ধানের মূল্য বৃদ্ধি পাইবার আগেই কৃষক নিঃস্ব হইয়া গেল

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-09-01 02:45:26

চাঁদ দেখা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি থাকলেও ঈদের আনন্দে তা ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। আমরা সবাই বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় ঈদ উদযাপন করেছি। ঢাকাকে ফাঁকা করে অনেকেই শিকড়ের টানে গ্রামের বাড়ি ঘুরে এসেছেন।

লম্বা ছুটি শেষে সবাই আবার কাজে ফিরছেন। ঈদ উৎসব শেষ হতে না হতেই আমরা মজে গেছি ক্রিকেট উৎসবে। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলছে। এবার আমাদের স্বপ্ন সেমিফাইনাল খেলার। তাই ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতির অন্ত নেই। এর মধ্যেই জাতি ঢুকে পড়েছে বাজেট উৎসবে। সব মিলিয়ে চারদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ। কিন্তু আমরা কি কেউ খবর রেখেছি, যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের জন্য খাদ্য উৎপাদন করেন, সেই কৃষকরা কেমন আছেন? ক্রিকেট বা বাজেট নিয়ে মাথা ঘামানোর মত সময় হয়তো তাদের নেই। কিন্তু আর সবার মত ঈদ আসে তাদের জীবনেও। বছরে অন্তত একবার ঈদে সন্তানের জন্য নতুন পোশাক, ঈদে একটু ভালো খাবারের আকাঙ্ক্ষা থাকে কৃষক পিতারও। কিন্তু যতটুকু খবর পেয়েছি, তাদের ঘরে ঈদ এলেও, আনন্দ আসেনি। পত্রিকায় খবর দেখেছি, এবার গ্রামের হাট-বাজারে ঈদের কেনাকাটা জমেনি। জমবে কীভাবে? কৃষকের হাতে তো টাকা নেই। সারা বছরে তাদের আয়ের সবচেয়ে বড় যে উৎস, সেই বোরোতে এবার সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেয়েছেন। এখন তাদের চিন্তা সারা বছরের খোরাকির, উৎসব করার কথা ভাবারও অবকাশ নেই।

এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু ধানের দাম। অনলাইনে, অফলাইনে, গণমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন ধানের দাম নিয়ে তুমুল আলোচনা। ইদানীং আর কেউ কো্নো দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে নামেন না। প্রতিবাদহীন, নির্বিকার এই সময়ে তবু কেউ কেউ ধানের দাম কমে যাওয়ার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি কোনো। ধানের দাম বাড়েনি। অন্তত কৃষকের উৎপাদন খরচের ধারে কাছেও যায়নি। ধানের দাম বাড়াতে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বটে। কিন্তু সেগুলো সময়ের অনেক পরে। বোরো ধানের মৌসুমে প্রতিবারই দাম নিয়ে এই হাহাকারটা হয়। কোনো বছর হঠাৎ বৃষ্টি, অকাল বন্যায় বোরো ভেসে যায়। এবার বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। আর দামের পতনও হয়েছে বাম্পার। সরকারের যারা নীতি নির্ধারক; যারা কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় চালান; তাদের তো আগেই এই হিসাবটা থাকার কথা। কখন বোরো মৌসুম শুরু হবে, এবার ফলন কেমন হবে, ফলন ভালো হলে দাম কমতে পারে; এই বিষয়গুলো তো তাদের আগেই জানা থাকার কথা। কারণ তাদের কাজই তো এটা। সে অনুযায়ী তাদের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। কিন্তু ধানের দাম বাড়াতে সরকার কিছু ব্যবস্থা নিল বটে, তবে বড্ড অসময়ে। চালের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হলো মে মাসের শেষ দিকে। অথচ এপ্রিলের শুরুতেই সরকার চাইলে এ সিদ্ধান্ত নিতে পারত। কৃষকদের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার একটি বড় উপায় হলো সরকারের ধান কেনা। কিন্তু সমস্যা হলো সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতো না। তবে এবার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুরুতে দেড় লাখ টন ধান কেনার কথা থাকলেও পরে তা বাড়িয়ে চার লাখ টন করা হয়েছে। তবে এই পরিমাণ খুবই কম। বোরোর উৎপাদন হবে প্রায় দুই কোটি টন। সেখানে সরকার কিনবে মাত্র চার লাখ টন। সমস্যা হলো আরো বেশি ধান কিনে রাখার মত জায়গা নেই সরকারের। ক্ষুদ্র-প্রান্তিক কৃষকের তো নেই-ই। আর ধান রাখার মত জায়গা খাকলেও দাম বাড়ার জন্য অপেক্ষা করার সামর্থ্য থাকে না। তাই লাভটা হয় শেষ পর্যন্ত চালকল মালিকদেরই।

সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে বটে। তবে সরকারের মন্ত্রীদের যথেষ্ট সংবেদনশীল মনে হয়নি। তাদের কথাবার্তায় কৃষকদের প্রতি মমতার ঘাটতি ছিল। কদিন আগে সরকারের এক নীতিনির্ধারক আমলা, মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে বললেন, সরবরাহ বাড়লে দাম কমবে। এটাই নিয়ম। এটা সবাইকে মেনে নিতে হবে। আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তিনি আরো ব্যাখ্যা করলেন, এখানে পক্ষ তিনটি উৎপাদনকারী কৃষক, ব্যবসায়ী এবং ভোক্তা। সরকার এখানে কোনো পক্ষ নয়, সরকার রেফারি মাত্র। রেফারির কোনো পক্ষ নেওয়া ঠিক হবে না। আমার বিস্ময় আরো বাড়লো, সরকারের নীতিনির্ধারকদের একজন যদি এভাবে ভাবেন, তাহলে সেই কৃষক যাবেন কোথায়? সেই মূর্খ কৃষক তো পক্ষ বোঝে না, খেলা বোঝে না, রেফারি বোঝে না, মুক্তবাজার অর্থনীতি বোঝে না। তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শস্য ফলায় বলেই আমরা খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। কিন্তু তারা প্রতিবছর ক্ষতির মুখে পড়ে- কোনো বছর ফসল কম ফলে বলে, কোনো বছর বেশি ফলে বলে। প্রতিবছর তারা প্রান্ত থেকে আরো প্রান্তে চলে যায়।

তবে আশার কথা হলো বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) সংসদে উপস্থাপিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষিকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত উল্লেখ করে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষিখাতে বরাদ্দ ও ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে। কৃষকদের কৃষি উপকরণ ও ভর্তুকি সহায়তা অব্যাহত রাখাসহ বাজেটে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সার, বীজ, কীটনাশক ও কৃষি যন্ত্রাংশ আমদানিতে শূন্য শুল্কহার অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। সারের দাম অপরিবর্তিত রাখার কথা বলা হয়েছে। কৃষকদের ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে চাল আমদানির ওপর বিদ্যমান সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক ও সম্প্রতি আরোপিত ২৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতে মোট বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ২৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ।

বর্তমান সরকার কৃষিবান্ধব সরকার। তাদের অব্যাহত নীতি সহায়তার কারণেই কৃষিতে অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু সেই অগ্রগতির লাভটা কৃষকের পকেটে পৌঁছে দিতে হবে। সময়ের কাজটা সময়ে করতে হবে। কথায় বলে না, সময়ের এক ফোঁড়, অময়ের ১০ ফোঁড়। যতই মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দেওয়া হোক না কেন, কৃষকদের বাঁচাতে সরকারকেই তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। রেফারির নিরপেক্ষতা নিয়ে নিস্পৃহ থাকার সুযোগ নেই। ন্যায্যতা নিয়ে দুর্বল কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমদানি শুল্ক বাড়ানো, সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে মৌসুমের শুরুতেই। নইলে সরকারের সিদ্ধান্তের সুফল পৌঁছানোর আগেই কৃষক নিঃস্ব হয়ে যাবে। ছেলেবেলায় একটা অনুবাদ করতাম- ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মারা গেল। ভবিষ্যতে হয়তো নতুন অনুবাদ করতে হবে- ধানের মূল্য বৃদ্ধি পাইবার আগেই কৃষক নিঃস্ব হইয়া গেল।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর