বাজেটে কি দরিদ্র মানুষের আশার প্রতিফলন ঘটেছে?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মাছুম বিল্লাহ | 2023-08-21 04:15:42

মোট পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বৃদ্ধি, তরুণদের জন্য ১০০ কোটি টাকার তহবিল, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি, সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুসহ নানা প্রস্তাব করা হয়েছে। অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ এবার বিস্তৃত হয়েছে। তবে ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতার করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধির দাবি থাকলেও তা বাড়ানো হয়নি। কারণ দেশে নাকি চার কোটি মানুষ মধ্যম আয়ের অর্থাৎ তারা রাষ্ট্রকে কর দিতে পারে। অথচ কর দেয় মাত্র ২০-২২ লাখ মানুষ। এর অর্থ- কর আহরণে মারাত্মক অব্যবস্থাপনা ও জটিলতা। তার পরে যারা কর দিতে পারেন তারাও দিতে চান না। কারণ তারা দেখছে, রাষ্ট্রের এই করের অর্থ প্রচুর পরিমাণে অপচয় হয়। রাঘববোয়ালরা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন খাত থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে আর ফেরত দেন না।

রাষ্ট্রের অর্থের মালিক জনগণ। সবকিছুর মালিক তারা। অথচ তাদের টাকা দিয়ে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়বে মুষ্টিমেয় কয়েকজন, রাষ্ট্র আবার তাদেরকে ছাড় দেবে। ২০-২২ লাখ লোকের কর দেওয়ার আর একটি অর্থ হচ্ছে - ইচ্ছায় কেউ কর দেয় না। আর কর দেওয়ার যারা আসলেই উপযুক্ত, তারা কর তো দেনই না বরং রাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও অন্যান্য সুবিধা নিয়ে থাকেন।

অতএব, মধ্যম, নিরীহ ও বলির পাঠা জনগণই রাষ্ট্রের সব ধরনের অনিয়মকে টিকিয়ে রাখার জন্য, রাষ্ট্রের অপচয় চালিয়ে নেওয়ার জন্য কর দিতে থাকবে। আর এভাবেই অর্থমন্ত্রী রাজস্ব বাবদ মোট তিন লাখ ৭৭ হজার ৮১০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই মন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। অথচ বাজেটে তার প্রতিফলন কোথায়?

দেশীয় শিল্পে বিশেষত হালকা মাঝারি শিল্পে কিছুটা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কৃষি, তৈরি পোশাকসহ কিছু খাত পাচ্ছে প্রণোদনা। তবে দেশকে ভারী শিল্পসমৃদ্ধ করার মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়াতে তেমন কোন ঘোষণা আসেনি। যদিও অর্থমন্ত্রী বলেছেন ২০৩০ সালের মধ্যে তিন কোটি বেকারের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হবে। সেটি কিভাবে? সঠিক নির্দেশনা থাকার পরও, সঠিক পরিকল্পনা থাকার পরও কোনো কাজের অর্ধেকও অর্জন হয় না আমাদের দেশে। সেখানে আমরা কী করে বলতে পারি যে, ২০৩০ সালের মধ্যে তিন কোটি বেকারের কর্মসংস্থান হবে? বেকারের সংখ্যা বিশেষত শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সঠিকভাবে পরিমাপ করার ব্যবস্থা নেই। বেকারের বর্তমান হারের কথা চিন্তা করে হয়তো অর্থমন্ত্রী এটি বলেছেন, কিন্তু বেকারদের হার তখন কী হবে সেই নির্দেশনা কিন্তু নেই।

বৈদেশিক উৎস থেকে বড় অংকের ঋণ নেওয়ার কথা বলেছেন। একইভাবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও ঋণ নেয়ার কথা বলেছেন তিনি। গ্রামকে শহর করার স্বপ্নও দেখিয়েছেন তবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়। এখানে একটি প্রশ্ন হচ্ছে –গ্রামকে শহর করতে হবে কেন? গ্রাম থাকবে গ্রামীণ বৈশিষ্ট নিয়ে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য, শহর ও গ্রামের নাগরিক সুবিধা, শিক্ষা-দীক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুবিধা, চিকিৎসা সুবিধা ইত্যাদির মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনার সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নির্দেশনা থাকতে হবে।

বাজেটে সয়াবিন তেল, পামওয়েল, প্লাস্টিক সামগ্রীসহ বেশকিছু নতুন পণ্যে নতুন করে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। আমরা সাধারণ মানুষও বুঝি, কিন্তু অর্থনীতিবিদ এবং অর্থমন্ত্রী নিশ্চয়ই বুঝেন যে, এগুলো বড় লোক বা ধনী লোকদের প্রভাবিত করবে না। এগুলো নাভিশ্বাস বের করে ফেলবে সাধারণ জনগণের। বাজেটের গন্ধ পেলেই ফুটপাতের দোকানি থেকে শুরু করে এসির দোকানি পর্যন্ত জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়িয়ে দেয়। যে ঘটনা প্রতিবছর ঘটছে আমাদের অর্থনীতিতে, আমাদের বাজেট সংক্রান্ত আলোচনা ও সমালোচনায় সেগুলো কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো মেকানিজম কি আমাদের আছে? নেই। আর তাই সাধারণ জনগণ হচ্ছে বলির পাঠা।

বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বাজেট শিল্পে বিনিয়োগের জন্য মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আবাসন খাতে আগে থেকেই কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ ছিল। এ সুযোগ অবশ্যই রেখে কর হার আরও কমানোর প্রস্তাব দিয়েছেন মন্ত্রী। শিল্প খাতে ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করার অবকাশ সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে পাঁচ বছর। ধনীরা সম্পদের উপর যে সারচার্জ দেন সেখানেও ছাড় এসেছে। সারচার্জ আরোপে সম্পদের নিম্নসীমা বাড়ানো হয়েছে। এগুলো সবই বড়লোক বান্ধব ও দুর্নীতিবাজদের উৎসাহিত করার কৌশল। হাঁ, এটি জানি, অর্থমন্ত্রী ইচ্ছে করলেই দিনে দিনে প্রথিত দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলতে পারবেন না, ইচ্ছে করলেই গরীব জনগণের পক্ষে বাজেট প্রণয়ন করতে পারবেন না। কিন্তু তারপরও সাধারণ মানুষের আশা বাজেটে তাদের প্রত্যাশার কথা থাকবে। 

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর