মানিব্যাগ থেকে বাজেট: ইতিহাসের পরিক্রমা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 07:13:24

'মানিব্যাগ' বা 'টাকার থলে' নামক শব্দটি থেকে যে বাজেটের উৎপত্তি, আধুনিক রাষ্ট্র সে বাজেট ছাড়া অচল। সরকারের আয় এবং ব্যয়ের খাতগুলো নির্ধারিত হয় বাজেটের মাধ্যমে। সম্পদের আহরণ ও বণ্টনের দিক-নির্দেশনাও দেওয়া হয় বাজেটের মাধ্যমেই।

পৃথিবীর ইতিহাসে ঠিক তিনশত বছর ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থার অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ হিসেবে বাজেট প্রণয়ন ও পেশ করার ধারা চলছে। আগামী বছরই বাজেট পেশের ইতিহাস ৩০০ বছর পেরিয়ে ৩০১ বছরে পা রাখবে।

বাজেট যে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। বাজেটের পরিমাণ দেখে একটি রাষ্ট্রের আর্থিক সামর্থ্য এবং রাজনৈতিক চরিত্র অনুধাবন করা যায়। রাষ্ট্রটির অর্থনৈতিক শক্তি এবং সে অর্থনীতিকে ব্যবহারের রাজনৈতিক অভিলাষের প্রতিফলন ঘটে বাৎসরিক বাজেটে।

ফলে একটি শোষণমূলক রাষ্ট্র আর একটি জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের বাজেট এক ধরনের হয় না। পাকিস্তান আমলে বাজেটের সিংহভাগ চলে যেতো পশ্চিমাংশে। শোষকরাষ্ট্র যেসব খাতে রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয় করে, কল্যাণকামী রাষ্ট্র তা করে না। তাই বাজেটে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক চরিত্র ও নীতির অর্থনৈতিক বহিঃপ্রকাশও ঘটে থাকে।

ইতিহাসের আলোকে দেখা যায়, বাজেট শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিল 'বোগেটি' শব্দ থেকে, যার আরেক অর্থ 'মানিব্যাগ', যেখানে টাকা রাখা যায়। ব্যক্তির ক্ষেত্রে যা মানিব্যাগ, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তা হলো বাজেট।

প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে কবে, কখন এবং পৃথিবীর কোথায় সর্বপ্রথম বাজেট দেওয়া শুরু হয়েছিল? উত্তরটি খুব কঠিন নয় এ কারণে যে, বাজেট একটি আধুনিক কার্যক্রম। আদিম বা মধ্যযুগে বাজেটের বালাই ছিল না। রাষ্ট্র তখন এতো নিয়মকানুন মেনেও চলতো না।

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভবের পর পর বাজেটের প্রচলন ঘটে, যাতে রাষ্ট্রের আর্থিক আয় ও ব্যয়ের স্পষ্ট চিত্র দেখা যায়। নাগরিকগণ জানতে পারেন যে তার রাষ্ট্রটি কোন কোন খাত থেকে আয় করছে এবং তা কোথায় কোথায় ব্যয় করছে। অর্থাৎ জনগণ এটা অবগত হয় যে, রাষ্ট্র জনতার কাছ থেকে কীভাবে অর্থ আহরণ করছে এবং কীভাবে তা ব্যয় করছে।

প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রে বা সোজা কথায় সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পর্ক যখন নিবিড়ভাবে গড়ে ওঠে, তখন রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকার দায়িত্ব হিসেবে বাজেট প্রণয়ন করে এবং তা জনগণের সামনে উপস্থাপন করে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক সরকার, এমনকি অগণতান্ত্রিক সরকারকেও বর্তমানে বাজেট প্রণয়ন ও পেশ করতেই হচ্ছে। রাষ্ট্রটির চরিত্র যাই হোক, বাজেট দিয়ে তাকে আর্থিক পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা জানাতেই হচ্ছে।

তবে বাজেটের উৎপত্তি ও বিকাশের সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অগ্রগতির ইতিহাসও জড়িত। গণতন্ত্রে সরকারি অর্থ আয় ও ব্যয়ের যে পরিসীমা রয়েছে, বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটে। তদুপরি অর্থনীতি, পাবলিক ফিন্যান্স ও পলিটিকাল ইকোনমি নামক বিদ্যা শাখার অগ্রগতির হাত ধরে বাজেট আরও বিকশিত হয়েছে।

ইতিহাসের পাতায় তাকালে দেখা যাবে বাজেটের উৎপত্তি হয়েছে ঠিক ৩’শ বছর আগে। ১৭২০ সালে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে প্রথম জাতীয় বাজেট ও রাজস্ব নীতি উত্থাপন করেন (স্যার) রবার্ট ওয়ালপোল। ইতিহাসের পাতায় এটি হলো প্রথম বাজেট প্রণয়ন ও পেশের ঘটনা।

পৃথিবীর প্রথম বাজেট প্রণয়নের কৃতিত্বের জন্য (স্যার) রবার্ট ওয়ালপোল ইতিহাসে আজও অম্লান। তিনি ১৭১১ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ জয়েন্ট স্টক কোম্পানি সাউথ সি বাবলির তহবিলের উপাচার্য ছিলেন। সরকারি এই কোম্পানিটির শেয়ারে ধস নামলে জনগণের মনোবল ও বিশ্বাস ফিরে পেতে তিনি প্রথম বাজেট তৈরি করেন। এটাই হলো বাজেটের উদ্ভবের পেছনের ঐতিহাসিক কারণ।

(স্যার) রবার্ট ওয়ালপোলের মতো আরেক জন মানুষ ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তিনি হলেন লর্ড ক্যানিং (১৮১২-১৮৬২)। ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসিত ভারতের শেষ শাসক এবং ব্রিটিশরাজ শাসিত ভারতের প্রথম শাসক। কোম্পানি আমলে তার পদবি ছিল গভর্নর জেনারেল আর ব্রিটিশরাজের আমলে ভাইসরয়।

১৮৬১ সালে মূল ভূখণ্ডের রেওয়াজ অনুযায়ী শেষ গভর্নর জেনারেল ও প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম বাজেট পেশ করেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসন ক্ষমতা খোদ ব্রিটিশ সরকারের হাতে বর্তায়। তখন থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বদলে উপনিবেশ ভারতের শাসন শুরু হয় বিলেতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার আলোকে।

লর্ড ক্যানিং প্রথম বারের মতো ভারতে যে বাজেট পেশ করেন, তা শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, পুরো এশিয়ার মধ্যে প্রথম বাজেট। এমনকি, ব্রিটেনের বাইরে সম্ভবত সবচেয়ে পুরনো বাজেট।

কারণ, উনিশ শতকের বিশ্বপরিক্রমায় দেখা যায়, অধিকাংশ দেশই তখন রাজতন্ত্রী বা কলোনি ছিল। ফলে সেখানে নিয়মতান্ত্রিকতা মেনে এবং সরকারি অর্থসম্পদ খাত অনুযায়ী খরচের বিধান মেনে রাষ্ট্র পরিচালিত হতো না। সরকারের আয় ও ব্যয় অর্থবিজ্ঞানের নীতি অনুযায়ী পরিচলিত করার বিদ্যাও তখন বহু দেশের করায়ত্ত ছিল না।

লর্ড ক্যানিং আরও কিছু কাজের জন্য ঐতিহাসিকভাবে স্মরণীয়। তার শাসনামলে ভারতের প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রাম নামে খ্যাত ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল এবং তিনি তা দমন করে ভারতকে ব্রিটেনের অধীনস্থ রাখতে সক্ষম হন। বিদ্রোহের পরের বছর (১৮৫৮) ব্রিটেনের পার্লামেন্টে আইন পাস হয়ে ভারতের শাসনভার কোম্পানির কাছ থেকে রানির শাসনাধীনে আসে।

চরম রাজনৈতিক সঙ্কুল ও পালাবদলের সময়ে লর্ড ক্যানিং কোম্পানি শাসিত ভারতকে ব্রিটিশ শাসনের আইন ও শৃঙ্খলার মধ্যে আনেন। বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট অরাজকতা, হানাহানি, লুটপাট থামাতেও তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। তিনি ইঙ্গ-ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। আয়কর প্রবর্তন, শতকরা দশভাগ হারে সমশুল্ক আরোপ ও বিনিমেয় কাগজের মুদ্রার প্রচলন দ্বারা আর্থিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করেন।

উপনিবেশ ভারতকে অর্থনৈতিক দিকের পাশাপাশি আইন ও গণতান্ত্রিক বিধির আওতায় আনার ক্ষেত্রে লর্ড ক্যানিং গুরুত্বপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক ভূমিকা পালন করেন। ১৭৯৩ সালে কুখ্যাত লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-এর মাধ্যমে অত্যাচারী জমিদার সৃষ্টি করে বাংলার চাষীদের যে দুর্দশা তৈরি হয়, তার প্রকোপ কিছুটা দূর করে প্রজাদের অধিক নিরাপত্তা প্রদানের উদ্দেশ্যে ১৮৫৯ সালে বাংলায় খাজনা আইন পাস করেন তিনি। নীলের একচেটিয়া চাষাবাদ কমিয়ে চা ও কফি চাষ শুরু করে তিনি কৃষিক্ষেত্রকে বিকশিত ও নীলকরদের মনোপলি ও নিপীড়নের কবল থেকে কৃষকদের কিছুটা স্বস্তি দেন।

চার্লস উড শিক্ষা বিষয়ে ১৮৫৪ সালে যে সুপরিশমালা পেশ করেন, তা কার্যকর করেন লর্ড ক্যানিং এবং ১৮৫৭ সালে কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিা করেন। ফলে উপমহাদেশে উচ্চশিক্ষার পথিকৃৎ বলা হয় তাকে।

ইউরোপীয় নীলকরদের বিরুদ্ধে বাংলা ও বিহারের চাষীদের যে অভিযোগের কারণ ছিল তা তদন্ত করতে লর্ড ক্যানিং একটি কমিশন গঠন করেন। কমিশনের সুপারিশমালার ভিত্তিতে তিনি যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তা নীলকরদের স্বেচ্ছাচারিতাকে বহুলাংশে লাঘব করে। লর্ড মেটকাফ কর্তৃক প্রণীত ভারতীয় দন্ডবিধি প্রবর্তন ও কার্যকর করেন তিনি এবং ১৮৬১ সালে ফৌজদারি কার্য-পরিচালনা বিধি (criminal procedure code) প্রকাশ ও চালু করেন। পরবর্তী বছরে পুরাতন সুপ্রিম কোর্টসমূহ ও কোম্পানির ‘আদালত’-এর পরিবর্তে তিনটি প্রেসিডেন্সি শহরে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা করে উপমহাদেশের বিচার ব্যবস্থায় সুদূরপ্রসারী অবদান রাখেন তিনি।

লর্ড ক্যানিংয়ের প্রশাসনের শেষদিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ১৮৬১ সালে ভারতীয় কাউন্সিল আইন পাস, যার দ্বারা বেসরকারি ভারতীয় সদস্যগণ ভাইসরয়ের আইনসভায় মনোনীত হতে পারতেন। ভারতীয় নাগরিকদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রথম সুযোগটি এভাবেই উন্মোচিত করেন তিনি।

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময়কার গুরুভার ও কঠিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্লান্ত ক্যানিং অবসর গ্রহণ করে ১৮৬২ সালের ১৮ মার্চ ভগ্নস্বাস্থ্যে ভারত ত্যাগ করেন। অবসর গ্রহণ করার পূর্বে ভারতে তার কর্তব্যপালনের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৮৫৯ সালে তাকে ‘আর্ল’ (Earl) মর্যাদায় উন্নীত করা হয়। ইংল্যান্ডে অল্প কয়েকমাস পর ১৮৬২ সালের ১৭ জুন তিনি পরলোকগমন করেন এবং ওয়েস্ট মিনিস্টারস অ্যাবিতে তাকে সমাহিত করা হয়।

বাজেটের হাত ধরে ক্রমে ক্রমে শাসনতান্ত্রিক, বিচারিক ও উচ্চশিক্ষা বিষয়ক অবদানের মাধ্যমে লর্ড ক্যানিং উমহাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিটি গড়ে তুলেছিলেন। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোকেও তিনি বিভাজিত ও বিকশিত করেন। পরবর্তীতে উপনিবেশিক রাষ্ট্র যত গণমুখী হয়েছে, বাজেটেও ততই গণমানুষের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় গণতান্ত্রিক অগ্রগতি আর বাজেটের গণমুখী ধারাকে হাত ধরাধরি করে সমান্তরালে চলতে দেখা গেছে।

উপমহাদেশের মানুষ লর্ড ক্যানিংকে মনে রেখেছে। কলকাতার দক্ষিণে ক্যানিং নামে একটি বিরাট এলাকার নামকরণ করা হয়েছে। মহানগরী কলকাতার বুকে সেন্ট্রাল বা মধ্যাঞ্চলে রয়েছে ক্যানিং স্ট্রিট। বড়বাজারের চীৎপুর রোড আর মহাত্মা গান্ধি রোডের পয়েন্ট থেকে ঐতিহাসিক রয়েল ইন্ডিয়া হোটেলের সামনে দিকে এগিয়ে গেলে জমজমাট ক্যানিং স্ট্রিটের দেখা পাওয়া যায়।

কিংবা খেলাফত আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত মোহাম্মদ আলী পার্কের সামনে দিয়ে জাকারিয়া স্ট্রিট ধরে ঐতিহাসিক নাখোদা মসজিদ হয়ে যাওয়া যায় ক্যানিং স্ট্রিটে। ঢাকায় যেমন পাটুয়াটুলী কলকাতায় তেমনি ক্যানিং স্ট্রিট হলো চশমার বিরাট পাইকারি বাজার। আধ ঘণ্টার মধ্যে কাঁচে যে কোনও পাওয়ার দিয়ে চশমার সরবরাহ পেতে ক্যানিং স্ট্রিট একমাত্র ভরসা।

একদা ক্যানিং স্ট্রিটে আস্ত একটি বিকাল কাটিয়ে চশমা ঠিক করতে করতে দেখছিলান বড়বাজার, চীৎপুর, স্ট্যান্ড রোড, বর্ধণ স্ট্রিট, জাকারিয়া স্ট্রিট, কলুটোলা, হাওড়া ব্রিজ থেকে ধেয়ে আসা ভিড় ও জনারণ্য। আর ভাবছিলাম ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল ও প্রথম ভাইসরয়ের কর্ম ও কীর্তিময় রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, বিচারিক, উচ্চশিক্ষামূলক অবদানের কথা, যার মধ্যে ছিল উপমহাদেশে প্রথম বাজেট প্রণয়ন ও পেশের কৃতিত্বও।

এ সম্পর্কিত আরও খবর