ঘুষ ছাড়া চাকরি, ভাবা যায়!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

রায়হান আহমদ আশরাফী | 2023-09-01 08:15:45

‘ঘুষ’ শব্দটার সাথে পরিচয় নেই, এমন বাংলাদেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। সদ্য স্কুলে ভর্তি হওয়া নিষ্পাপ শিশু থেকে মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ, প্রত্যেকেই এই শব্দের সঙ্গে হয়তো কোনোভাবে পরিচিত। অনেকে অবশ্য ‘ঘুষ’ উচ্চারণ করতে দ্বিধাবোধ করেন বা লজ্জা পান। তাই আদর করে ‘ঘুষ’কে উপঢৌকন বা উপহার নামেও ডাকেন। ইংরেজিতে কেউ বলেন ‘স্পিডমানি’।

নবজাতক শিশু থেকে আঠারো বছরের কমবয়সীদের জন্মনিবন্ধন করতে হয়। এজন্য সরকার নামমাত্র ফি নির্ধারণ করেছে। কিন্তু সেই সনদ পেতে হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘুষ দিতে হয়। জীবনের প্রতি ধাপে ধাপে ঘুষ বা স্পিডমানি দিতে দিতে এবার কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পালা।

নির্ধারিত সময়ে বেতন-বোনাস, ইনক্রিমেন্ট, চাকরি শেষে পেনশন এবং এককালীন টাকা, চাকরিকালীন এবং চাকরি শেষের নিশ্চয়তার কথা ভেবে বেশিরভাগ তরুণ-তরুণী সরকারি চাকরির পেছনে ছুটেন। মোটামোটি অষ্টম শ্রেণি বা এসএসসি, এইচএস পাসেই তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে আবেদন করা যায়। তবুও সুযোগ সুবিধার কথা ভেবে স্নাতক পাস অনেকেই তৃতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতেও চেষ্টা করেন।

সরকারি চাকরির ধাপগুলো অনেকটা এরকম- নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর অনলাইনে বা সরাসরি আবেদন, নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা, এমসিকিউ বা প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষা, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা এবং শেষে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা পদভেদে পুলিশ ভেরিফিকেশন পেরিয়ে চাকরিতে যোগদান।

এমসিকিউ পরীক্ষা বা লিখিত পরীক্ষায় টিকতে হলে মেধা এবং প্রস্তুতি প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীই এখন একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মগ্ন থাকেন। কঠোর প্রস্তুতি শেষে এমসিকিউ এবং লিখিত পরীক্ষার ধাপ পেরোতে পারলেও আটকে যেতে হয় ভাইভা বোর্ডে। অবশ্য প্রশ্ন ফাঁস বা অসৎ পন্থা অবলম্বন করে অনেকেই এমসিকিউ এবং লিখিত পরীক্ষাও উতরে যান। সে প্রসঙ্গ এখন থাক।

সাংবাদিকতার সূত্রে দীর্ঘদিন ধরেই চাকরিপ্রার্থীদের নানা অভিযোগ, চাকরি না পাওয়ার হতাশা সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে। এমন অনেককেই দেখেছি বারবার লিখিত পরীক্ষায় টিকেও ভাইভা বোর্ডে বাদ পড়েছেন। যোগ্যতার ঘাটতির বিষয় বাদ দিলেও এধাপে আরেকটি ফ্যাক্টর কাজ করে। মামা-চাচার পরিচয় এবং উপঢৌকন বা ঘুষ লেনদেন।

সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে ঘুষের বিনিময়ে চাকরি অনেকটা অঘোষিত সত্যে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমেও নিয়মিত খবর আসে। তাই বলে কি শতভাগ নিয়োগ দুর্নীতি হচ্ছে? তা নয়। বলা যেতে পারে, একটি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কিছু পদে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে চাকরি হচ্ছে। সব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দুর্নীতি হচ্ছে এ তথ্য যেমন সত্য নয়, সারাদেশে শতভাগ স্বচ্ছ নিয়োগ হচ্ছে সেটিও সত্য নয়। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দালালের যোগসাজশে এবং চাকরির আশায় অবৈধ লেনদেন করা কতিপয় চাকরিপ্রার্থীর জন্যই অবৈধ নিয়োগ হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সৎভাবে চাকরি খুঁজে বেড়ানো হাজারো তরুণ।

সম্প্রতি পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ নিয়ে বেশ হৈ চৈ পড়ে গিয়েছে। সারাদেশে ১০ হাজার কনস্টেবল নিচ্ছে পুলিশ। সবমিলিয়ে কনস্টেবল পদে নিয়োগ পেতে খরচ হয় ১০৩ টাকা। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় টিকলে এই সামান্য টাকা খরচ করেই পুলিশের চাকরি পাওয়া যায়। কিন্তু এবছর এতো আলোচনার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে।

পুলিশে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে সাধারণের মাঝে একধরনের কথা প্রচলিত আছে। টাকা ছাড়া পুলিশে চাকরি পাওয়া যায় না বা সুপারিশ ছাড়া নিয়োগ হয় না, এ ধারণা জনসাধারণের মাঝে ঢুকে গেছে। পুলিশ প্রশাসন এই প্রচলিত ধারণা ভাঙতে বেশ জোরেসোরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া কঠোর মনিটরিং, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এবং যোগ্যদের নিয়োগ দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি নিয়োগের আগে মাইকিং, প্রচারণা, ঘুষ লেনদেন না করতে সতর্কতা, কমপ্লেইন সেল গঠনের মতো নানা উদ্যোগ নিয়েছে।

এবারের কনস্টেবল নিয়োগের পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সারাদেশে ১০৩ টাকায় পুলিশে চাকরি পাওয়া, অসহায় পরিবারের সন্তানদের নিয়োগ পাওয়ার খবর এসেছে। মানুষের মাঝেও পুলিশে চাকরি পাওয়া নিয়ে পজিটিভ ধারণা তৈরি হচ্ছে। পুলিশ প্রশাসনের এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসা পাওয়ার মতো।

পুলিশে নিয়োগ নিয়ে মানুষের মাঝে যেমন পজিটিভ মনোভাব তৈরি হয়েছে, সরকারি সব চাকরিতে নিয়োগ নিয়েই এমন মনোভাব তৈরি হওয়া দরকার। চাকরি পেতে ঘুষ লাগবে কেন! শুধু যোগ্যতা থাকলেই চাকরি পাওয়ার কথা।

চাকরি পেতে ঘুষ লাগবে এ ধারণা যেহেতু তৈরি হয়েই গেছে, সেই ধারণা ভাঙতে হবে। স্বচ্ছ নিয়োগের মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরাই সে ধারণা ভাঙতে পারেন। এজন্য বেশি কিছু প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু সৎ মানসিকতা এবং সদ্বিচ্ছা।

রায়হান আহমদ আশরাফী: এডিটর, ক্যারিয়ার পেইজ, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর