নতুন চ্যাম্পিয়নের অন্য রকম ক্রিকেট বিশ্বকাপ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

শুভ কিবরিয়া | 2023-08-24 02:03:37

কে যাবে বিশ্বকাপের ফাইনালে, এই মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন নিয়ে আপাতত আর তাড়া নেই। কেননা উত্তরটা মিলেছে। তবে, এই উত্তরটা কি প্রত্যাশিত ছিল? হয়তো ছিল, হয়তো ছিল না। বিশ্বকাপ শুরুর আগে যে হাইপ ছিল হট ফেবারিট অস্ট্রেলিয়া, ভারত কিংবা অন্যদের নিয়ে আপাতত তাতে পানি পড়েছে। এবারের বিশ্বকাপ শুরুর সময় বড় প্রশ্নটা ছিল পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ান অষ্ট্রেলিয়া কি আবার চ্যাম্পিয়ান হয়ে নতুন রেকর্ড গড়বে? নাকি, তিনবারের মত শিরোপা হাতে নিয়ে ভারত প্রমাণ করে দেবে ক্রিকেট দুনিয়া এখন তাদের হাতে! সেসব হিসেব এখন গরমিলের খাতায়। বলা ভালো, কোন হিসেবই ঠিকমত মেলেনি শেষাবধি। 

এবারের বিশ্বকাপ তাই উত্তেজনায়, উম্মাদনায়, ফলাফলের হিসেবে, পিচের আচরণে, প্রযুক্তির ব্যবহারে, বৃষ্টির মগ্নতায় এক অন্যরকম বিশ্বকাপ। বলা ভালো, এটা একটা আনপ্রেডিক্টেবল ফলাফলেরই বিশ্বকাপ। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এইরকম বিশ্বকাপ কি আমরা চেয়েছিলাম!

অবশ্য আমাদের চাওয়া না চাওয়া দিয়ে কিইবা আসে যায়! ১০ দলের বিশ্বকাপ যখন শুরু হয় তখন এটা তো ধরেই নেয়া হয়েছিল অনেকের চাওয়া না চাওয়ায় পানি ঢেলেই শেষে মাত্র দু’টো দলই ফাইনালে যাবে। তারপর একজনের গলায় ঝুরবে শিরোপা!

০২.
এবারের বিশ্বকাপ কতগুলো অনন্য নজির তৈরি করল।

এক. বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে এই প্রথম হারল অস্ট্রেলিয়া। আর এ হার যে সে হার নয়। হেসে খেলে ক্রিকেট জগতের অন্যতম শক্তিধর দল অষ্ট্রেলিয়াকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল স্বাগতিক ইংল্যান্ড দল।

দুই. ক্রিকেট মোড়লদের মাতব্বরির দিনকে এবার ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে এই আসর। ২৩ বছর পর প্রথমবারের মত নতুন চ্যাম্পিয়ান পাচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ।

তিন. আর ২৭ বছর পর ফাইনালে পা রাখল আলোড়ন তোলা স্বাগতিক ইংল্যান্ড দল।

চার. এবারের বিশ্বকাপে কোন দলই অপরাজিত থাকতে পারে নাই।সব দলকেই কোন না কোন দলের সাথে খেলায় পরাজয়ের স্বাদ বরণ করতে হয়েছে। যে দল চ্যাম্পিয়ান হচ্ছে তারও অপরাজিত থাকার রেকর্ড নেই এ বিশ্বকাপে।

পাঁচ. প্রথম পর্বের খেলাগুলোতে মনে হয়েছিল এবারের বিশ্বকাপ হবে ব্যাটসম্যান দ্বারা প্রভাবিত। মাঠের অবস্থা, পিচের ধরণ দিয়ে ভবিষ্যতবাণি করা হয়েছিল এবারের বিশ্বকাপে রাজত্ব করবে ব্যাটসমানরাই। প্রথমদিকের ম্যাচগুলোতে তা সত্য প্রমাণিতও হয়েছিল। প্রচুর রানের দেখা পাওয়া গেছে প্রথম পর্বের অনেকগুলো খেলাতেই। কিন্তু খেলা যত গড়িয়েছে দেখা গেলো খেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে ক্রমশ বোলাররা। বিশেষ করে পেস বোলাররাই রাজত্ব করেছে শেষে এসে। দুই সেমিফাইনালের ফলাফল নির্ধারণ করে দিয়েছে পেস বোলাররা।

ছয়. এবারের বিশ্বকাপে প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল যথেষ্ট।ফলে আম্পায়ার ভুল করলেও সেটা কারেকশনের সুযোগ ছিল রিভউয়ের মাধ্যমে।বড় ভুলের সুযোগ খুব একটা ছিল না। হিউম্যান এরর বা মানুষের ভুলের সংখ্যা ক্রমশ কম হয়েছে এবারের বিশ্বকাপে। ফলে বড় দলগুলো, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংগঠনে যাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বেশি তারা আম্পায়ারকে ধমকে ধামকে খেলার ফলাফলকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারে নাই।এটা এবারের আসরের একটা উল্লেখযোগ্য ভালো দিক।

০৩.
এবারের ক্রিকেট আসর, দ্বাদশ আসর হলেও এই আসরটির উত্তেজনা ছিল অন্যরকম। ক্রিকেট নিয়ে যাদের কারবার, তাদের মাথায় দুটো চাল সবসময় ঘুরপাক খায়-এক, বাণিজ্য দুই, বিশ্বায়ন। বাণিজ্যে বিস্তার-তাই ক্রিকেট ঘিরে রমরমা বাণিজ্য যেন সচল থাকে সেই চেষ্টাটা থাকে সবসময় ক্রিকেট কর্তাদের। এই ক্রিকেট কর্তাদের যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, যাদের আমরা ক্রিকেট বিশ্বের মোড়ল বলি, তারও চান, বাণিজ্য বাড়ুক হাওয়ার বেগে। ক্রিকেটে বাণিজ্য তাই এখন একমুখিন তেজি লক্ষ্য। তাই খেলায় বা খেলার ফলাফলে যত উত্তেজনা, যত অনিশ্চয়তা, যত শক্তিমত্তা জোগানো যায়, মানুষের কাছে ততই আকর্ষণীয় হবে বা মানুষ তত খাবে ক্রিকেট। এ কারণেই ক্রিকেটের নতুন নতুন ভার্সন টি-২০, টি-১০ বাজারে ছাড়া হয়েছে। বাণিজ্যমুখিন করে টাকা কামাতে উত্তেজনা যত বাড়ানো যায়-ততই ব্যবসা সফল হবে ক্রিকেট আসর। কাজেই আয়োজকরা সবসময় বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে এসব আয়োজন করতে চায়। এবারের বিশ্বকাপও তার বাইরে নয়। ফেবারিট, হট ফেবারিট, ডার্ক হর্স, স্বাগতিক- এসব তকমা লাগিয়ে বাণিজ্যটাকেই তেজি করে তোলার একটা চেষ্টাও থাকে। কেননা এসব তকমা ব্যবহার করে মিডিয়া নানা হাইপ তোলে, সুপরিকল্পিতভাবেই। তাতে ক্রিকেটের যতটা না লাভ হয়, বাণিজ্যের লাভ হয় বড়। সবার লক্ষ্যই থাকে আর যাই হোক বাণিজ্যে যেন সফলতা থাকেই থাকে।

ক্রিকেটের আরেকটা লক্ষ্য আছে- সেটা হচ্ছে ক্রিকেটের বিশ্বায়ন। আরও অনেক মানুষ ক্রিকেট খেলুক। সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ুক এই ক্রিকেট উত্তেজনা। পৃথিবীর আরও আরও দেশ জড়িয়ে পড়ুক ক্রিকেট নিয়ে-এই আশায় ক্রিকেট কর্তারা ছুটছেন নিয়মিত। বিশ্বকাপ আসরের লক্ষ্যও থাকে ক্রিকেট বিশ্বায়নের গতিকে বাড়ানো। ক্রিকেটের বিশ্বায়ন যত বাড়বে আদতে বাড়বে তার বাজারও। বলা বাহুল্য তাতে বাড়বে ক্রিকেটের বাণিজ্যও। ততই বহুমুখি ও বহুমাত্রিক হবে ক্রিকেটের বাণিজ্যের গতিও।

এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট-২০১৯, সেই লক্ষ্যেই ধাবিত। ফলে এবারের বিশ্বকাপের ফর্মেটে প্রথম পর্বে ১০ দলকে সবার সাথেই সবার খেলতে হয়েছে। প্রথম পর্বে আয়োজন করা হয়েছে ৪৫টি ম্যাচের। ম্যাচের সংখ্যা বাড়া মানেই বাণিজ্য বাড়া। এই ফর্মেটের উদ্দেশ্যও ছিল তাই।পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে থাকা ৪ দল গেছে সেমিফাইনালে। সেখান থেকে দুই দল উঠে এসেছে ফাইনালে।

০৪.
এবারের আসরের দুই টপ ফেবারিট ভারত ও অষ্ট্রেলিয়া কেন ফেল করল সেটা একটা অলোচ্য বিষয়। কেননা এই দুই দল ক্রিকেট সংগঠনে বিপুল প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে।তার প্রভাব দেখা গেছে ভারতের প্রথম পর্বের খেলার ফিকশ্চার নির্ধারণে। বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে প্রায় সব দল যখন তাদের খেলা খেলে ফেলেছে, অন্যদের অনেকের সবলতা-দুর্বলতা যখন দৃশ্যমান হয়েছে তখন ভারত মাঠে খেলতে নেমেছে। ৩০ মে ২০১৯ বিশ্বকাপের খেলা শুরু হলেও ভারত প্রথম ম্যাচ খেলেছে ৫জুন। ততদিনে বিশ্বকাপের সাতটা ম্যাচ হয়েছে। ইংল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েষ্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ তাদের খেলা খেলে ফেলার পর মাঠে নেমেছে ভারত। এবার ভারতীয় দলের বোলিং শক্তি ছিল তার ইতিহাসের সেরা।ব্যাটিং শক্তিও ছিল নজরকাড়া। কিন্তু সেমিফাইনালে তারা নিউজিল্যান্ডের পেস বোলিংয়ের প্রথম ধাক্কাটা সামলাতে না পেরেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে। অন্যদিকে শক্তিধর ও ব্যালান্সড দল অষ্ট্রেলিয়া একইভাবে ইংল্যান্ডের প্রথম স্পেলের পেস বোলিংয়েই কুপোকাত হয়েছে।

সেমিফাইনালে বিজয়ী দুই দলের শক্তির ধরণটা একটু আলাদা। নিউজিল্যান্ড তার ক্ষুরধার পেস বোলিং এবং অসাধারণ ফিল্ডিং শক্তির ওপর ভরসা করে এতটা পথ এসেছে। অন্যদিকে ইংল্যান্ড দল প্রথম দিকে খারাপ করলেও দ্রুত তা সামলে উঠেছে তাদের অসাধারণ ব্যাটিং শক্তির ওপর ভরসা করে। কাগজে কলমে শক্তিশালি ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপ মাঠেও তার শক্তিমত্তা দেখাতে সক্ষম হয়েছে।

০৫.
এই বিশ্বকাপ অনেক অঘটনের জন্ম দিয়েছে। হারতে হারতে জয় এসেছে এরকম অনেকগুলো খেলা দর্শকদের খুবই আনন্দ দিয়েছে। এই বিশ্বকাপ প্রথমদিকে ব্যাটসম্যান এবং অলরাউন্ডারদের পারফরমেন্সে মুখরিত হয়েছে।পরেরদিকে বোলাররা তাদের দ্যুতি ছড়িয়েছে। মাঠে ফিল্ডারদের অসাধারণ ক্রীড়াশৈলি দর্শকদের বিমোহিত করেছে। বৃষ্টি এই আসরের প্রথমদিকে নাটের গুরু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারপরও শেষাবধি অনেক নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে খেলাগুলো এগিয়েছে। এই আসরে বাংলাদেশ তার সামর্থ্যের নিরিখে যে সাফল্য পেয়েছে তা শেষাবধি কিছুটা হতাশাই তৈরি করেছে। জনপরিসরে বাংলাদেশ দল নিয়ে যে প্রত্যাশা ছিল বাস্তবে তা কতটুকু যৌক্তিক সেই প্রশ্নও উঠেছে। ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ মোটামুটি ভালো করলেও ফিল্ডিংয়ে ব্যর্থ হয়েছে। বোলিং বিশেষ করে পেস বোলিংয়ে যে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে সেটা এই আসর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে। তবে তার মধ্যেও বাংলাদেশের বড় প্রাপ্তি তার দলের অসাধারণ খেলোয়াড় সাকিব আল হাসানের অলরাউন্ড পারফরমেন্স। সাকিবের একক নৈপুণ্য এবারের বিশ্বকাপ আসরের অন্যতম ঘটনা।

সব মিলিয়ে এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসর নতুন চ্যাম্পিয়ানের হাতে শিরোপা তুলে দিয়ে এক অন্যরকম আয়োজনের নজির রাখল।

শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর