ধর্ষণের বিভীষিকাময় সমাজে আমি লজ্জিত

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মুফতি এনায়েতুল্লাহ | 2023-08-28 01:21:33

বড্ড কঠিন এক দানবীয় সমাজে বসবাস করছি আমরা। সমাজ দিন দিন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। অধঃপতিত এই সমাজের এক শ্রেণির মানুষ অমানুষে পরিণত হয়েছে। মানবিক মূল্যবোধের এক চরম অবক্ষয়ের স্রোতে হাবুডুবু খাচ্ছি আমরা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোথাও এতটুকু জায়গা নেই, যেখানে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যায়।

সম্প্রতি দু’জন মাদরাসার শিক্ষককে একাধিক শিক্ষার্থী ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক অবস্থায় তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অভিযোগে কাউকে না কাউকে আটকের খবর গণ্যমাধ্যম থেকে পাচ্ছি। কিন্তু এভাবে আলেম, মাদরাসার অধ্যক্ষ ও মসজিদের ইমাম আটকের খবর খুব একটা পাওয়া যেত না, যেটা এবার পাওয়া গেল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগও বেশ গুরুতর। তারা একাধিক ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি করেছেন। জাত গেল, কূল গেল বলে তাদের অপরাধকে ঢেকে রাখার কিংবা এটা নিয়ে আলোচনা না করার পক্ষপাতী আমি না।

নিদারুণ লজ্জা, এক বুক কষ্ট আর মনের উদ্বেগ নিয়ে লেখাটা লিখছি। কারণ আমিও মেয়ের বাবা। আমার মেয়েরা পড়তে পাঠশালায় যায়, তারা কি সেখানে নিরাপদ? শিক্ষাঙ্গনে ধর্ষণের মতো বর্বরতার ঘটনা শোনা গেলেও আবাসিক মহিলা মাদরাসাগুলোকে অনেকটা নিরাপদ ভাবা হতো। কিন্তু পরপর দুই ঘটনায় যা প্রকাশ পেয়েছে, তা রীতিমতো বীভৎস।

আসলে ঘরে-বাইরে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নারীরা যে কোথাও নিরাপদ নন, সেটাই প্রমাণিত হলো। তিন বছরের শিশু থেকে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, গৃহবধূ, বৃদ্ধা কেউ ধর্ষণের মহামারি থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এ কোন সমাজে আমরা বসবাস করছি? যা দেখছি, যা শুনছি এসবের কি কোনো প্রতিকার নেই? এসব বন্ধের কোনো ব্যবস্থা নেই? নারীর এই নিরাপত্তাহীনতার অবসান জরুরি।

নেত্রকোনার কেন্দুয়াতে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে মাদরাসা শিক্ষক আবুল খায়ের বেলালীকে আটক করেছে পুলিশ, ছবি: সংগৃহীত

 

দেশের আলেম-উলামা, মাদরাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও খানকার পীরদের প্রতি সাধারণ মানুষের অপরিসীম শ্রদ্ধা রয়েছে। আমিও তাদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখি। তারপরও কিছু লেবাসধারীদের শিশু নির্যাতন, স্ত্রী নির্যাতন ও যৌন হয়রানিসহ নানা অপরাধের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হন গোটা আলেম সমাজ। বলতেও লজ্জা লাগে, ভাবলেও ঘৃণা হয়। মাদরাসায় শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের বিষয়টি মোটেও নতুন নয়। যখন শুধু ছেলে মাদরাসা ছিল তখন অনেক ছেলে নির্যাতনের শিকার হতো আর এখন মেয়েরা দানবরূপী শিক্ষকের যৌন লালসার শিকার হচ্ছে। বিষয়টি খুবই লজ্জার ও ঘৃণার।

মাদরাসায় পড়াশোনার সুবাদে অসংখ্য ঘটনার কথা শুনেছি, যেগুলো গোপন করা হয়েছে নয়তো কোনো না কোনোভাবে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। তাতে কিন্তু অপরাধ কমেনি, প্রলয় বন্ধ হয়নি। সাময়িকভাবে হয়তো আত্মতৃপ্তির জাবরকাটা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু ফলাফল—শূন্য।

বরাবরই দেখেছি এ জাতীয় কোনো ঘটনাকে গুরুত্ব দেন না আলেম সমাজ। তারা ধরেই নেন, এসব খবর মিডিয়ার সৃষ্টি, ইসলামি লেবাসধারীদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের প্রয়াস। এভাবে অনেক ঘটনা হজম করে অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে ভেতরের পচন থামেনি। প্রশ্ন উঠতে পারে, আলেমরা অপরাধ করলে এটা নিয়ে কেন হইচই বেশি হয়? বলি, আলেমদের শিক্ষার ভিত্তি খোদাভীতি ও নৈতিকতার ওপর। নৈতিকতাকে ভিত্তি ধরে গড়ে ওঠাদের মাঝে অনৈতিকতার চর্চা মানা কষ্টকর। তাছাড়া আলেম-উলামারাও মানুষ, তারা ফেরেশতা নন। সুতরাং তাদের দ্বারা অন্যায় হতে পারে না, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সুতরাং আলেমদের থেকে কোনো অপরাধ প্রকাশ পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এমতাবস্থায় অপরাধীকে আড়াল না করে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো দরকার।

সংক্রামক জীবাণুর মতো ধর্ষণ ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মানুষ গড়ার কারিগর যাদেরকে বলা হয়, যাদেরকে মানুষের আস্থার প্রতীক মনে করা হয়; তারাই যদি যৌনতার লালসায় শিশুদের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাহলে শিশুরা যাবে কোথায়? অন্য কোনো জায়গার কথা না হয় বাদই দিলাম, যখন দেখি মাদরাসার এক শ্রেণির মাওলানা শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌনতার অভিযোগ ওঠে; তখন সত্যিই মর্মাহত হই। লজ্জায়-অপমানে জীবনটা বিষময় মনে হয়।

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে র‌্যাবের হাতে আটক আল আমিন, ছবি: সংগৃহীত

 

শরীরের এক জায়গা বারবার কেটে গেলে চামড়া মোটা হয়ে যায় তখন অনুভূতি আর কাজ করে না। আমাদের অবস্থা অনেকটা তেমন। গুম, খুন, অপহরণ আর ধর্ষণের বীভৎসতার ছবি দেখতে দেখতে গা সয়ে যাওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

তাই বলি, সমাজের বড় একটি অংশের মধ্যে যদি মনুষত্বের চেয়ে পশুত্বের পরিমাণ বেশি দেখা যায়, তাহলে ওই সমাজের নাগরিকদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা এমনিতেই বেড়ে যায়। যে সমাজের মেয়েরা লম্পট চরিত্রহীন পুরুষদের লালসার শিকার হয়, সে সমাজকে নষ্ট সমাজ ব্যতীত আর কী বলা যেতে পারে? সামাজিক নানা কাঠামো ধ্বংস হয়ে গেলে পুনরায় তা নির্মাণ করা সম্ভব। কিন্তু নারীর ইজ্জত একবার লুণ্ঠিত হলে তা হাজার চেষ্টা করেও ফিরিয়ে আনা যায় না। যে সমাজে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নেই, মানুষের মর্যাদা নেই, ন্যায়বিচার নেই, মিথ্যার ওপরে সত্যের স্থান নেই, সে সমাজ ব্যবস্থাকে নষ্ট সমাজ ব্যতীত সভ্য সমাজ বলা যায় না; বলা সম্ভব না।

যারা ধর্ষণ করে, নারীত্বের অপমান করে; তাদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। যেহেতু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ জাতীয় কেলেঙ্কারির ঘটনা দিন দিন বাড়ছে, এটা থেকে পরিত্রাণের জন্য নেতৃস্থানীয় আলেমদের ভাবতে হবে। নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। এখনই এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়ে যাবে, ভরসার জায়গাটুকুও শেষ হয়ে যাবে।

শেষ কথা হলো, মসজিদের ইমাম, মাদরাসার শিক্ষক হয়ে যদি ঈমান-আমল ও আখলাক-চরিত্র ঠিক রাখতে না পারেন তাহলে ছেড়ে দিন ওই জায়গা। তবুও অন্যদের জন্য গ্লানির কারণ হবেন না। আপনার জন্য, আলেম সমাজকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবেন না। আল্লাহর ওয়াস্তে এ অপমান হওয়া থেকে পুরো সমাজকে বাঁচান।

লেখক: মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর