রাজনীতির ‘দুষ্টু বালক’ ও আমাদের ‘এরশাদ সিনড্রোম’

, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-08-28 10:16:24

৮৯ বছরের এক বিশাল কর্মজীবন পেছনে ফেলে সব আলোচনা-সমালোচনার ওপারে চলে গেছেন এরশাদ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এরশাদ একাই একটি অধ্যায়। এরশাদের জাতীয় পার্টি (জাপা) হয়তো আরও বহুদিন রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়েই থাকবে, তবে এরশাদবিহীন জাপা ধীরে ধীরে তার রাজনৈতিক গুরুত্ব হারাবে বলেই মনে হয়।

তার দীর্ঘ পেশাগত ও রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য তিনি দলকেও ছাড়িয়ে গেছেন বহুমাত্রায়। তার অনুপস্থিতিতে জাপা হয়তো এখন সেটিই অনুভব করবে। ক্ষমতার সিঁড়ির কাছাকাছি যেতে এরশাদের বিকল্প এখনও তৈরি হয়নি। এছাড়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিপরীতে একটি শক্ত প্রতিরক্ষা ঢাল হিসেবেও তার জুড়ি নেই। তাই জাপার মতো একটি সমর্থক শক্তি রাজনীতিতে প্রয়োজন ছিল বৈকি। অপর দলের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় এরশাদবিহীন জাপা আগামীতে কতটা শক্তি জোগাতে পারে সেটিই এখন দেখার বিষয়।

তবে পার্টির গুরুত্ব থাকা না থাকা নির্ভর করে দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ওপর। দলের ভেতরে সামরিক বেসামরিক ক্যারিয়ারিস্ট নির্বিশেষে এরশাদের মতো হাই-প্রোফাইল রাজনীতিক আর নেই। এক সময় জাপা করেছেন দেশের অনেক হাই প্রোফাইল রাজনীতিক। মিজানুর রহমান চৌধুরী, কাজী জাফর, শাহ মোয়াজ্জেম, মওদুদ আহমেদসহ দেশের প্রথিতযশা অনেক রাজনীতিকরা এরশাদের জাপাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা বামপন্থী রাজনীতি থেকে এসেছেন। ডিগবাজীর এই রাজনীতি শুরু হয় জিয়ার আমলে। সামরিক, বেসামরিক আমলা ও পেশাজীবীদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করেন জিয়া।

এরশাদও একই কায়দায় সামরিক-বেসামরিক আমলা, পেশাজীবীদের দলে ভেড়ান। কিন্তু ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ার পর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তাদের বেশির ভাগই আজ আর জাপায় নেই। যেমন নেই বিএনপিতে। সময় বুঝে আজ জিয়ার উপদেষ্টা, কাল এরশাদের উপদেষ্টা বা মন্ত্রী হয়েছেন অনেকে। নগদ ইনামের আশায় এরকম রাজপন্ডিতের (উপদেষ্টা) নজির আজও বিরল নয়। ক্ষমতার লোভে যারা ডিগবাজী দিয়ে জাপায় এসেছিলেন, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে তারাই সবার আগে উল্টো ডিগবাজী দিয়েছেন। কেউ বা মৃত্যৃ বরণ করেছেন, অবসর নিয়েছেন। ফলে জাপায় আজ ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান যাকে বলে সে রকম কেউ নেই বললেই চলে। ক্যারিশম্যার কথা বাদই দিলাম। ফলে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বই জাপার জন্য আজ বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো ক্ষমতার রাজনীতিতে একইভাবে দলের গুরুত্ব বহাল রাখা।

১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিচ্ছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ/ ছবি: সংগৃহীত

 

এরশাদকে নিয়ে আলোচনা আছে, আছে সমালোচনা। কোনোটাই ভিত্তিহীন নয়। তিনি একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেছেন। বিদ্যমান দলগুলোর অদূরদর্শীতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে নিজেই ৯ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকেছেন। সব সামরিক শাসক যা করেন এরশাদও তাই করেছেন। জিয়াউর রহমান বিএনপি করেছেন, এরশাদ করেছেন জাতীয় পার্টি। নয় বছর ক্ষমতায় থেকে বিদায় নিয়েছেন সত্য, কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিতে এরশাদের গুরুত্ব কমেনি মোটেও। বরং ক্ষমতার রাজনীতিতে নিজের পাল্লা ভারি করতে এরশাদের বিকল্প শুধুই এরশাদ। আগামী দিনের ক্ষমতার রাজনীতিতে জাপা একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ থাকতে পারবে কিনা জাপা’র জন্য আপাতত এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য অন্তত আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে ‘ক্ষমতা’, ‘রাজনীতি’ ও ‘কৌশলের’ সঙ্গে ভোটের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর বিষয়টি অনেকাংশেই নির্ভর করে। এ সম্পর্ক যেভাবে শিথীলতার দিকে যাচ্ছে তাতে তৃতীয় কোনো সহায়ক শক্তির রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতাও হয়তো ফুরিয়ে যাবে। তবে সে রাজনীতি আমাদের হিসাবের বাইরে। আমরা শুধু এটুকুই বলতে পারি, এরশাদ জাপায় যেমন অপরিহার্য ছিলেন, ক্ষমতার রাজনীতিতেও ছিলেন একই রকম অপরিহার্য।

একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে শপথ নিচ্ছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ/ ছবি: সংগৃহীত

 

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য। এই উপমহাদেশে ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলই বেশি বিকাশ লাভ করেছে। ভারতে যেমন কংগ্রেস, পাকিস্তানে মুসলিম লীগ, পিপলস পার্টি, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাপা। ভারতের বিজেপি অথবা বাংলাদেশের জামায়াত একটি ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ চর্চা করে। কাজেই প্রচলিত রাজনীতি থেকে তাদের রাজনীতি ভিন্ন, নেতৃত্বের বিষয়টিও ব্যক্তি বা পরিবার নির্ভর নয়। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ যদিও ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে বিকাশ লাভ করেছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দলের প্রয়োজনেই বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতেই দলের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়। সেই থেকে প্রায় চার দশক আওয়ামী লীগও ব্যক্তি কেন্দ্রিক দলীয় রাজনীতির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

দলের ভবিষ্যৎ পারিবারিক সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর বিএনপি ও জাপার শুরুই হয়েছে একজন ব্যক্তি বিশেষের রাজনৈতিক খায়েস মেটানোর জন্য। জিয়া ও এরশাদ যদি ধরেও নিই যে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ক্ষমতা দখল করেছেন (ডকট্রিন অব নেসিসিটি), না হলে দেশ গোল্লায় যেতো ইত্যাদি, ইত্যাদি... তারপরও বাস্তবতা হলো তারা কেউ দেশের সেই কথিত ক্রান্তিলগ্ন পার হওয়ার পর ব্যারাকে ফিরে যাননি। গদি আঁকড়ে ধরে থেকেছেন। জিয়া নিহত হওয়ার পর বিচারপতি সাত্তার ও পরে খালেদা জিয়া বিএনপির হাল ধরেন। সেই থেকে আজও ব্যক্তি ও পারিবারিক দখলমুক্ত হতে পারেনি বিএনপি।

একই কায়দায় এরশাদ নয় বছর ক্ষমতায় থাকার পরও জাপা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যক্তি এরশাদ থেকে জাতীয় পার্টি মুক্ত হতে পারেনি চার দশকেও। পতিত সামরিক ও স্বৈরশাসকরা ‘মরিবার পূর্বে মরিতে চান না’। তাই নিরাপদ ও স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত করতেই তারা দলের সভাপতি বা উপদেষ্টার পদ আজীবন আঁকড়ে থাকেন। এরশাদের হয়তো এক্সিটওয়ে ছিল, কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিতে তার প্রয়োজন ছিল এবং তিনিও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা উপভোগ করে গেছেন। ক্ষমতার প্রতিটি কোনায়ই তিনি বিচরণ করেছেন।

সেনাপ্রধান, সিএমএলএ, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীর মর্যাদা সম্পন্ন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, বিরোধী দলের নেতা সব ক্ষেত্রেই তার সরব উপস্থিতি আমরা দেখি। সবকিছু যে তার প্রয়োজন ও ইচ্ছায় হয়েছে হয়তো সেরকমটি নয়। অনেকটা রাজনীতি ও ‘ক্ষমতা’র প্রয়োজনেই তার এই এদিক ওদিক, কখনো নিজের কখনো অপরের প্রয়োজনে। এখানেই এরশাদের অপরিহার্যতা। আর এজন্যই আমরা তাকে বলি ‘রাজনীতির দুষ্টু বালক’।

সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে বক্তব্য দিচ্ছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ/ ছবি: সংসদ টিভি 

 

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের তিনটি বড় দলের মধ্যে জাপা আপাত একজন ব্যক্তির নেতৃত্ব থেকে মুক্ত হলো বটে। কিন্তু ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা থেকে বের হয়ে নতুন করে পরিবারভূক্ত হলো বলেই মনে হচ্ছে। এতে আপতত হয়তো জাপা প্রাথমিক ধাক্কাটি সামলাতে পারবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে পার্টির নিয়তি নির্ধারণে তা কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে তা সময়ই বলবে।

এরশাদের সমালোচনা আছে অনেক। কিন্তু নির্মোহ দৃষ্টিতে বললে এ সমালোচনা থেকে সবাই-ই কি মুক্ত? রাজনীতিতে এরশাদ একটি সিনড্রোম। এ সিনড্রোমে সব রাজনৈতিক দলই আক্রান্ত। এমনকি নাগরিক হিসেবে আমরাও কি সুবিধাবাদী নই? এরশাদ আমাদের সুযোগসন্ধানী, সুবিধাবাদী, ভোগবিলাসী ও ডিগবাজীর রাজনীতির আইকন। কিন্তু এরশাদ সিনড্রোম কি আমাদের মাঝেও নেই? এরশাদকে গালি দেওয়া সহজ, কারণ তিনি ক্ষমতাহীন এক ‘দুষ্টু বালক’। এরশাদের বিদায়ের পর রাজনীতিতে হয়তো সহসা সমালোচনা করার মতো লোকটি বিদায় নিলেন। কিন্তু তাতে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে কি? এরশাদের বিদায়ের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ভাড়ামি হয়তো কিছুটা কমবে, কিন্তু রাজনৈতিক দুষ্টামি বন্ধ হবে কি?

এরশাদুল আলম প্রিন্স: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর