মুজাহিদদের মর্মব্যথা ও আমাদের উন্নয়ন

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ | 2023-09-01 15:57:18

প্রায় পৌনে তিন বছর পর হোসাইন মুহাম্মদ আল মুজাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। দেখা হতেই স্বাভাবিকভাবে স্মৃতি রোমন্থন। একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললেন, ভাই বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। আমি যে গাছগুলো লাগিয়ে এসেছিলাম সেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে।

অনেক কষ্টে নিজ হাতে ভেষজ ও ফলদ বাগান দু’টি করেছিলাম। টাকা না থাকায় ধার কর্জ করতে হয়েছিল। শ্রমিকের টাকা ছিল না, নিজে এবং অফিস স্টাফদের নিয়ে রোপণ করেছিলাম। কিছু টাকার জন্য একটি বিল করেছিলাম, সেই বিলও...! থাক সেসব কথা।

কাকতালীয় বিষয় হলো, ২০১৬ সালের অক্টোবরে তিনি যখন সরকারি গাড়ির পেছনে করে ওই চারাগুলো নিয়ে মেঘলা পর‌্যটন কেন্দ্রের পথে ছুটছিলেন, তখনই তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল।

পুলের গাড়ির পেছনে এমন নানান জাতের গাছের চারা দেখে বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলে বলেছিলেন, চলেন, নিজের চোখে দেখবেন কী করি। সেদিন সোজা নিয়ে গিয়েছিলেন বান্দরবান জেলা প্রশাসন পরিচালিত অন্যতম পর‌্যটন কেন্দ্র মেঘলায়ে। সেদিন সেখানকার একটি টিলা খাঁ খাঁ করছিল। বলেছিলেন, এখানে ভেষজ ও ফলদ উদ্যান হবে। বান্দরবান জেলা প্রশাসন দিলীপ কুমার বণিক অনুমতি দিয়েছেন।

কেটে ফেলা হয়েছে বাগান, ছবি: বার্তা২৪.কম



বলতে বলতেই সেদিন দু’জন শ্রমিকের সঙ্গে বৃক্ষ রোপণে লেগে গিয়েছিলেন। কাজ করতে করতেই বলেছিলেন মহাপরিকল্পনার কথা। মানুষ যাতে ঘুরতে এসে ভেষজ ও ফলদ গাছের সঙ্গে সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারে, সেভাবে প্লান করা হচ্ছে। যেভাবে বৃক্ষ উজাড় হচ্ছে, তাতে শিশুদের জানার সুযোগ কমে যাচ্ছে। এখানে গাছগুলো বাঁচিয়ে তোলা বেশ কষ্টকর। কারণ পানি দিতে হবে নিয়মিত। তিনশ’ ফুট নিচের লেক থেকে পানি আনা কঠিন ও ব্যয়বহুল।

সেই বাগান দু’টি পৌনে তিন বছরে নাকি বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছিল। ছবিও দেখালেন। বাগানটির সৃজনকারীরা কেউই আর বান্দরবানে নেই। জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক এখন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে। আর অন্যতম উদ্যোক্তা মুজাহিদ নানা ঘাটের জল খেয়ে এখন কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দায়িত্বে।

স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে হোসাইন মুহাম্মদ আল মুজাহিদের (বাম দিক থেকে দ্বিতীয় ) গাছের চাড়া রোপণের একটি মুহূর্ত, ছবি: বার্তা২৪.কম

 

যেখানেই থাকতেন নিয়মিত ফোনে খোঁজ নিতেন। গাছগুলো বড় হয়েছে জেনে নাকি তার অন্যরকম ভালোলাগা তৈরি হতো। কাছের কিছু লোকের মাধ্যমে মাঝে মধ্যে ছবিও সংগ্রহ করতেন। কিন্তু নতুন জেলা প্রশাসক এসে কিছু পুরনো গাছসহ সেই বাগানদু’টির সব কেটে ফেলেছেন। এখানে নাকি মাল্টার বাগান করা হবে। ছোট গাছগুলিতে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়েছে।

বড় গাছগুলো কাটা হয়েছে এবং ছোটগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, ছবি: বার্তা২৪.কম



এই খবরে যারপর নাই কষ্ট পেয়েছেন। আক্ষেপ করে বলেছেন, মাল্টা বাগানের জন্য কি আর কোথাও জায়গা নেই। কেন একটি বাগান পুড়িয়ে দিতে হবে? আমার মাথায় আসে না। আপনজন বিয়োগের মতোই মনোবেদনা সৃষ্টি হয়েছে।

তাকে কেউ বৃক্ষপ্রেমিক, কেউ বৃক্ষপাগল বলে অভিহিত করতেন। সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা যখনই সময় পেতেন গাছ নিয়ে ছুটতেন। তিনি যে ডর্মেটরিতে থাকতেন তার আশপাশ ও অফিসার্স ক্লাব তখন খাঁ খাঁ করত। তার হাতের ছোঁয়ায় সেসব স্থান আজবৃক্ষ আচ্ছাদিত। ছবি দেখালেন আগের ডর্মেটরি কেমন ছিল আর এখন কেমন আছে। বললেন, পেয়ারা ও আম গাছগুলোতে এবারফল এসেছে। ছবি দেখে কি যে আনন্দ পেয়েছি, বলে বোঝাতে পারব না। সোনালু গাছও ফুলে ফুলে ভরে গেছে।


পুড়িয়ে ফেলার আগে মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র, ফাইল ছবি



শুধু কি ডর্মেটরি আর অফিসার্স কোয়ার্টার? কারাগার থেকে পাহাড় যেখানেই জায়গা পেয়েছেন সেখানেই গাছ রোপণ করেছেন। বান্দরবানের পর্যটন বিকাশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। মেঘলা, নীলাচল, প্রান্তিক লেক ও চিম্বুক তার হাতেই পূর্ণতা পেয়েছে।

আবার নীল দিগন্তের মতো অসংখ্য নতুন পর্যটন কেন্দ্র আবিষ্কার করে পর‌্যটক উপযোগী করে ‍তুলেছেন। তার এই বিরামহীন ছুটে চলা বান্দরবানের মানুষ দারুণ ভাবে মনে রেখেছে। ফেসবুক খুললেই তার আলামত পাওয়া যায়। তার জন্য হাহাকার করছেন বান্দরবানবাসী। বলা চলে দিলীপ কুমার বণিক ও মুজাহিদকে হারিয়ে ধুকছে বান্দরবানের পর‌্যটন।

tree

মুজাহিদ এরপর আলো ছড়িয়েছেন যশোরের মনিরামপুরে। সেখানেও সবুজায়ন শুরু করেছিলেন। একই সঙ্গে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দায়িত্বে থাকায় শতশত একর জমি ও জলাশয় অবৈধ দখলমুক্ত করতে সক্ষম হন। যশোর থেকে নওগাঁ যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে।  সেখান থেকে এখন কক্সবাজারে।

হৃদয়ের গহীনে বিশাল জায়গা জুড়ে স্থান করে নিয়েছে বান্দরবান। অন্যরা যখন বান্দরবান এড়িয়ে চলতেন, ঠিক সেই সময়ে ট্রেনিং শেষে বুক উঁচিয়ে বলেছিলেন, স্যার আমি পার্বত্য এলাকায় যোগদানে আগ্রহী। সেদিন তার সাহস দেখে সাধুবাদ দিয়েছিলেন বিভাগীয় কমিশনার। এরপর অল্পদিন থাকলেও মনিরামপুরের জন্য তার মন কাঁদে।

এক সময় যে ডরমেটরি চত্বর ছিল গাছশূন্য (প্রথম ছবি), তার ছোঁয়ায় সেই চত্বর এখন ফুলে ফলে ভরে গেছে, ছবি: বার্তা২৪.কম  



বান্দরবানের ভালো-মন্দ সব খবর এখনও ইথারে ভেসে আসে তার কাছে। বললেন, বান্দরবানে কিছুদিন জেল সুপারের দায়িত্বে ছিলাম। জেলখানাতেও অসংখ্য ফল ও ফুলের গাছ লাগিয়েছি। অনেক বন্দি জেল থেকে বের হয়ে স্মরণ করেন, ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান। আমিও গ্রহণ করি সাদরে। আমি একটি বৃক্ষ রোপণে যতটা প্রশান্তি পাই, ততটাই কষ্ট পাই গাছ কাটার কথা শুনলে।

আমাদের দেশে এ রকম অনেক মুজাহিদ রয়েছেন। যারা উদ্যোম নিয়ে কাজ করে চলেছেন। কিন্তু তাদের চলে যাওয়ার পর আর ভালো কাজগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার লোক খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। এভাবেই অনেক ভালো কর্ম কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে।

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ: স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর