ধান নিয়ে ধান্দাবাজি, চাল নিয়ে চালবাজি

, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-12-31 17:57:05

ধান্দাবাজি আর চালবাজি আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত দুটি শব্দ। আমরা সবাই কথায় কথায় বলে থাকি, 'দেশটা ধান্দাবাজে ভরে গেছে, চারদিকে চালবাজ'। ধান্দাবাজ বলতে আমরা সাধারণত লোভী, স্বার্থপর ব্যক্তিকে বোঝাই। এছাড়া এর আরও নানা অর্থ আছে-বেআইনি কারবার করা লোক, কালোবাজারের ছোটোখাটো দালাল, অর্থলিপ্সু ব্যক্তি, অর্থপিশাচ ইত্যাদি। কলিকালে নির্লোভ ও নিঃস্বার্থ লোক পাওয়া কঠিন। ভোগে নয়, ত্যাগেই সুখ, এমন কথা একালের মুনি-ঋষিরাও তলে তলে ঠিক বিশ্বাস করেন না। দেবতার চরণে কিছু না দিলে আশীর্বাদও মেলে না, সেখানে আমরা অধম বঙ্গসন্তানরা নির্লোভ জীবন যাপন করব, এমন দিব্যি দেই কী করে?

তাই একটু আধটু ধান্দাবাজি, চালবাজি এ আর এমন কী? চালবাজ মানে চালু, কায়দাবাজ। এক কথায় গুটিবাজ। আমরা নিজের স্বার্থ আদায়ের জন্য বিভিন্ন কায়দা-কানুন ও ফন্দি এঁটে থাকি। এমন ধান্দাবাজ ও চালবাজ লোকে দেশ সয়লাব। অফিস, আদালত, বাস্তাঘাট, সদরঘাট, হোটেল, ফলের আড়ত-সব জায়গাতেই ধান্দাবাজ ও চালবাজরা ওত পেতে আছে। তবে, সবাই যে ধান্দাবাজ ও চালবাজ বিষয়টা তেমন নয়। সব ছাগল কলপ মাখা নয়। অরিজিনাল কালো ছাগলও হাটে পাওয়া যায়।

ধান্দাবাজ ও চালবাজরা অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায়। তাদের কোনো বাছ-বিচার নেই। ফলে ধান্দাবাজ ও চালবাজরা দিনকে দিন ফুলে ফেঁপে উঠছে। আর গরিব আরও গরিব হচ্ছে।

অনেক ধান্দাবাজ ও চালবাজদের আবার সিন্ডিকেট আছে। নিজ নিজ পেশা ও ব্যবসায় সবাই এই সিন্ডিকেট মেনে চলে। সিন্ডিকেটের বাইরে এক ছটাক সরিষার তেলও পাবেন না। এই সিন্ডিকেট দেশের সর্বত্র বিস্তৃত। যেকোনো ব্যবসা বা সরবরাহ শৃঙ্খলের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই সিন্ডিকেট বিস্তৃত। এই সিন্ডিকেটের বাইরে দেশে ভিক্ষা করারও সুযোগ নেই। সেখানেও সিন্ডিকেট।

এই ধান্দাবাজ ও চালবাজ সিন্ডিকেটের জন্যই দেশের গরিব আরও গরিব হচ্ছে। এর বড় প্রমাণ দেশের কৃষক সমাজ। এই কৃষক নিজের সবটুকু পুঁজি খাটিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজের ক্ষেতে বা বর্গা চাষ করে কোনোরকম খেয়ে পরে বাঁচতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই কৃষকের কোনো প্রতিনিধি নেই। দেশে, ভোটে, সংসদে, একনেক-এ এদের হয়ে কথা বলার কেউ নেই। সামাজিক স্তরবিন্যাসে গ্রামে কৃষকের নিচে কেউ নেই, যেমন শহরে রিকশাওয়ালার নিচে কেউ নেই। তারা সমাজের সবচেয়ে নিচু স্তরে অবস্থান করে। তারা কাউকে শোষণ করতে পারে না। কারণ, তার নিচে আর কেউ নেই। আর পুরো সমাজ ও রাষ্ট্র তার উপরে অবস্থান করে। সমাজের বাকি সবাই ব্রাহ্মণ।

দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধীরে ধীরে উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত হতে শুরু করেছে। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। কিন্তু কৃষক সারাজীবন কৃষকই থেকে গেল। তাতেও ক্ষতি নেই, যদি অন্তত খেয়ে পরে বাঁচতে পারত। ওই সিন্ডিকেট শেষ পর্যন্ত কৃষকদের রিজিকের ওপর হাত দিয়েছে। ওই সিন্ডিকেট ধানের বাজারের এমন এক অবস্থা করেছে যা কৃষকের পাকা ধানে মই দেয়ার সমান। কৃষকও তাই বাধ্য হয়ে নিজের পাকা ধান ক্ষেতে আগুন দিয়েছে।

টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল মালেক তার ধান ক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তার দেখাদেখি আরও কয়েকজন এরকম কাণ্ড ঘটিয়েছে। এদেশের সবাই কৃষকদের সঙ্গে মশকরা করেন, কারণ কৃষকরা বেকুব। তারা কিছুই বোঝে না। দেশের মন্ত্রী এমপিরাও তাদের সঙ্গে মশকরা করতে ছাড়েন না। একমন্ত্রী বললেন, 'সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্যই এই অগ্নিকাণ্ড'।

কিন্তু এ জাতীয় অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে। নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর ব্যবস্থা নিলে চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ড ঘটত না। তেমনি আব্দুল মালেকের ধান ক্ষেতে যে অগ্নিকাণ্ড হলো একে স্রেফ বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখলে সামনে আরও বড় বেকায়দা আসতে পারে।

ধান-চালের বাজার ও সিন্ডিকেট নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না। ধান-চালের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। প্রকৃত কৃষকরা যাতে ধান-চালের ন্যায্যমূল্য পায় সেটা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে যদি খরচ হয় ১৪ হাজার টাকা আর সে ধানের দাম যদি ওঠে ১০ হাজার টাকা, তবে কৃষকদের ধান চাষ করে কী হবে? ধান আমদানি করে দেশের ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চিন্তা করার চেয়ে বড় আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত আর হতে পারে না। কাজেই দেশ বাঁচাতে হলে, দেশের মানুষ বাঁচাতে হলে, ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কৃষক বাঁচাতে হবে।


সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য কোটি টাকার গাড়ি কিনুন, ভালো কথা। কিন্তু তাই বলে কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য পাবে না, তা হতে পারে না। কৃষক ভর্তুকি চায় না। আর যদি প্রয়োজন হয় তাও দিতে হবে। কিন্তু তার আগে সিন্ডিকেট ভাঙুন। প্রকৃত কৃষকের কাছে থেকে ন্যায্য মূল্যে ধান কেনার ব্যবস্থা করুন। ধান সংগ্রহের জন্য দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য গুদাম নেই। সেদিকেও সরকারকে নজর দিতে হবে। ধান-চালের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা দেশ ও মানুষের জন্য জরুরি। সবকিছু নিয়ে ধান্দাবাজি করা ঠিক নয়। যারা এসব করছে তাদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। ধান নিয়ে ধান্দাবাজি ও চাল নিয়ে চালবাজি বন্ধ করতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে এটাই কাম্য।

লেখক: এরশাদুল আলম প্রিন্স: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর