এরশাদ: জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ পেরিয়ে

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-30 14:52:29

বেশ কিছুদিন হাসপাতালের শয্যায় চিকিৎসাধীন থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মারা গেলেন। জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ পেরিয়ে তিনি এখন জাগতিক সকল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অবস্থান করছেন।

কিন্তু দশ বছর দেশ শাসন এবং তিরিশ বছর ক্ষমতার বাইরের রাজনীতি তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশে পরিণত করেছে। চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির সমীকরণে সাবেক এই সেনা প্রধান মূল্যায়িত হবেন।

সন্দেহ নেই, এরশাদ সমকালীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে স্বাস্থ্য সচেতন ও ফিটফাট ছিলেন তিনি। তার বড় কোনও রোগ-ব্যাধির কথাও জানা যায়নি। ফলে কয়েক দিন হাসপাতালে থেকে চিরবিদায়ের পথে তার চলে যাওয়াটা তার দলের নেতা ও কর্মীদের কাছে আকস্মিক।

কারণ, অতীতে তিনি স্বাস্থ্যগত চিকিৎসা কিংবা রাজনৈতিক কৌশলগত প্রয়োজনে একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং পরিস্থিতি অনুকূল হলে আবার ফিরেও এসেছেন। কিন্তু এবার তিনি সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে ফিরে আসতে পারেননি। তিনি ফিরে এসেছেন জীবনের সব লেনদেন মিটিয়ে।

এরশাদের মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেমন প্রভাব ফেলবে, তার চেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো, তার দল জাতীয় পার্টিতে তার শূন্যতার ফলে কেমন অবস্থার সৃষ্টি হবে?

জাতীয় পার্টিকে তিনি ক্ষমতা দখলের পর গঠন করেছিলেন। ডান, বাম, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ইত্যাদি প্রায়-সকল দল থেকেই ক্ষমতালিপ্সুদেরকে এনে তিনি তার দলে ভিড়িয়ে ছিলেন। ক্ষমতার সময়কাল শেষে অনেকেই আবার দল ছেড়ে পুরনো দলে ফিরেও গেছেন। শেষ পর্যন্ত এরশাদের দলে যারা থেকে গেছেন, তারা ছিলেন বা আছেন রাজনৈতিক-মতাদর্শিক কারণে নয়, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও সুযোগ-সুবিধার জন্য।

বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দর কষাকষির ক্ষেত্র হিসাবে জাতীয় পার্টি যে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, অনেক কৌশলী নেতাই সেই সুযোগ ও সুবিধাটুকুকে কাজে লাগিয়েছেন। অনেক অনামা নেতার ভাগ্যও খুলেছে এভাবে।

ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে যে, এরশাদের পর জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ কেমন? কারণ, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বা অন্যান্য পার্টি যেভাবে একটি আদর্শিক কাঠামোতে দলের নেতা-কর্মীদের বিশ্বস্ত ও অনুগত করতে পেরেছে, জাতীয় পার্টি তা পারে নি। মতাদর্শিক দিক দিয়ে পার্টির সুস্পষ্ট অবস্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিভাত নয়।

আরও পড়ুন: একজন এরশাদ

বরং জাতীয় পার্টি ব্যক্তি এরশাদ ও আরও কয়েকজন নেতার ইমেজের দল হিসাবে পরিগণিত এবং আরও সঠিকভাবে বললে, পুরো বাংলাদেশ নয়, উত্তরবঙ্গ এবং আরও কিছু পকেট এলাকায় দলের সমর্থন ভিত্তি প্রসারিত। এমন একটি দলের শীর্ষ স্তম্ভ, যিনি ঐক্য ও দলীয় সংহতির প্রতীক ছিলেন, তার অবর্তমানের প্রভাব পড়বেই।

এরশাদ ক্ষমতায় ও ক্ষমতার বাইরে প্রায় ৪০ বছর রাজনীতিতে সরব থাকলেও তার রাজনীতি মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল না। ছিল নিজেকে কারাগার ও শাস্তি থেকে বাঁচানোর রাজনীতি। যে রাজনীতিতে অংশ নিয়ে আরও অনেকেই কিছু কিছু ব্যক্তিগত সুবিধা পেয়েছেন।

বিশেষ করে, দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির অদূরদর্শী রাজনীতির কারণে জাতীয় পার্টি কিছু সুবিধা পেয়েছে এবং সেটা পেয়েছে এরশাদের ইমেজের কারণে। এরশাদের মৃত্যুর পর পুরো প্রেক্ষাপটই বদলে যাবে। তখন জাতীয় পার্টির অবস্থা কেমন হবে?

এরশাদের অনুপস্থিতিতে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের সঙ্কট বার বার দেখা গেছে। সকালে একজনকে দায়িত্ব দিয়ে বিকেলে তাকে বদলিয়ে আরেকজনকে দায়িত্ব দিতে হয়েছে। দলে পরিবারতন্ত্র-আত্মীয়তা এবং আঞ্চলিকতাও প্রকট। একমাত্র ঐক্য ও সমঝোতার জায়গা বলতে ছিলেন এরশাদ নিজে। সেই জায়গাটি চলে যাওয়ার পর জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে হোঁচট খাবে। নিশ্চিত করে বলা যায় যে, এরশাদ বিহীন জাতীয় পার্টি অস্তিত্বের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।

একজন স্বৈরাচার থেকে জনপ্রিয়-গণতান্ত্রিক রাজনীতিক হিসাবে নিজেকে উত্তরণ ঘটানো খুব সহজ কাজ নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু সামরিক ও স্বৈরশাসক ক্ষমতা দখল করলেও শেষ পর্যন্ত নিজেকে গণতান্ত্রিক অবয়বে রূপান্তরিত করতে পারেন নি।

এরশাদ দশ বছর ক্ষমতায় আর তিরিশ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে সে সুযোগ পেয়েছিলেন। এবং সাধ্যমতো সে সময় চেষ্টাও করেছেন, নিজেকে গ্রহণযোগ্য ও জনসম্পৃক্ত করতে। তিনি জেল খেটেছেন, মাঠে থেকেছেন এবং কোনও অবস্থাতেই রাজনৈতিক অঙ্গন ছেড়ে যান নি। তিনি প্রচলিত রাজনীতিতে নিজেকে নিরাপদ ও সক্ষম রাখতে পেরেছিলেন ক্ষমতার পালাবদলের অংশ হয়ে। নিজের দল, নেতা, কর্মী বাহিনীকে তাৎক্ষনিক ক্ষমতার রাজনীতির অংশে পরিণত করেছিলেন।

আরও পড়ুন: জাতীয় ফ্রন্ট থেকে এরশাদের জাপা

দীর্ঘমেয়াদী আদর্শ ও কর্মসূচিমুখী রাজনীতি এরশাদ নিজে এবং তার দল জাতীয় পার্টি করতে পেরেছে, বলা যাবে না। ফলে তার অনুপস্থিতিতে তার দল সুনির্দিষ্ট মতাদর্শিক পথ খুঁজে পেতে হীমসীম খাবে। এরশাদের স্থলে দলে আরেকজন এরশাদও পাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ফলে নেতৃত্বের সঙ্কট কিংবা নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব-সংঘাত হবে স্বাভাবিক বিষয়।

এরশাদের মৃত্যুতে তার নিজের রাজনৈতিক জীবনের ভালো-মন্দের মূল্যায়ন যেমন চলবে, তেমনি চলবে তার দল জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ নিয়ে বিতণ্ডা ও দোলাচল। এর ফলে, মৃত্যুতেই এরশাদের অবসান হবে না। তিনি হয়ত আরও অনেক দিন প্রাসঙ্গিক ও জাগরূক থাকবেন বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতির অঙ্গনে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর