কৃপণ লোকজনকে ঠিকমতো খাওয়াতেন না। তাদের দাওয়াত অনেকে এড়িয়ে চলতো। শোনাতেন ব্যস্ততার কথা।

সম্প্রতি ধানের দাম কম ও শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটতে নানান শ্রেণি পেশার লোকজনকে দেখা যাচ্ছে। এতে যেমন পীরগঞ্জের চতরায় অধ্যক্ষ ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে মাঠে গেছেন। আরেক জায়গায় দেখলাম জেলা প্রশাসক অন্যান্য কর্তাদের নিয়ে গেছেন ধান কাটতে।

এটা আমার কাছে সাগাই কিষেণের নতুন ভার্সন মনে হচ্ছে। এটাকে আমি স্বাগত জানাই।

তবে এ নিয়ে ফেসবুক সোসাইটির কারো কারো মধ্যে গাত্রদাহন শুরু হয়েছে। যাদের কাম-কাজ নেই নিজেরা ফেসবুকে রাজা-উজির মারতে ব্যস্ত। যাদের না আছে সময় জ্ঞান, না আছে রুচিবোধ। কখনও গরম থেকে বাঁচতে উদোম গায়ের গোসলের ছবি। আবার দাফন করতে গিয়েও সেলফি খিঁচতে ব্যস্ত।

আমাদের সময়ে স্কুলের মাঠ থেকে বাথরুম নিজেদের পরিস্কার করতে হতো। আমার মনে হয় আজকের মন্ত্রী, সচিব ও শিক্ষাবিদরা অনেকেই এটা করে এসেছেন। তাতে কি তাদের মানসিক বিকাশ বাঁধাগ্রস্থ হয়েছে!

বিদেশিদের প্রেসক্রিপশনে আমরা নতুন পদ্ধতি চালু করেছি। সেই পদ্ধতি আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে কতটুকু মানবিক মানুষ গড়তে পারছে! এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তাই শিক্ষার্থীদের মাঠে নেওয়া-যাওয়া দু’টোকেই আমি ইতিবাচক মনে করি। আমার মনে হয়েছে হাতি গেলে বিশেষ প্রাণী ভুগবেই। তুমি এগিয়ে চলো অধ্যক্ষ আব্দুর রব ভাই।

লেখক: স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
মেইল: shirajpress@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর